প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫, ০৯:২২
এটাই তাহলে বাস্তবতা!?

গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠে ‘ফরিদগঞ্জে ধান সংগ্রহ অভিযান : কৃষকের লাভের টাকা পথে পথেই শেষ’ শিরোনামের সংবাদটি পড়ে সচেতন পাঠকমাত্রই ব্যথিত হয়েছেন। কেউ কেউ স্বগতোক্তি করেছেন : এটাই তাহলে বাস্তবতা! সংবাদটিতে লিখা হয়েছে, ফরিদগঞ্জ উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। এ বছর সরকার প্রতি মণ সর্বোচ্চ ১৪৪০ টাকা মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করার কারণে কৃষকরা খুশি। কিন্তু কৃষকদের লাভের টাকা পুরোটাই যাচ্ছে পথে পথে। লেবার বিল, কসর বাবদ বাড়তি ধান প্রদান, অফিস খরচ এবং সর্বশেষ ধানের টাকা নিতে এসে হয়রানি হওয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে। তবে বিগত পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ের মতো ভয়াল সিন্ডিকেট না থাকলেও গোপন সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, চাঁদপুর সেচ প্রকল্পভুক্ত ফরিদগঞ্জ উপজেলায় এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে খাদ্য অধিদপ্তরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ৬ হাজার মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর জন্যে প্রকাশ্যে লটারির মাধ্যমে অনলাইনে আবেদনকৃত কৃষকদের মধ্য থেকে ২৫২জনকে নির্বাচিত করা হয়। সরকারিভাবে এবার বোরো ধান কেনার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ টাকা। বাজারে ধানের দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় কৃষকরা খুশি। কিন্তু কৃষকের এই আনন্দ হতাশায় পরিণত হচ্ছে। কেননা ধান বিক্রি করতে এসে পদে পদে খরচ দিতে গিয়ে লাভের দেখা না মিলায়। একজন কৃষক লটারির মাধ্যমে ৩ টন (৭৫ মণ) ধান বিক্রি করতে গেলেও সরকারি মূল্যে দাম ১ লাখ ৭ হাজার ৭০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও কৃষককে লেবার খরচ হিসেবে প্রতি মণে ৩০ টাকা দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ ৭৫ মণে দিতে হচ্ছে ২ হাজার ২ শ’ ৫০ টাকা। খাদ্য অফিসে অলিখিত খরচ হিসেবে টন প্রতি ১০০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। কসর হিসেবে প্রতি মণে ২ কেজি বেশি করে দিতে হচ্ছে কৃষকদের। অর্থাৎ ৭৫ মণে ১৫০ কেজি। কেজি ৩৬ টাকা করে ১৫০ কেজি ধানের দাম ৫৪০০ টাকা বেশি দিতে হয় গুদামে। সব মিলিয়ে সরকারি মূল্য মণ প্রতি ১৪৪০ টাকা হলেও কৃষক সকল খরচ বাদ দিয়ে পায় ১২৪০ টাকা। এরপর কৃষকদের বাড়ি থেকে খাদ্য গুদাম পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া বাবদ একটি বড়ো অংক গুণতে হচ্ছে। লটারির মাধ্যমে প্রথম হওয়া ফারুক খান জানান, আমার এক নামে ৩ টন ধান বিক্রি করতে গেলে প্রতি মণে লেবার খরচ ৩০ টাকা করে দিতে হয়েছে। অফিস খরচ বাবদ প্রতি টন ধানে ১ হাজার করে ৩ হাজার টাকা খরচ নিয়েছে। এসব অভিযোগের তীর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জামাল উদ্দিনের দিকে।অভিযোগ রয়েছে, তিনি গোপন সিন্ডিকেটের সাথে মিল করে গোপনে অনেক কিছুই করছেন। অফিস খরচ নিচ্ছেন। ধানের আর্দ্রতা নিয়ে কৃষকদের হয়রানি করছেন। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ফরিদগঞ্জ খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জামাল উদ্দিন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, লেবার খরচ নেয়ার বিষয়টি সত্য। এছাড়া অন্য কোনো কিছু নেই। কোনো সিন্ডিকেট নেই। ফরিদগঞ্জ উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা মিজানুর রহমান লেবার বাবদ মণ প্রতি ৩০ টাকা করে নেয়ার কথা স্বীকার করেন। লেবাররা কোনো বিল পায় না বলেই এই খরচ নেয়া হয়। এছাড়া বস্তার ওজন ও কসর বাবদ বাড়তি ১কেজিসহ মোট ৪২ কেজি ওজন মাপা হচ্ছে। অফিসের কথা বলে কোনো রকম টাকা নেওয়ার কথা তিনি জানেন না বলে জানান। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা রাজিয়া জানান, বিষয়টি মাত্র জেনেছেন এবং খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন।
ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রতিটি উপজেলায় ধান সংগ্রহ অভিযান করা হয়। এটা বাহ্যিকভাবে আনন্দের বিষয় হলেও এর বিপরীতে রয়েছে কৃষকের চাপা কষ্ট। কেননা সরকারের খাদ্য বিভাগের লোকজন প্রকাশ্য/গোপন সিন্ডিকেটের সহায়তায় কৃষকদের আর্থিকভাবে শোষণ করে। পরিণামে কৃষক লাভের টাকা পুরোপুরি ভোগ করতে পারে না। উপরোল্লিখিত সংবাদে সরকারের খাদ্য বিভাগ কর্তৃক কৃষক-শোষণের ফরিদগঞ্জীয় যে নমুনা তুলে ধরা হয়েছে, এটা যদি দেশের অন্যান্য উপজেলার ক্ষেত্রেও সত্য হয়, তাহলে বলতে হবে : আমরা মুখে মুখেই দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলি, বাস্তবে কোথায় কী হয় সেটা খেয়াল করি না। যারা খেয়াল করে তাদেরকে ম্যানেজ করা হয়। এটাও আরেকটা নিরেট বাস্তবতা, যা চরম দুঃখজনক।