প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৫, ০৯:২৭
আজ বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস
‘আলোচনার বিস্তার ঘটান-লক্ষণ চিনুন-ঝুঁকি কমান’

জাতিসংঘের আহ্বানে সারা পৃথিবীতে ১৫ জুনকে প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘আলোচনার বিস্তার ঘটান, লক্ষণ চিনুন এবং ঝুঁকি কমান।’ প্রতিপাদ্যের প্রথম ধাপ হলো, প্রবীণরা যতভাবে নির্যাতনের শিকার হন সে বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জনসাধারণের সামনে খোলামেলা হাজির করতে হবে।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো, নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হলে সহজে জনসম্মুখে আনতে চায় না মানুষ তার দুর্বল জায়গাগুলো, আড়াল করতে পছন্দ করে। প্রবীণ বয়সে মানুষ তুলনামূলকভাবে বেশি নির্যাতনের শিকার হন।এসব নির্যাতনের ঘটনা প্রায়শই সাধারণ মানুষের নজর এড়িয়ে যায়। সংঘটিত নির্যাতনের অল্প কিছু চিত্র আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখি। বেশিরভাগ নির্যাতনের ঘটনা ভুক্তভোগী নিজ থেকেই চেপে যান। কারণ নির্যাতনকারীরা পরিবারের সদস্য, নিকটতম আত্মীয় স্বজন, সেবা কর্মী, বন্ধু বান্ধব হয়ে থাকেন। নির্যাতনের চিত্র গোপন না করে জনসাধারণের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরার এখনই সময়।
আমাদের প্রবীণরা প্রধানত শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন।
শারীরিক নির্যাতনের ধরণ হলো, চড়, থাপ্পড়, গলা ধাক্কা, খুন্তি, লাঠির দ্বারা আঘাত করা কিংবা খাবার দাবার, ওষুধপত্র, চিকিৎসা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি বা অসহায়তা করা।
মানসিক নির্যাতন হলো, পছন্দের কাজ করতে বাধা দেয়া, গালাগালি করা, খোঁটা দেয়া, তির্যক মন্তব্য করা, গুরুত্ব না দেয়া, অবহেলা-অসম্মান করা, বাড়ি থেকে বের করে দেয়া, অতীতের ব্যর্থতাকে সামনে নিয়ে আসা, অক্ষমতাকে কটাক্ষ করা।
আর্থিক নির্যাতন হলো, জমিজমা, বাড়িঘর, প্লট- ফ্ল্যাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সঞ্চয়পত্র, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো, টাকা পয়সার জন্যে ছেলেমেয়ে, আত্মীয় স্বজনের ওপর নির্ভর করা; চাহিদা মোতাবেক টাকা পয়সা খরচ করতে না পারা।
সামাজিক নির্যাতন হলো, সামাজিক কাজে অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া, বিচার সালিস বৈঠকে না ডাকা, প্রবীণদের কল্যাণে চুপচাপ থাকা, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করা। প্রবীণরা যৌন নির্যাতনের শিকার হন বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
উপরের সকল ধরনের নির্যাতন সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করলে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। নির্যাতিত হওয়া অপরাধ কিংবা অসম্মানের বিষয় নয় বরং নির্যাতনকারী অপরাধী এবং ঘৃণিত ব্যক্তি।
দ্বিতীয় ধাপ হলো নির্যাতনের লক্ষণ সমূহ চিহ্নিত করতে পারা। যখন কোনো প্রবীণ ব্যক্তি হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যান, কথা বলা কমিয়ে দেন, প্রিয় জিনিসপত্রের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন না, খাবার খেতে চান না, চিকিৎসা নিতে অনাগ্রহী, বেড়াতে যেতে চান না, পরিধানের কাপড়চোপড় ময়লা থাকে, আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন, নিজের যত্ন নিতে অনিচ্ছুক হন, তখন বুঝতে হবে তিনি কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলে চিকিৎসার জন্যে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ফার্মেসিতে যাবে। শরীরের আঘাত দৃশ্যমান হতে পারে কিংবা নাও হতে পারে। কীভাবে আঘাত পেয়েছেন তা বলতে অনিচ্ছুক অথবা কেউ কেউ মিথ্যা গল্প বানিয়ে বলে সত্য লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। প্রবীণদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারলে তাঁরা সত্য প্রকাশে সাহসী হয়ে উঠবেন। অনেক সময়ে ভয়ে নির্যাতনের কথা বলতে চান না, পাছে আরো বড়ো ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। প্রবীণরা ছেলেমেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হলে পরিবারের অন্য সদস্যরা বুঝতে পারবে। তাদের উচিত হবে এসব নির্যাতনের ঘটনাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা। মীমাংসার নামে একে অপরের সাথে মিলিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। সবাই মিলে নির্যাতনের মূল কারণ খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে একই ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে না হয়। প্রবীণদের সাথে মেলামেশা, আড্ডা, গল্প গুজবের সময় নাম প্রকাশ না করে নিজের কিংবা ঘনিষ্ঠ জনের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরা হয়। এসব নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রবীণদের চলন বলন, কথাবার্তা থেকে নির্যাতনের অনেক লক্ষণ ফুটে উঠে। সমাজের বিবেচনা সম্পন্ন মানুষের দায়িত্ব হলো আলোচনার বিস্তার ঘটিয়ে লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। যখনই নির্যাতনের সংবাদ পাওয়া যাবে, তখনই সোচ্চার কণ্ঠে মানুষকে জানাতে হবে।
তৃতীয় ধাপ হলো প্রবীণ নির্যাতনের ঝুঁকি হ্রাস করা। আমাদের প্রবীণদের বড়ো একটি অংশ ছেলেমেয়ে, পরিবার পরিজনের উপর নির্ভরশীল। তাঁরা পরিবারে সম্মান মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে চান। নির্যাতনের শিকার হলে পরিবারে বসবাস নরকতুল্য হয়ে যায়। নির্যাতনের ঝুঁকি হ্রাস করতে বেশ ক’টি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
একটি ওয়ার্ড বা নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী প্রত্যেক প্রবীণের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, ইমাম, ধর্মীয় নেতা, সমাজকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি এলাকায় প্রবীণদের জীবনযাপনের ধরণ দেখে ঝুঁকিপূর্ণ প্রবীণদের তালিকা তৈরি করবেন। অল্প ঝুঁকিপূর্ণ, মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ এবং অতি ঝুঁকিপূর্ণ প্রবীণদের আলাদা তালিকা তৈরি করতে হবে।
এই তালিকা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছে থাকবে, যাতে করে বিভিন্ন সময়ে মাঠ পরিদর্শনে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ প্রবীণ ব্যক্তিদের খোঁজ খবর নিয়ে ঝুঁকি হ্রাস করার সুযোগ পায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতি তিন মাস অন্তর ঝুঁকিপূর্ণ প্রবীণদের তথ্য সংগ্রহ করে হালনাগাদ করবে। গ্রাম পুলিশ, কমিউনিটি পুলিশ, ইউনিয়ন সমাজকর্মী পালাক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ প্রবীণদের খোঁজ খবর নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অবহিত করবেন। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠ পরিদর্শনে কমপক্ষে এক জন ঝুঁকিপূর্ণ প্রবীণের সাথে কথা বলেন। স্থানীয় প্রবীণদের নিয়ে গঠিত কমিটি নির্যাতিত প্রবীণের পক্ষে আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সরকারি টোল ফ্রি জরুরি প্রবীণ সেবা ফোন নাম্বার ঝুঁকি হ্রাসে সহায়তা করবে।
লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।