মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩৫

পরিবার ও দেশের উন্নয়নে প্রবাসী চাঁদপুরবাসীর অবদান অনস্বীকার্য

মোহাম্মদ সানাউল হক
পরিবার ও দেশের উন্নয়নে প্রবাসী চাঁদপুরবাসীর অবদান অনস্বীকার্য

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে যেসব রেমিট্যান্স যোদ্ধা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে চাঁদপুর জেলার প্রবাসীরা অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা চাঁদপুরের প্রায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার প্রবাসী বৈধ পথে ব্যাংক ও অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও অবৈধ পথে বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে যে অর্থ দেশে আসে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই অঙ্কও কোনো অংশে কম নয়।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম শক্তি হলো প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। দেশের মোট ৬৪ জেলার মধ্যে ১০টি জেলায় প্রবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই জেলাগুলো থেকে প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন। তালিকায় শীর্ষে রয়েছে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, টাঙ্গাইল, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী ও ফেনীসহ আরও কয়েকটি জেলা।

সূত্রে জানায়, কুমিল্লা জেলা থেকে সর্বোচ্চ ৬ লাখ ১৯ হাজার ১৩৮ জন বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। চট্টগ্রাম দ্বিতীয় স্থানে, এখান থেকে ৫ লাখ ৪১ হাজার ৭০৯ জন প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বিদেশে গেছেন ২ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮১ জন। টাঙ্গাইল থেকে ২ লাখ ৯০ হাজার ৭১৭ জন নিয়ে চতুর্থ স্থানে এবং ঢাকা জেলা থেকে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৭৩৪ জন নিয়ে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। এই তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে চাঁদপুর জেলার প্রবাসীরা।

এছাড়া মুন্সীগঞ্জ থেকে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৭৭ জন, নরসিংদী থেকে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৩৮৪ জন এবং ফেনী থেকে ১ লাখ ৫৬ হাজার ১৯৯ জন বিদেশে অবস্থান করছেন। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, দেশের কয়েকটি জেলা থেকেই বৃহৎ সংখ্যক শ্রমশক্তি বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তবে সংখ্যার বিচারে চাঁদপুর ষষ্ঠ স্থানে থাকলেও অর্জন এবং সুনামের দিক দিয়ে জেলার প্রবাসীরা বিশেষভাবে আলাদা।

চাঁদপুর জেলার বৈধ প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার। তারা নিয়মিত ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে আসছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চাঁদপুর জেলা থেকে ৭৪ কোটি সাত লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এই অঙ্ক হয়তো শীর্ষ জেলাগুলোর চেয়ে কিছুটা কম, কিন্তু কর্মসংস্থান, শৃঙ্খলা ও সুনামের কারণে চাঁদপুরবাসীরা বিশেষ সম্মান অর্জন করেছেন।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম জেলা থেকে ২২৫ কোটি ১০ লাখ ডলার, কুমিল্লা থেকে ১৪৪ কোটি আট লাখ, নোয়াখালী থেকে ৮৩ কোটি পাঁচ লাখ, ফেনী থেকে ৮০ কোটি ১৯ লাখ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৭৭ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এই পরিসংখ্যান তুলনায় চাঁদপুর জেলার অবস্থান মাঝামাঝি হলেও বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর হার এখানে তুলনামূলক বেশি।

রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে বড়ো ভূমিকা রাখছে। গত ১১ মাসে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৭৫০ কোটি ৬৩ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে শুধু ঢাকা বিভাগেই এসেছে ১ হাজার ৩৫৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার এবং চট্টগ্রাম বিভাগে এসেছে ৭৫৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। এই বিশাল অঙ্কের ভেতর চাঁদপুরের অবদানও উল্লেখযোগ্য।

কোরবানির ঈদের প্রাক্কালে রেমিট্যান্সের প্রবাহ সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায়। মে মাসে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ২৯৭ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ৩১.৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে পাঠানো অর্থের অবদান সবচেয়ে বেশি। সৌদি আরব প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের এমন সফলতা অল্পকিছু দুষ্কৃতকারীদের কুকর্মের কারণে অনেক সময় বিতর্ক জন্মায়।

সাম্প্রতিক সময়ে রিয়াদ প্রবাসীদের কাছ থেকে জানা যায়, রিয়াদের বাথা-হারা এলাকা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি প্রবাসীদের অন্যতম প্রধান বসবাসের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। তবে এখানে প্রায়ই বিভিন্ন জেলার প্রবাসীদের আধিপত্য বিস্তার এবং পারস্পরিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একটি জেলার প্রভাবশালী প্রবাসীরা কেবল শক্তি প্রদর্শন ও প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে নিজেদের জেলার মানুষকে ভিসা দিয়ে সৌদি আরবে নিয়ে আসে। তারা প্রবাসী সমাজে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে এবং প্রতিপক্ষের সঙ্গে সামান্য বিষয়েও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসব সংঘর্ষে মারধর, ভাংচুর এমনকি গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে থাকে।

মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা জানান, সৌদি প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশিদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উল্লেখ্য, সৌদি আরবে বাংলাদেশি প্রবাসীরা মূলত শ্রমনির্ভর কাজ করে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অথচ কিছু সংখ্যক ব্যক্তির এই ধরনের হঠকারী আচরণ গোটা প্রবাসী সমাজকে কলঙ্কিত করছে। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে বিভাজন ও আঞ্চলিকতার জটিলতা দিন দিন বাড়ছে, যা পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদ সৃষ্টি করছে। এ কারণে সচেতন মহল মনে করছে, এই সমস্যা সমাধানে প্রবাসী সংগঠন, দূতাবাস এবং সৌদি প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবাসীদের মধ্যে একে অপরকে হত্যা বা সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। মক্কা ও জেদ্দায় টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ জেলার কয়েকজন প্রবাসী সহকর্মীর হাতে নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার এক প্রবাসীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। এই ধরনের ঘটনায় বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে।

সৌদি আরব প্রবাসী তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী জানান, চাঁদপুর জেলার প্রবাসীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার নজির খুবই কম। তাদের বিরুদ্ধে অপরাধপ্রবণতার অভিযোগ পাওয়া যায় না বললেই চলে। বরং শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ কর্মস্থলে শ্রম দিয়ে বৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে তারা অন্য জেলার প্রবাসীদের কাছে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

চাঁদপুরের প্রবাসীরা মূলত পরিবার ও এলাকার উন্নয়নের কথা চিন্তা করে সৎ পথে উপার্জনে মনোনিবেশ করেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স শুধু পরিবারের মুখে হাসি ফোটায় না, একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ কারণে প্রবাসী চাঁদপুরবাসীরা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে ‘শান্তিপ্রিয় ও পরিশ্রমী’ পরিচয়ে সমাদৃত। আইন মেনে চলা, ভিসার শর্তাবলি অনুসরণ করা এবং বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানোয় তাদের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ইতিবাচকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।

সূত্রে জানায়, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে ওঠানামা লক্ষ্য করা যায়। তবে সাম্প্রতিক দুই মাসে সৌদি আরব আবারও শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো রেমিট্যান্স উৎস হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বিপুল সংখ্যক প্রবাসী সেখানে কর্মরত থাকায় এ প্রবাহে তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। বৈধ পথে অর্থ প্রেরণের মাধ্যমে তারা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন। এতে জাতীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে। পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো এ অর্থে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। পরিবারগুলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো উন্নয়নেও এ রেমিট্যান্স বড়ো ভূমিকা রাখছে। ফলে চাঁদপুরের প্রবাসীরা জাতীয় অর্থনীতিতে অনুকরণীয় অবদান রাখছেন।

সৌদি প্রবাসী আনোয়ার মাঝি জানান, চাঁদপুরের প্রবাসীরা শুধুমাত্র পরিবারের কাছে অর্থ প্রেরণের মাধ্যমে নয়, বৈধ ও স্বচ্ছ লেনদেনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তাদের এই নিয়মিত রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে সহায়ক হচ্ছে, যা অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রবাসীরা ব্যাংক ও অনুমোদিত মানি ট্রান্সফার এজেন্সির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করার ফলে অবৈধ বা কালো অর্থের প্রবাহ রোধ হচ্ছে এবং সরকারের আর্থিক নীতি বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। তাদের এই দায়শীলতা ও ন্যায্য প্রেরণ প্রক্রিয়া সরকারি পর্যায়ে উচ্চ প্রশংসা পেয়েছে; প্রবাসী মন্ত্রণালয় কর্তৃক চাঁদপুরের প্রবাসীদের নিয়মিত অবদানের জন্যে একাধিকবার ধন্যবাদ ও স্বীকৃতি জানিয়েছে, যা অন্য জেলার প্রবাসীদের জন্যেও অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় চাঁদপুরের প্রবাসীরা তাই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পরিশ্রম, সততা ও শৃঙ্খলার কারণে তারা আজ রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মধ্যে সুনামের জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে এসে বলা যায়, সংখ্যায় শীর্ষ না হলেও চাঁদপুর জেলার প্রবাসীরা অর্জন ও সুনামের দিক থেকে এগিয়ে। বৈধ পথে অর্থ প্রেরণ, অপরাধমুক্ত প্রবাস জীবন এবং ইতিবাচক সামাজিক ভাবমূর্তি গড়ে তুলে তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডে এক বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন।

মোহাম্মদ সানাউল হক : +৯৬৬০৫৭৬৩২৮৫৫০।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়