প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৫, ২১:৩৪
রাসূল (সা.)-এর মর্যাদা মুফতি

মুহাম্মাদ (সা.) সমগ্র সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এবং মহান আল্লাহ তায়ালা প্রিয় হাবিব। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমস্ত জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন। শুধু মানুষ নয়, জ্বিন, ফেরেশতা, পশুপাখি, গাছপালা সকল সৃষ্টিই তাঁর রহমতের অন্তর্ভুক্ত। একজন মুসলমানের ঈমানের জন্য যেমন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস অপরিহার্য, তেমনি রাসূল (সা:) এর প্রতি ভালোবাসা, সম্মান ও আনুগত্যও ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ।
নিম্নে রাসূল (সা.) এর মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও আল্লাহর নিকট তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কুরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ করব।
রাসূল (সা.) সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা: আল্লাহ তাআলা স্বয়ং কুরআনে বিভিন্নভাবে রাসূল (সা:) এর সম্মান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন:
১. জগতের জন্য রহমত: আমি আপনাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি। “ ( সূরা আম্বিয়া : ১০৭)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, রাসূল (সা.) শুধু কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা যুগের জন্য নন; বরং তিনি সর্বকালের, সর্বজাতির, সব সৃষ্টির জন্য রহমত।
২. পূর্ণ চরিত্রের অধিকারী: “ আপনি অবশ্যই উত্তম চরিত্রের অধিকারী। “ (সূরা কলম : ৪) চরিত্রের পরিপূর্ণতা এমনই মাত্রায় ছিল যে, আল্লাহ তায়ালা স্বীকার করে প্রশংসা করেছেন।
৩. আল্লাহ ও ফেরেশতারা তাঁকে দরুদ পাঠ করেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি দুরূদ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমারাও তাঁর প্রতি দুরুদ ও সালাম পাঠ করা। “( সূরা আহযাব : ৫৬)
এই আয়াতে রাসূল (সা.) এর মর্যাদার সর্বোচ্চ প্রতিফলন পাওয়া যায়। আল্লাহ নিজে এবং তাঁর সকল ফেরেশতা যখন নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করেন, তখন তাঁর মর্যাদা কেমন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
৪. তাঁর আনুগত্য মানেই আল্লাহর আনুগত্য: যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। “ ( সূরা নিসা : ৮০)
এটি রাসূল (সা.) এর সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্কের গভীরতা বোঝায়। তাঁর কথা, কাজ ও নির্দেশ আল্লাহর ইচ্ছারই প্রতিফলন।
৫. রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে স্পষ্ট আলো: তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক আলো ও স্পষ্ট কিতাব। “ ( সূরা মায়িদা : ১৫) এখানে “আলো” বলতে মুফাসসিরগণ রাসূল (সা.) কেই বোঝান।
৬. রাসূলের বিরুদ্ধে কিছু বলা মারাত্মক অপরাধ: তাঁরা যারা রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি। “ (সূরা তাওবা : ৬১)
৭. রাসূল (সা.) কে সম্বোধনের শিষ্টাচার: “হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের আওয়াজকে নবীর আওয়াজের ওপর তুলে দিও না। “ (সূরা হুজুরাত : ২)
৮. রাসূলের জীবন অনুসরণ আবশ্যক: তোমাদের জন্য রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। “ ( সূরা আহযাব : ২১)
হাদিসের আ লোকে রাসূল (সা.) এর মর্যাদা: রাসূল (সা.) নিজেই তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে বিভিন্ন সহীহ হাদিসে ইঙ্গিত দিয়েছেন। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য হাদীস তুলে ধরা হলো:
১. সমস্ত নবীদের সর্দার : রাসূল (সা.) বলেন: “আি ম কিয়ামতের দিন আদম সন্তানদের নেতা হব, কিন্তু এতে গর্ব নেই।” (সহীহ মুসলিম)। অর্থাৎ সমস্ত নবী ও রাসূলদের মধ্যেও তাঁর অবস্থান সবচেয়ে উঁচুতে।
২. সর্বপ্রথম সুপারিশকারী: কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথ ম সুপারিশ ও দরখাস্ত করার সম্মান রাসূল (সা.) এরই থাকবে। তিনি বলেন: “আমি প্রথম সুপারিশকারী ও প্রথম সুপারিশ গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হব।” (সহীহ মুসলিম)
৩. আরশের নিচে বিশেষ সম্মান: হাদিসে এসেছে, কিয়ামতের দিন আরশের ছায়াতলে বিশেষ কিছু লোক থাকবেন। তাদের মধ্যে রাসূল (সা.) সবার আগে থাকবেন এবং তাঁর জন্য “মাকামে মাহমুদ” নির্ধারিত থাকবে, যা একমাত্র তাঁরই জন্য সংরক্ষিত।
৪. নবুওয়াতের সীল: “আমি শেষ নবী, আমার পরে কোনো নবী নেই।” (সহীহ মুসলিম)
৫. মাকামে মাহমুদ : “আমাকে কিয়ামতের দিন একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থান দেওয়া হবে, যা আমার পূর্বে কেউ পায়নি।” (বুখারী)
৬. নবীজি সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া করবেন: “সারা মানব জাতির মাঝে সবচেয়ে বড় সুপারিশকারী হব।” (মুসলিম)
৭. কিয়ামতের সুপারিশ : “আমার উম্মতের জন্য আমি প্রথম ও সর্বোচ্চ সু পারিশকারী।” (তিরমিযী)
৮. রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ঈমানের শর্ত : “ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার জন্য নিজের জান-মালের চেয়েও প্রিয় হই।” (বুখারী)
সাহাবায়ে কেরাম ও ওলী-আউলিয়াগণের দৃষ্টিতে রাসূল (সা.) এর মর্যাদা: রাসূল (সা:) এর সাহাবিরা তাঁর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্যে এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, তাঁকে চোখে দেখাও যেন পরম সৌভাগ্যের বিষয় ছিল।
আবু বকর (রা.) বলেন: “রাসূল (সা.) ছিলেন আমার কাছে দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে প্রিয়।”
উমর (রা.) বলেন: “হে রাসূল! আপনি আমার নিজের থেকেও প্রিয়।” (বুখারী)
ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন: “একবার আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমার কাছে আমার সবকিছু থেকে প্রিয়, শুধু নিজের জান ছাড়া।’ তখন তিনি বললেন, ‘তোমার ঈমান পূর্ণ হবে না যতক্ষণ না আমি তোমার নিজের থেকেও প্রিয় হই।’ আমি বললাম, ‘এখন আপনি আমার নিজের থেকেও প্রিয়।’ তিনি বললেন, ‘এখন ঠিক বলেছ।’(বুখারী)
বিলাল (রা.) এর ভালোবাসা: নবীজি ইন্তেকালের পর বিলাল (রা.) আর মদিনায় আযান দিতেন না। যখন হযরত ওমর (রা.) তাঁকে শাম থেকে নিয়ে আসেন, তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে আযান দেন, যার প্রতিটি শব্দে মদিনা কেঁদেছিল।
উমর (রা.) এর আইন: এক ব্যক্তি রাসূল (সা:) কে অসম্মান করে কথা বললে উমর (রা.) তাঁকে শাস্তি দেন এবং বলেন, “যে ব্যক্তি রাসূলকে অপমান করে, তার জন্য মুমিনদের মধ্যে কোনো স্থান নেই।”
রাসূল (সা.) এর মর্যাদা সৃষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে :
১. ফেরেশতাগণ: জিবরাঈল (আ.) রাসূল (সা:) এর খেদমতে অবতরণ করতেন। বিভিন্ন ইলাহী বাণী, হুকুম-আহকাম নিয়ে যেতেন তাঁর নিকট।
২. জ্বিন সম্প্রদায়: রাসূল (সা.)-এর কুরআন তিলাওয়াত শুনে বহু জ্বিন ঈমান এনেছিল এবং তারা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গিয়ে দাওয়াত দিয়েছিল। (সূরা আহকাফ)
৩. প্রকৃতি ও নিসর্গ: উহুদের পাহাড় রাসূল (সা:) কে ভালোবাসতো। এমনকি গাছের খুঁটি—যার পাশে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন তাঁর বিচ্ছেদে কেঁদেছিল।
রাসূল (সা.) এর মর্যাদার বাস্তব প্রমাণ: একটি ঐতিহাসিক ঘটনা
তাইফের ঘটনা: একবার রাসূল (সা.) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তাইফ যান। সেখানকার লোকেরা তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করে। ফেরেশতা এসে প্রস্তাব করেন, যদি তিনি অনুমতি দেন তবে পাহাড় চাপিয়ে পুরো জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি দোয়া করেন: “হে আল্লাহ! এরা না জানার কারণে এমন করেছে। হয়তো এদের বংশধরদের কেউ হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে।” এই ঘটনা রাসূল (সা:) এর দয়ালুতা, উদারতা ও মহানুভবতার জীবন্ত প্রমাণ।
রাসূল (সা.) এর জীবনে দয়ার নমুনা :
১. বদরের বন্দিদের প্রতি দয়া: যখন কাফের বন্দিদের আনা হয়, তিনি তাঁদের সাথে অত্যন্ত মানবিক আচরণ করেন, তাদের শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেন।
২. মক্কা বিজয়ের দিন : তিনি তাঁর শত্রুদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য ইউসুফ (আ.)-এর মতোই বলি আজ তোমাদের কোনো অপরাধ নেই, তোমরা সবাই মুক্ত।”
৩. মুনাফিকের জানাজায় অংশগ্রহণ : মুসলিমদের মধ্যে একজন বিদ্বেষী মুনাফিক মারা গেলে নবীজি তার জানাজা পড়েন, যদিও আল্লাহ পরে নিষেধ করেন। তাঁর দয়ার সীমা ছিল অপরিসীম।
রাসূল (সা.) এর মর্যাদা মুসলিম উম্মাহর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ
মুসলিম হিসেবে রাসূল (সা.) এর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বকে হৃদয়ে ধারণ করাই ঈমানের মূল ভিত্তি। তাঁর প্রেম ও অনুগত মুমিন জীবনের পাথেয়।
রাসূল (সা.) বলেন: “তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার পিতা-মাতা, সন্তান ও সকল মানুষের চেয়েও বেশি প্রিয় না হই।” (বুখারী ও মুসলিম)
ওলামায়ে কেরামদের দৃষ্টিতে রাসূল (সা:) এর মর্যাদা
১. ইমাম নববী (রহ.) বলেন: “রাসূল (সা:) এর প্রতি ভালোবাসা শুধু আবেগ নয়, বরং তাঁর সুন্নতের অনুসরণ ও তাঁর আদর্শে জীবন গড়াই প্রকৃত ভালোবাসা।”
২. হাফিজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেন: “রাসূলের প্রতি দরুদ পাঠ শুধু ইবাদত নয়, বরং এটি তাঁর মর্যাদা স্বীকার ও ভালোবাসা প্রকাশের অন্যতম উপায়।”
৩. শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) বলেন: “আল্লাহ তাআলা রাসূলকে এমন সম্মান দিয়েছেন যা অন্য কোনো নবী পাননি।”
রাসূল (সা.) এর মর্যাদা ইসলামী আইন ও বিধানের আলোকে :
১. রাসূলের অপমানকারীর দণ্ড: ইসলামী শরীয়াতে রাসূল (সা.) এর প্রতি কটুক্তি করা অত্যন্ত মারাত্মক অপরাধ। ইমাম মালিক (রহ.), ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সহ বহু ইমাম বলেন, এদের জন্য কঠিন দণ্ড নির্ধারিত।
২. রাসূলের কথা অগ্রাহ্য করা কুফর: যে ব্যক্তি রাসূলের সুন্নত অস্বীকার করে, হাদীস উপহাস করে, তার ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কুরআনে বলা হয়েছে, “তারা বলে, আমরা আল্লাহকে মানি কিন্তু রাসূলকে মানি না। তারা আসলে মুনাফিক।” (সূরা নিসা) ★
রাসূল (সা.) এর মর্যাদার ওপর ভিত্তি করে করণীয় :
১. প্রতিদিন দরুদ পাঠ করা : “যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর দশটি রহমত বর্ষণ করেন।” (মুসলিম)
২. সুন্নত অনুসরণ করা : জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাসূল (সা:) এর আদর্শ অনুসরণ করা চাই-চলার ধরন, কথা বলার ভঙ্গি, খাওয়ার নিয়ম, ঘুমানোর পদ্ধতি, ইত্যাদি।
৩. রাসূল (সা.) এর মর্যাদা রক্ষায় সোচ্চার হওয়া : যখন কেউ কটুক্তি করে, তখন তার বিরুদ্ধে আইনগত ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলন। তবে শরীয়তের সীমা অতিক্রম করা যাবে না ও দেশের আইন হাতে তুলে নেয়া যাবেনা।
৪. সন্তানদেরকে রাসূলের জীবন সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া : সন্তানদেরকে রাসূল (সা.) এর মিলাদ ও সিরাত পাঠ অভ্যস্থ করা এবং রাসূল (সা.) এর ভালোবাসার জীবন গড়ে তোলা অপরিহার্য।
৫. রাসূল (সা.) এর মর্যাদা ও ভালোবাসা নিয়ে মিলাদ- মাহফিল, বই, লিফলেট, অনলাইন কনটেন্ট তৈরি করে রাসূল (সা.) এর আদর্শ প্রচার করা।
পরিশেষে বলব, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মর্যাদা এমন এক অবস্থানে, যা কারো পরিমাপ করার ক্ষমতার বাইরে। আল্লাহ তাঁর নামে শপথ করেছেন, ফেরেশতা তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করে, তিনি সমস্ত সৃষ্টির জন্য রহমতস্বরূপ এবং সমস্ত নবীদের সর্দার। আমাদের জন্য তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণই প্রকৃত সৌভাগ্য।
রাসূল (সা.) এর মর্যাদা নিয়ে যতই বলা হোক না কেন, তাঁর মর্যাদার পরিপূর্ণতা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত, এবং আমাদের জীবন-আদর্শ।
একজন মুসলমানের জীবনে রাসূল (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য না থাকলে তার ঈমান পূর্ণ হয় না। তাই আমরা তাঁর মর্যাদাকে অন্তরে ধারণ করি এবং আমল ও আচরণে তা প্রকাশ করি।