শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫৮

বয়স বৈষম্যের অবসান চাই

হাসান আলী
বয়স বৈষম্যের অবসান চাই

বয়স বৈষম্য হলো শুধুমাত্র বয়সের কারণে কারো প্রতি বিরাগ, বিরক্তি, ঘৃণা, বিদ্বেষ কিংবা অসমতা প্রদর্শন করা। আমাদের আচার আচরণে, চলন-বলনে নির্দিষ্ট একটি বয়সের প্রতি নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা বা মনোভাব পোষণ করা বৈষম্যমূলক।

প্রকৃতির মধ্যেই বৈষম্য রয়েছে। বৈষম্য সৃষ্টি করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। বৈষম্য দূর করার লড়াই মানুষকে মানবিক গুণাবলি অর্জনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বৈষম্য বজায় রাখার পক্ষে যেমন জোরালো যুক্তি থাকে, তেমনি বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে আরো বেশি জোরালো যুক্তি থাকে। মানুষ তার সকল আচরণের পক্ষে একটা দার্শনিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে। যিনি ঘুষ খান তিনি বলেন, সবাই ঘুষ খায় আমি না খেয়ে কী করবো! শুধু বেতনের টাকায় সংসার চলে না।

দার্শনিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে কৃতকর্মকে জাস্টিফাই বা ন্যায্যতা প্রদানের চেষ্টা চলমান রয়েছে।

পারিবারিক ক্ষেত্রে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রতি আমাদের প্রবীণদের অনেকেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। যে সকল নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করে তার কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো, আজকালকার পোলাপান খারাপ, ছেলেমেয়েরা একটু বেশিই বোঝে, রোজগারের চিন্তা নাই, খরচ করতে পারলেই বাঁচে, লেখাপড়ার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই, শুধু বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা আর ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে থাকা, মুরব্বিদের এখন সম্মান করে না, বাস্তবে নাই শুধু স্বপ্নে ভাসে, একেকজন বুদ্ধির ঢেঁকি, কথা বার্তায় পণ্ডিতি ভাব নেয় ইত্যাদি।

তরুণদের মধ্যে অনেকেই প্রবীণদের প্রতি নেতিবাচক ধ্যান ধারণা পোষণ করে। যেমন-গার্ডিয়ান দুর্বল, তাই বিদেশে পড়তে যেতে পারলাম না, বাসায় ঢুকলে মেজাজ খারাপ হয়ে শুধু জবাবদিহিতা, উপদেশ-পরামর্শে প্রাণ জ্বালপালা হয়ে গেলো, টাকা চাইলে মুখ বাংলা পাঁচের মতো হয়ে যায়, দুর্ভাগ্য যে গরীবের ঘরে জন্ম নিয়েছি, নতুন চিন্তা-ভাবনার কথা শুনলে আঁৎকে উঠে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে এই নিয়ে হা হুতাশ করে, টাকা পয়সা খরচ করতে চায় না, ভালো মডেলের একটা গাড়ি কেনার কথা শুনলে হার্ট অ্যাটাক করবে, বাইরে খেতে চাইলে চোখ কপালে তোলে ইত্যাদি।

শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ঠিক করে দিয়েছে কোন্ বয়সে কোন্ ধরনের শিক্ষা লাভ করতে পারবে। যেমন দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তির বয়স-৭, তৃতীয় শ্রেণিতে-৮, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে-১১, সপ্তম শ্রেণিতে-১২, অষ্টম শ্রেণিতে-১৩ এবং ৯ম শ্রেণিতে ন্যূনতম-১৪ বছর বেঁধে দিয়েছে। ভর্তির বয়সের ঊর্ধ্ব সীমা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে। শিক্ষা বিরতি যৌক্তিক হলে ভর্তির সুযোগ থাকে, যৌক্তিক না হলে ভর্তির সুযোগ থাকে না। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এটা বয়সের দোহাই দিয়ে বিরত রাখা অন্যায়। অসম বয়সীদের সাথে শিক্ষা গ্রহণ করতে সমস্যা হলে তা নিরসনে বাস্তব ভিত্তিক ভূমিকা পালন করতে হবে। সেটা আরেকজনের শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত করে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অধিক বয়সী কাউকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে দেয় না। সান্ধ্যকালীন কিছু কোর্সে উচ্চ টিউশন ফি’র বিনিময়ে শিক্ষা বাণিজ্য চলমান রেখে সনদ বিতরণ কর্মসূচি চলছে। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এবং অবসর গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়স ৩২ করা হয়েছে, অবসরের ক্ষেত্রে বয়স ৫৯ বছর করা হয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে কাউকে চাকরিতে রাখতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসর গ্রহণের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর, উচ্চ আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রে ৬৭ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অবসর গ্রহণের বয়স ৬৫ বৎসর করার আহ্বান জানিয়েছে। চাকরি প্রার্থী তরুণরা চাকরিতে প্রবেশের জন্যে বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি জানিয়ে আসছে।

যিনি ৫৯ বছর বয়সে অবসরে যান তিনি তার সকল মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা বিলুপ্ত করে যান না। দীর্ঘ সময় ধরে চাকরি করে যে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা অর্জন করা হয় তা ৫৯ বছর বয়সে এসে শেষ হয়ে যায় না। বাধ্যতামূলক অবসর ব্যক্তির প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের সামিল। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষ শারীরিক এবং মানসিকভাবে কর্মের উপযুক্ত ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে কর্মে থাকার সুযোগ দিতে হবে। চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সের বাধ্যবাধকতা তুলে দেয়াই উচিত। যার যেমন যোগ্যতা তিনি তেমনই বেতন ভাতা, পারিশ্রমিক, সম্মানী পাবেন।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি হবার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স দেয়া হয়েছে, কিন্তু সর্বোচ্চ বয়স দেয়া হয়নি। জনগণ চাইলে শতবর্ষী কাউকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে পারে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে প্রবেশের সর্বনিম্ন বয়স ১৬ বৎসর। ১৮ বছর চাকরি শেষ করে ৪০/৫০ বছর বয়সে অবসরে চলে যেতে হয়। কারো পদোন্নতি না হলে ৪০ বছর বয়সের মধ্যেই অবসর গ্রহণ করতে হয়। শুধুমাত্র বয়সের কারণে কাউকে চাকরিতে প্রবেশ কিংবা অবসর গ্রহণ করার জন্যেকজবব বাধ্য করা যায় না।

চিকিৎসার ক্ষেত্রে অধিক বয়সী মানুষ অনেক সময় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, সেবা যত্ন পায় না। পরিবার পরিজন বলে, ‘জয় কালে ক্ষয় নাই / মরণ কালে ওষুধ নাই।’

প্রবীণের চিকিৎসার খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্যে পরিবারের সদস্যদের আগ্রহ কমে যায়। প্রবীণের ভবিষ্যত নাই তাই বিনিয়োগে আগ্রহ নাই। শিশুর ভবিষ্যত আছে, ফলে তার চিকিৎসার জন্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি হয়। চিকিৎসকরা অনেক ক্ষেত্রে হতাশ কণ্ঠে প্রবীণকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলে। চিকিৎসক রোগ ভালো হবে না কিংবা প্রচুর খরচ হবে বলে হাল ছেড়ে দেন। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবরা দায় দাবি ছাড়ানোর জন্যেন এসে সান্ত্বনাসূচক কথা বার্তা বলে প্রবীণকে বিব্রত করে। মৃত্যু যেন প্রবীণদেরই হয়, আর কোনো বয়সে মৃত্যু আসে না।

ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রবীণদেরকে অবসরে যাবার জন্যে পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবরা বলতে থাকে। কেউ কেউ বলতে থাকে, আর কতো! এবার থামেন! ছেলেমেয়েদের হাতে ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে দেন, ধর্মে মন দেন, দুনিয়া কিছু না, আজ মরলে কাল দুই দিন, পরকালের সঞ্চয় করেন। এসব কথা যারা বলেন, তাদের বিবেচনা করা উচিত, যিনি তার রক্ত ঘামে এই ব্যবসা বাণিজ্য, কল কারখানা, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তাকে গায়ে পড়ে এসব হিতোপদেশ দেয়া ঠিক কিনা!

প্রবীণ ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে আমাদের এক শ্রেণির মানুষের নাক-উচুঁ ভাব লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ বলেন, টাকার কুমির, কৃপণ, কিপ্টে ইত্যাদি। ব্যবসা সত্যিকার অর্থে একধরনের সেবা। পণ্য ন্যায্য মূল্যে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়া এবং উৎপাদনকারীর থেকে ন্যায্য মূল্যে পণ্য ক্রয় করা ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কাজ।

ঋনদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পারতপক্ষে প্রবীণদের ঋণ দিতে চায় না। বড় ধরনের জামানত ছাড়া ঋণদানে আগ্রহী হয় না। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা ঋণ পাবার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার।

প্রবীণরা সহায় সম্পদ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে অনেক সময় পারিবারিক ও সামাজিক সমর্থন, সহযোগিতা পান না। প্রবীণদের হাতে সহায় সম্পদ নিরাপদ নয় বলে এমন চিন্তা ভাবনা আমাদের মধ্যে রয়েছে। বয়স হয়েছে শুধু এসব কথা বলে সহায় সম্পদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিরত রাখা বৈষম্য মূলক আচরণ। সাধারণ প্রবীণরা অনেক সময় অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং ক্ষমতাবানদের কথা শুনে। প্রবীণরা যত মূল্যবান কথাই বলুক না কেন, অর্থ বিত্ত, ক্ষমতা না থাকলে এসবের দাম নাই। প্রবীণদের মত প্রকাশের প্রতি সাধারণ মানুষের তেমন কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।

মেট্রোরেলে প্রবীণদের বসার জন্য অগ্রাধিকার থাকলেও প্রবীণরা অনেক সময় দাঁড়িয়ে যান। সাহস করে তরুণদেরকে সীট ছেড়ে দিতে বলতে পারে না। আর যদিও কেউ বলে তবে সহযাত্রীরা তেমন একটা পাত্তা দেন বলে মনে হয় না। এই বৈষম্য নিরসনে প্রবীণদের পাশে কে দাঁড়ায়?

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়