প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:২০
প্রবীণদের যেসব আচরণ নবীনদের কষ্ট দেয়
প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হয়। সামাজিক পরিবর্তনগুলো সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পরিবর্তনগুলো শুরুতেই নাকচ করে দিতে নেই। কেন পরিবর্তন হচ্ছে তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কোনো কিছু দেখা কিংবা শোনামাত্র প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকা ভালো। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রতিটি প্রজন্মের সাথে চিন্তা চেতনার, রুচি সংস্কৃতির, দৃষ্টিভঙ্গির, জীবনযাপনের বিষয়ে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়। নতুন প্রজন্ম প্রতিনিয়ত আগের প্রজন্মের চিন্তা চেতনাকে নাকচ কিংবা অবজ্ঞা করতে পারে। সে জন্যে বিচলিত হয়ে রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সকল বড়ো ধরনের পরিবর্তন নতুন প্রজন্মের হাত ধরে এসেছে। বাংলাদেশে ভাষার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নতুন প্রজন্ম প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বেশিরভাগ সামাজিক পরিবর্তন নতুন প্রজন্মের হাত ধরে উঠে আসে।
|আরো খবর
প্রবীণ বয়সে এসে অনেকেই আত্মরক্ষামূলক আচরণ করে। সহায় সম্পদ, নীতি নৈতিকতা, মূল্যবোধ রক্ষায় বেশি সতর্কতা দেখায়। পারিবারিক জরুরি প্রয়োজনেও অনেক সময় স্থায়ী সম্পদ বিক্রি কিংবা হস্তান্তর করতে চায় না। অনেক কষ্টে অর্জিত সহায় সম্পদ ব্যক্তির অবর্তমানে শূন্য হতে বেশি সময় লাগেনি এমন ঘটনা আমাদের জীবনে কম-বেশি সবার জীবনেই আছে।
ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা ভেবে বর্তমানকে ঝুঁকির মধ্যে রাখা কতোখানি যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে। আমরা পৃথিবীর জন্যে অপরিহার্য নই। একটি বিশেষ সময়ে পরিবার পরিজনের জন্যে আবশ্যক হতে পারি, কিন্তু সবসময়ই নয়। এই পৃথিবীতে আপনার আমার ভূমিকা অতি সামান্য। পৃথিবীতে আমাদের অনুপস্থিতিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। তবে কিছুটা প্রভাব পরিবার পরিজনের ওপর পড়ে। আমাদের প্রবীণরা যৌবনে সমাজে, সংসারে বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের জন্যে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সেসব ত্যাগ আমরা অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবো।
একসময় সমাজ, সংসার, রাষ্ট্রের অনেক ত্যাগ স্বীকার করলেই নতুন প্রজন্মের ওপর অধিকার জন্মায় না।আপনি আপনার সময়কার দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। পৃথিবীতে আপনার আমার আগে কোটি কোটি মানুষ এসেছে। লাখ লাখ মানুষ সমাজ পরিবর্তনে জীবন দিয়েছেন, আবার আগ্রাসী দখলদার বাহিনীর হাতে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন। উদ্ধার কাজে নিয়োজিত মানুষও অনেক সময় জীবন হারায়। মানুষ পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে, শান্তিতে স্বস্তিতে থাকতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন।
আমরা নতুন প্রজন্মের প্রতি নানা কারণে রাগ-ক্ষোভ- বিরক্তি প্রকাশ করে থাকি। আমরা আমাদের অবস্থান থেকেই বেশির ভাগ সময়ে মন্তব্য করে থাকি। অনেক সময় এসব মন্তব্য দুঃখজনক হয়।এমনকি আমরা পরিবেশ পরিস্থিতি পর্যন্ত বিবেচনায় নিতে চাই না।
যেসব মন্তব্য শুনে নতুন প্রজন্ম বিরক্ত হয়, রাগ করে তার কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই। যেমন-- এখনকার ছেলেমেয়েরা আত্মকেন্দ্রিক শুধু নিজেরটুকু বুঝে; বাপ-মার দুঃখ-কষ্ট- সামর্থ্য বুঝতে চায় না; শুধু বন্ধু বান্ধব নিয়ে পড়ে থাকে; বাসার খাবার দাবারে আগ্রহ নেই, বাইরের খাবারদাবার পছন্দ; ছেলেমেয়েরা ফাস্ট ফুড নির্ভর হয়ে পড়েছে; খাবার বাসায় বসে অনলাইনে অর্ডার দিলেই হলো; বাপের হোটেলে খায় আর আড্ডা দিয়ে বেড়ায়; পড়াশোনায় মন নাই, আজাইরা কাজে ব্যস্ত; চাকরি করার মন নাই, উদ্যোক্তা হবার জন্যে নাচে; টাকা পয়সা খরচ করে, হিসাব চাইলে মেজাজ দেখায়; কী সব জামা কাপড় পরে দেখলেই লজ্জা লাগে; সাজগোজ আর ফ্যাশন করে দিন কাটে; কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না বরং বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে যায়; পোলাপান এখন নিশাচর হয়েছে, সারা রাত জেগে থাকে আর সারাদিন ঘুমায়; আগে পোলাপান রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তো, সকালে ঘুম থেকে উঠতো, এখন দুপুরের পর ঘুম থেকে উঠে, স্কুল কলেজে নাম মাত্র যায়; পড়াশোনা মোবাইল- ল্যাপটপে আটকে গেছে; ছেলেপেলে নষ্ট হলো প্রাইভেটে এ লেভেল এবং ও লেভেল পরীক্ষা দেবার সুযোগ পেয়ে; বাসায় আসলে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রাখে; বন্ধু বান্ধব নিয়ে প্রশ্ন করলে রেগে উঠে; ছেলেমেয়েরা আমাদের জিম্মি করে রেখেছে; যা চায় তা আদায় না করে ক্ষান্ত হবে না; বাসায় আসতে দেরি করলে কারণ জানতে চাওয়া যায় না; ফোন করলে বিরক্ত হয় এবং রেগে যায়; ছেলেমেয়ে জন্ম দিয়ে মনে হয় ভুল করেছি; ছেলেমেয়েরা বাপ-মায়ের কষ্ট বুঝতে চায় না; পরিশ্রমের কোনো কাজ করতে রাজি না; বাসায় নিজের রুমটা পর্যন্ত ঘুচিয়ে রাখে না; নিজের কাপড় চোপড় কোনোদিন ধুয়ে দেখেনি; এক গ্লাস পানি ঢেলে খাবে না; বাসায় কেউ আসলে ভালো করে একটু কথা বলতে চায় না; মুরব্বিদের কথার দাম দেয় না; এদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার; ফোনে দাদা-দাদি, নানা-নানির সাথে কথা বলতে উৎসাহ বোধ করে না।
প্রবীণরা কোনো বাসায় গিয়ে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, চাকরি বাকরি, বিয়ে শাদী, ক্যারিয়ার নিয়ে অতিরিক্ত প্রশ্ন করে বিরাগভাজন হন। অনেক প্রবীণ তাদের সময়ে কত কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন সে সবের দীর্ঘ ফিরিস্তি দিতে থাকেন।
বিসিএস পরীক্ষা কেন দিচ্ছে না বা দিলে পাস করতে না পারার কারণ জানতে চাওয়া, বিসিএস হলে এডমিন, পুলিশে না হলে আফসোস করা, সরকারি চাকরি সুযোগ সুবিধা কেমন এসব নিয়ে কথা বলা,
যা সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে তেমন একটা দোষের কিছু মনে হবে না। একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে প্রশ্নকারী প্রবীণ তরুণের দুর্বল দিকের প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
প্রশ্ন শেষে নবীনকে পরামর্শ, উপদেশ দেয়া শুরু করবে। গায়ে পড়ে এমন অনাবশ্যক প্রশ্ন, পরামর্শ নবীনদের বিরক্তি তৈরি করে দেয়। বেশিরভাগ সময় তরুণরা সামনাসামনি এসব বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে না, কিন্তু আড়ালে গিয়ে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করে।
প্রবীণরা কেউ কেউ নবীনদের ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করে। যেমন-বিয়ে হয়েছে কিনা, বিয়ে করছো না কেন, বিয়ে ভাঙ্গলো কেন, ছেলেমেয়ে কয়জন, বাচ্চা নিচ্ছ না কেন, কোন্ ডাক্তার দেখাও, বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছ না কেন, বাচ্চা কার গায়ের রং পেয়েছে, আয় রোজগার কেমন, নিজের কোনো ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে, বউ কী করে, ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলছে, শ্বশুর শাশুড়ি কেমন, বেকার বসে থাকলে হবে, ছোট থেকে বড়ো হতে হবে, ফলে ছোট থেকে শুরু করছো না কেন ইত্যাদি।
উপরের এসব নসিহত এবং প্রশ্ন শুনে তরুণদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
আমাদের উচিত হবে, নবীনদের দুঃখ-কষ্টগুলো বোঝার চেষ্টা করা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সহায়তা করা।
নিজের জ্ঞান, দক্ষতা, যোগ্যতা, বুদ্ধি, বিবেচনা যদি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, তাতে বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। অতীতের সমস্ত জ্ঞান, দক্ষতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পরিবর্তিত হয়েছে এবং আরও উন্নত স্তরে উন্নীত করা গেছে।
কোনো কিছু আগে থেকে চূড়ান্ত করে তরুণদের সাথে আলাপ করতে গিয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে না।
নবীনদের চিন্তা ভাবনাকে সমর্থন দিয়ে এগিয়ে নিতে সহায়তা করুন অথবা পছন্দ না হলে নীরব থাকুন। বিতর্ক তৈরি করে পথ আটকে দিবেন না প্লিজ!