প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:১১
পরামর্শের যন্ত্রণায় প্রবীণ জীবন
প্রবীণ জীবনে পা দেয়ার সাথে সাথেই পরামর্শের জোয়ার বইতে থাকে। ঘরে বাইরে পরামর্শের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠে প্রবীণ। সুযোগ পেলে এক ডোজ পরামর্শ দিতে কেউ ছাড়ে না। আপনি হয়তো হাঁটুর ব্যথায় চলাচল সীমিত করে ফেলেছেন। কিন্তু পরামর্শ আসবে হাঁটার চাইতে ভালো কোনো ব্যায়াম নেই। কেউ হয়তো আরেক ধাপ এগিয়ে বলবে, নী রিপ্লেসমেন্ট করে নেন, খরচ তো এখন সাধ্যের মধ্যে চলে এসেছে।
|আরো খবর
শরীর ভালো না বলে বিয়ে বাড়িতে খেতে বসলেন না, তখনই পরামর্শ আসবে, আরে, একদিন খেলে কিছু হয় না। আপনি অসুস্থ হয়েছেন, অমনি পাড়া- প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, ছেলেমেয়ে পরামর্শ দিতে শুরু করবে। কোন্ ডাক্তার, কোন্ হাসপাতাল, কোন্ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কোন্ দেশে কেমন চিকিৎসা তার বিস্তারিত বিবরণ শুনতে হবে। এসব পরামর্শ যারা শোনেনি তারা কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে থাকবে।
আপনি পেনশনে গেলেন বা যাবেন, তখনই পরামর্শ শুরু হবে। কেউ বলবে, মাটি খাঁটি মাটিতে লাগান, ব্যাংকে রাখেন, খবরদার ব্যাংকে রাখবেন না, শেয়ার কিনেন, ভুলেও শেয়ার কিনবেন না, সঞ্চয়পত্র কিনে রাখেন, বাড়ি বানান বা সংস্কার করেন, ব্যবসা করেন, ছেলেমেয়েদের দিয়ে দিন, মরলে তো ওরাই পাবে। জীবিত থাকতে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলুন, এবার পরকালের সঞ্চয় করার কাজে লেগে যান ইত্যাদি।
জমিজমা সহায় সম্পদ থাকলে তা কী করতে হবে সেই পরামর্শ আসবে। কেউ বলবে, সন্তান সন্তুতিদের মধ্যে বিলি বন্টন করে দিন, যাতে মৃত্যুর পর এসব নিয়ে ঝামেলা না হয়।আবার কেউ বলবে, খবরদার সহায় সম্পদ নিজের হাত ছাড়া করে কারো করুণার পাত্র হবেন না।
ছেলেমেয়ের বিয়ে নিয়ে পরামর্শ হলো, বিয়ে ফরজ কাজ, আপনি দেখেশুনে বিয়ে দেন। ওদের নিজেদের পছন্দ থাকলে সেখানেই রাজি হয়ে যান। আরে আজকালকার ছেলেমেয়েরা ব্রেক আপ নিতে ব্যস্ত, বিয়ে করার সময় কই! হাজার হাজার বছর ধরে বিয়ে প্রথা আছে বলে মানুষ সামাজিক জীবন পেয়েছে। বিয়ে দেন, শুভ কাজে দেরি করতে নেই।
ইলেকশনে প্রার্থী হলে পরামর্শ, খালি হাতে নির্বাচন হবে না, টাকা পয়সা খরচ করতে হবে। এখন সততা, যোগ্যতা দেখে ভোট দেয় না। কেন যে এই বয়সে এসে নির্বাচনে প্রার্থী হলেন! নির্বাচন এখন ভালো মানুষের জন্যে না। কোন্ শয়তানের বুদ্ধিতে নির্বাচনে আসলেন! জামানত টিকবে কিনা সন্দেহ আছে। আরে জিতলেও কিছু করতে পারবেন না।
বিয়ের জন্যে পাত্র/ পাত্রী খুঁজলে পরামর্শ, মরার সময় বুড়ো বয়সে লোক হাসানোর জন্যে বিয়ে করতে পাগল হয়েছে। বিয়ে তো অবৈধ অসামাজিক কাজ না, কারো কথা শোনার দরকার নেই, কবুল করে ফেলেন। বিয়ে কোনো সমাধান না, শুধু ক্যাচাল বাড়ায়ে লাভ কি! যৌবন উতলে উঠেছে, শরম থাকলে বিয়ের কথা মুখে আনতো না। এখন বিয়ে করলে একটা কোল বালিশই পাবে আর কিছু না। হাঁটু- কোমরে ব্যথায় কাতর, তার আবার বিয়ের সাধ!
জমিজমা সহায় সম্পদ বিক্রি করতে চাইলে পরামর্শ হলো, জমিজমা জোড়ানো কঠিন, কিন্তু খোয়ানো সহজ। দরকার হলে বিক্রি করতে হবে, কারো কথা শুনবেন কেন? নিজের প্রয়োজন মিটালে হবে না, সন্তানের ভবিষ্যত ভাবতে হবে। জমিজমা অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে আছে কিনা দেখেন। আরে কাগজপত্র ঠিক থাকলে খারিজ করে নেন। দালাল ছাড়া বেচতে পারবেন না।
সামাজিক কাজে অংশ নিলে পরামর্শ হলো, সমাজ গেছে নষ্ট হয়ে, আর আপনি আসছেন সামাজিক কাজে! আপনি একলা সমাজের কোনো পরিবর্তন করতে পারবেন না। দুষ্টু লোকেরা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে, আপনি তাদের সাথে পারবেন না। টাকা পয়সা মানুষের মধ্যে বিলায়ে দেন।
ধর্মকর্মে মন দিলে পরামর্শ হলো, মরার সময় সবাই সোজা হয়ে যায়। আকাম কুকাম শেষ করে এখন ধর্মে মন দিছে। কয় দিনের দুনিয়া! আজ মরলে কালকে দুদিন! কিসের এতো অহংকার আর দেমাগ! ধর্মে মন দিলে ভালো থাকা যায়। ঘুষ-দুর্নীতির টাকা গরীবেরে বিলায়ে দিয়ে ধর্মে মন দিলে ভালো হতো। লোক দেখানো ধর্ম কর্ম করে লাভ হবে না।
খাবার টেবিলে বসলে পরামর্শ হলো, ভাত একটু কম খাওয়া ভালো। ডাল মাংসে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ে। ফল খেলে পটাশিয়াম বাড়ে। মিষ্টি খেলে সুগার বাড়ে। ঝাল খেলে পেটে গ্যাস হয়, ডুবো তেলের খাবার বাদ দেন। রুটি দুটোই যথেষ্ট। শাক সবজি শরীর ভালো রাখে।মিষ্টি, কেক, ফিরনি, পোলাও, রোস্ট এগুলো কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দিবে, সাথে ওজনও বাড়বে।
বিচার-সালিস, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিলে পরামর্শ হলো, কথা একটু কম বললে ভালো হয়।আপনি যদি সব কথা বলেন, বাকিরা কী কথা বলবে?
আপনাদের সময়ই ভালো ছিলো এখন সব ভেজাল। ন্যায় কথার ভাত নেই। শক্তি যার বিচার তার। আপনি পক্ষপাতিত্ব করতে আসছেন। আপনারা কেন এসে ঝামেলা বাড়ান তা বুঝতে পারছি না।
পারিবারিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে পরামর্শ হলো, এতোদিন কোথায় ছিলেন? সমস্যার সমাধান তো করতে পারেন নাই। আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এতো কিছু হয়েছে। এখন কথা বলেন কেন?
পারিবারিক জমি জমা বন্টন করতে গেলে পরামর্শ হলো, আপনার ভালো জমি কেন দরকার? আপনি জমিজমার বিষয় নিয়ে এতো কথা না বললেও পারেন। গ্রামের এইটুকু জমি নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি না করলেই পারতেন। জমিজমা তো আপনার আত্মীয় স্বজনরা খায়, অন্য কেউ এসে ভোগ করে না।
বাজারে গেলে পরামর্শ হলো, মোকামে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, আমরা কী করবো?
দামাদামি করে সদাইপাতি কিনতে পারবেন না।
মাংসে চর্বি হাড্ডি থাকবেই। একদাম, পছন্দ হলে নেন, না হলে যান। এতো বাছাই করে মাল বিক্রি করি না।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিলে আপনার এখন এসবের বয়স আছে? এসেছেন ভালোই হলো আপনাদের মতো লোকজনের দরকার আছে। অফিস আদালতে গেলে, আপনার কাজটা হবে। ধৈর্য ধরেন, একটু সময় লাগবে, তাড়াতাড়ি করলেই হবে না। আপনার আসতে হবে না। একটা ফোন করবেন।
ধর্মীয় কাজে হাজির হলে, পরকালের সঞ্চয় বাড়ান। বাড়ি গাড়ি, দালানকোঠা, সহায় সম্পদ কবরে যাবে না। দুই দিনের বাহাদুরি আমাদের।
হাসান আলী : প্রবীণ বিষয়ে লেখক ও গ্রন্থ প্রণেতা।