প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৫৬
বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমাজকর্মীর ভূমিকা
বার্ধক্য হলো জীবনের শেষ ধাপ। চ্যালেঞ্জ হলো স্বস্তিদায়ক, শান্তিপূর্ণ বার্ধক্য যাপনের বাধা সমূহ। মোকাবিলা হলো বাধা অপসারণের কৌশল। সমাজকর্মী বলতে বোঝায় সমাজের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা পালনকারী। ভূমিকা মানে অবস্থান বা কাজ।
পেশাগত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সমাজকর্মীরা যেসব কৌশল অবলম্বন করে সেটাকে সমাজ কর্মপদ্ধতি বলে। সমাজকর্মীরা ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যার সমাধান, প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে কাজ করে। সমাজকর্মীর সেবা সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ এবং সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
বার্ধক্যের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ শারীরিক সমস্যা। চোখ, দঁাত, কান, কিডনি, ফুসফুস, লিভার, হার্ট, ত্বক, দুর্বল হয়ে কার্যকারিতা কমতে থাকে। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট, উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল, অ্যালার্জি, ক্যান্সার, জয়েন্টে ব্যথা, হাড় ক্ষয়রোগ, হরমোনের সমস্যা ইত্যাদির জন্যে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়।
মানসিক সমস্যাগুলো হলো উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতা, নিদ্রাহীনতা, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি।
স্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমাজকর্মী সংশ্লিষ্ট রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নাম ঠিকানা, হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ঠিকানা, চিকিৎসা ব্যয়, গরীব রোগীর বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ পাবার সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবেন। রোগীকে হাসপাতাল, ক্লিনিকে ভর্তি করে জরুরি চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করার মতো দক্ষতা রাখবেন।
অসহায় দরিদ্র দুঃস্থ রোগীদের হাসপাতালের সমাজসেবা বিভাগ থেকে সরকারি অনুদান পাবার ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং চিকিৎসা ব্যয় মিটানোর জন্যে তহবিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
চিকিৎসা শেষে স্বাভাবিক স্বাধীন জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন। ওষুধ, পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করার জন্যে আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন।
বার্ধক্যে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো থাকা খাওয়া, সেবা-যত্ন পাবার সুযোগ-সুবিধা সঙ্কুচিত হওয়া।
সমাজকর্মী দুঃস্থ অসহায় প্রবীণদের পুনর্বাসনের জন্যে নিঃখরচায় সরকারি-বেসরকারি প্রবীণ নিবাস এবং বৃদ্ধাশ্রমের খেঁাজ খবর সম্পর্কে হালনাগাদ অবগত থাকবেন। টাকার বিনিময়ে প্রবীণ নিবাসে থাকা-খাওয়া সেবা পাবার সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রবীণ নিবাসগুলোর সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখবেন। সমমনা প্রবীণরা একসাথে কিংবা মেস করে থাকতে চাইলে আন্তরিকভাবে সহায়তা করবেন।
তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যক্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থা। একজন প্রবীণ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে নানান রকমের নিপীড়ন, নির্যাতন এবং বৈষম্যের শিকার হন। মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে অধিকাংশ প্রবীণ নির্যাতন-নিপীড়নের কথা প্রকাশ করতে চান না। প্রবীণ বয়সে হত্যা এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি থাকে। টাকা পয়সা, জমিজমা, ঘর বাড়ি, সহায় সম্পদ বেহাত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। স্বাধীনভাবে চলাফেরা, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। সমাজকর্মীর দায়িত্ব হলো, ব্যক্তির নিরাপত্তার ঝুঁকি পর্যালোচনা করে ব্যক্তির জানমাল রক্ষায় আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং ব্যক্তিকে নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম করে গড়ে তোলা।
নানা ধরনের সামাজিক উদ্যোগ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির নিরাপত্তা বোধ বাড়ানো।
চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হলো, প্রবীণের দীর্ঘমেয়াদী পরিচর্যা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, একই সাথে দীর্ঘমেয়াদী পরিচর্যার চাহিদাগুলো প্রবল হচ্ছে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত প্রবীণের দৈনন্দিন কাজগুলো করতে সহায়তাকারীর প্রয়োজন হয়। অতি প্রবীণের জীবনকে স্বস্তিদায়ক ও শান্তিপূর্ণ করতে দীর্ঘ মেয়াদী পরিচর্যার দরকার হয়। এই পরিচর্যা হলো, গোসল-টয়লেট করানো, দঁাত মাজতে সহায়তা, আরামদায়ক পোশাক পরিধানে সহায়তা, পুষ্টিকর খাবার খাইয়ে দেয়া, নিয়মিত ওষুধ সেবন করানো, শরীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, গায়ে লোশন, তেল মাখিয়ে দেয়া, বিছানা পরিষ্কার করে রাখা, চলাচলে সহয়তা করা, চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে আনা নেয়া, পছন্দের জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, বই, সংবাদপত্র পড়ে শোনানো, মোবাইল ফোন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা।
সমাজকর্মী উপরোক্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পরিবার এবং সমাজে ভূমিকা পালন করতে পারেন।
পঞ্চম চ্যালেঞ্জ হলো, প্রবীণের বিনোদন লাভের সুযোগ সৃষ্টি। আমাদের অধিকাংশ মানুষের ধারণা, প্রবীণ মানুষ খাবে দাবে, ঘুমাবে, ধর্মকর্ম করবে, নাতি-নাতনিদের সাথে সময় কাটাবে। বিনোদন যে একজন প্রবীণের মৌলিক চাহিদা এটা খুব কম মানুষই বিবেচনা করতে পারে। জীবনযাপন আর জীবন উপভোগ করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রবীণকে জীবন উপভোগ করার সুযোগ করে দিতে হবে। জীবন উপভোগ করার মধ্য দিয়েই সার্থকতা তৈরি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিনোদন অবস্তুগত সুখ, যা ব্যক্তিকে তৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট করে। বই পড়া, আড্ডা দেয়া, গান শোনা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, দর্শনীয় স্থান দেখা, সমাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, গল্প কবিতা লেখা, নাটক সিনেমা দেখা, বাগান করা, সৃজনশীল কাজে মগ্ন হয়ে থাকা, আত্মীয় স্বজন বন্ধু দের সাথে যোগাযোগ করা, পছন্দের লোকজনের সঙ্গে সময় কাটানো। সমাজকর্মীর দায়িত্ব হলো ব্যক্তিকে বিনোদন লাভের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া এবং পছন্দের কাজে কার্যকর ভূমিকা পালন করা।
ষষ্ঠ চ্যালেঞ্জ হলো, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ কমে যাওয়া। নানা রকমের সামাজিক পরিবর্তনের ফলে প্রবীণদের সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে আসছে। যাদের টাকা পয়সা এবং ক্ষমতার দাপট আছে তারাই বেশিরভাগ সময় সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে কিংবা নেতৃত্ব দেয়। সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রবীণদের অংশগ্রহণ অনেকটাই দুর্বল। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রবীণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সমাজকর্মী ভূমিকা পালন করতে পারেন।
সপ্তম চ্যালেঞ্জ হলো, নিঃসঙ্গতায় ভোগা। ধনী-দরিদ্র সকল প্রবীণই কম-বেশি নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। সঙ্গ লাভ একজন মানুষের অধিকার হিসেবে বিবেচিত হওয়া দরকার। গ্রামের চাইতে শহরের প্রবীণরা নিঃসঙ্গতায় বেশি ভোগেন। নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্ত করতে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের বড়ো ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজ কর্মী এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন।
অষ্টম চ্যালেঞ্জ হলো অ্যাডভোকেসি। মানুষ এখন বিশ্বাস করে, তদবির ছাড়া কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছানো অনেক কঠিন কাজ। প্রবীণদের সুযোগ সুবিধা, দাবি দাওয়া, সুখ-দুঃখ নীতি নির্ধারণকারীদের কাছে পেঁৗছাতে হবে। যে সমস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নীতি নির্ধারণী কাজে নিয়োজিত রয়েছেন কিংবা ভূমিকা রাখেন তাদেরকে প্রবীণবান্ধব কর্মসূচি প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করা সমাজ কর্মীর কাজ। প্রবীণ নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে প্রবীণদের সংগঠিত করে আওয়াজ তুলতে হবে। শিল্প কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গণপরিবহন প্রবীণবান্ধব করে গড়ে তোলার জন্যে সরকারের নিকট প্রতিনিয়ত আবেদন নিবেদন, দাবিদাওয়া করতে হবে।
সমাজকর্মী তার কাজের জন্যে পারিশ্রমিক, সুযোগ সুবিধা পাবেন এবং একই সাথে সম্মান মর্যাদার অধিকারী হবেন।
হাসান আলী : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।