রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

বিতর্ক ও বিতর্কের রকমফের

বিতর্ক ও বিতর্কের রকমফের
উজ্জ্বল হোসাইন

একটি জনসভা বা আইনসভায় একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক আলোচনা, যেখানে বিরোধী যুক্তিগুলো সামনে রাখা হয় এবং যা সাধারণত একটি উপসংহারের মাধ্যমে শেষ হয়। অর্থাৎ বিতর্ক হলো একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে সংগঠিত যুক্তি বা ধারণার প্রতিযোগিতা, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের দুটি বিপরীত পক্ষ বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এবং সেই বিষয়ের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করে। আসলে ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্যে আমি জীবন দিতে পারি’, ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের এই উক্তির আনুষ্ঠানিক চর্চাই করে বিতর্ক।

বিতর্ক কত প্রকার ও কী কী

বিতর্ক নিয়ে যারা কাজ করে তারা অনেকেই বিতর্ক নিয়ে কম-বেশি ধারণা রাখেন। স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই হয়তো সরাসরিভাবেই বিতর্কের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি নিয়মিতই চর্চা হয়। কারণ বিতর্ক হচ্ছে যুক্তি ও তর্কের মাধ্যমে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করা। একটি পূর্ব নির্ধারিত বিষয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করা বিতর্কের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীদের বিতর্কের মাধ্যমে নিজেকে বলার ও জানার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। আসলে বিতর্ক হচ্ছে যুক্তি-তর্কের খেলা। এর মাধ্যমে যুক্তির আয়নায় নিজের ভাবনার প্রতিফলন করা যায়। ফলে আমাদের বাড়ে চিন্তার পরিধি, জ্ঞানের পরিধি, অন্যদিকে প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পরিধি।

অনেকে বলেন, বিতর্কের এতো রকমফের কেনো? যেভাবেই বিতর্ক হোক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তো একই। তারপরও বিতর্ককে দুই ভাগে ভাগ করা যায়--প্রদর্শনী বিতর্ক ও প্রতিযোগিতামূলক বিতর্ক। প্রদর্শনী বিতর্কের আবার ক’টি ভাগ আছে। যেমন : রম্য বিতর্ক, আঞ্চলিক বিতর্ক, প্ল্যানচ্যাট বিতর্ক, জুটি বিতর্ক। প্রতিযোগিতামূলক বিতর্কেও কিছু ভাগ আছে। যেমন : সংসদীয় বিতর্ক, সনাতনী বিতর্ক, বারোয়ারি বিতর্ক ইত্যাদি। তবে ইংরেজি বিতর্কের মাঝে ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি বিতর্ক বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিস ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ বা রাউন্ড রবিনের মতো আন্তর্জাতিক ডিবেট টুর্নামেন্টগুলো মূলত ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি ফরম্যাটেরই হয়ে থাকে।

সনাতনী বিতর্ক : বিতর্কের বেশ প্রাচীন এ ফরম্যাটটি বর্তমানে খুব একটি প্রচলিত না থাকলেও বাংলাদেশের জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক বা স্কুল পর্যায়ের বিতর্কগুলো এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে। বিতর্কের এ ধারায় ব্যাকরণিক জটিলতা অন্য যে কোনো ফরম্যাটের বিতর্ক থেকে যথেষ্ট কম। এখানে একটি নির্ধারিত বিষয়ের ওপর পক্ষ দলের ও বিপক্ষ দলের তিনজন বক্তা (১ম বক্তা, ২য় বক্তা ও দলনেতা) পালাক্রমে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সাধারণত প্রত্যেক বক্তা তার বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যে পাঁচ মিনিট ও গঠনমূলক পর্বের বক্তব্য শেষে উভয় পক্ষের দলনেতারা যুক্তিখণ্ডনের জন্যে অতিরিক্ত তিন মিনিট করে সময় পেয়ে থাকেন। সনাতনী বিতর্ক পরিচালনার দায়িত্বে যিনি থাকেন তাকে ‘সভাপতি’ বা ‘মডারেটর’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এর প্রচলন কমে গেলেও বিতর্কের হাতেখড়ির জন্যে সনাতনী বিতর্ক যথার্থ।

সংসদীয় বিতর্ক : সংসদীয় বিতর্ক হচ্ছে হালের জনপ্রিয় ডিবেট ফরম্যাট। বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক বিতর্কের ক্ষেত্রে সংসদীয় বিতর্কের ব্যবহার সর্বাধিক হারে দেখা যায়। তবে সনাতনী বিতর্কের তুলনার এ বিতর্ক ব্যাকরণগতভাবে বেশ জটিল। উভয়পক্ষের বক্তাদের (প্রধানমন্ত্রী/বিরোধী দলীয় নেতা, মন্ত্রী/উপনেতা, সংসদ সদস্য) প্রত্যেকে এখানেও পাঁচ মিনিট করে সময় পান তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যে। কিন্তু এই পাঁচ মিনিট সময়ের মাঝে কৌশলগতভাবে প্রতিপক্ষ দল পয়েন্ট অব ইনফরমেশন, পয়েন্ট অব অর্ডার বা পয়েন্ট অব প্রিভিলেজের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আঘাত হানার পাশাপাশি নিজেদের জন্যে সুবিধা আদায় করে নিতে পারেন। গঠনমূলক পর্ব শেষে যুক্তিখণ্ডন পর্বে প্রথমে বিরোধী দলীয় নেতা ও সর্বশেষে প্রধানমন্ত্রী তিন মিনিট করে অতিরিক্ত সময় পেয়ে থাকেন। ফরম্যাটের নামই যেহেতু সংসদীয় বিতর্ক, স্বাভাবিকভাবেই পুরো বিতর্কটি যিনি পরিচালনা করবেন তাকে ‘স্পিকার’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি বিতর্ক : এ বিতর্কটি বেশ জটিল। মূলত ইংরেজি বিতর্কের ক্ষেত্রে এ ফরম্যাটটি ব্যবহার করা হয়। তাই আমাদের দেশে এ ফরম্যাটের সাথে অনেকেই পরিচিত না। তবে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি বিতর্কের ক্ষেত্রে নিয়মিত চর্চার পাশাপাশি এ ফরম্যাটটিকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বর্তমানে ‘বাংলা বিপি বিতর্ক’-এর বেশ প্রচলন দেখা যাচ্ছে। এ ফরম্যাটটি মূলত ব্রিটেনের সংসদীয় পদ্ধতির অনুসরণে করা। ব্রিটেনের সংসদে যেমন হাউজ অব লর্ডস আর হাউজ অব কমন্স নামে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, একইভাবে বিপি বিতর্কেও উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ আলাদা আলাদাভাবে থাকে। মোট চারটি দল নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি বিতর্ক হয়ে থাকে। চারটি দল হচ্ছে : সরকার দলীয় উচ্চকক্ষ, বিরোধী দলীয় উচ্চকক্ষ, সরকার দলীয় নিম্নকক্ষ ও বিরোধী দলীয় নিম্নকক্ষ।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি বিতর্কের ক্ষেত্রে বক্তারা সাধারণত সাত মিনিট করে সময় পান বক্তব্য দেয়ার জন্যে। এ বিতর্কে কোনো ধরনের যুক্তিখণ্ডনের জন্যে আলাদা সময় বরাদ্দ থাকে না বিধায় নির্ধারিত সাত মিনিটের মধ্যেই বক্তাকে যুক্তিখণ্ডন করতে হয়। পুরো বিতর্কটি একজন স্পিকার পরিচালনা করেন।

বারোয়ারি বিতর্ক : বিতর্কের শিল্পিত ধারার নাম বারোয়ারি বিতর্ক। এটি মূলত বক্তাকেন্দ্রিক। এ বিতর্কে পক্ষ-বিপক্ষ থাকে না। প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে একক ভাবনায় বিতর্ক করতে পারে। এ কারণেই এটি বিতার্কিকদের জন্যে কঠিন ও সৃজনশীল একটি জায়গা।

বারোয়ারি বিতর্কে বক্তা যেহেতু খুব বেশি স্বাধীন আর বিতর্কের বিষয়কে ভেঙেচুরে যে কোনো রূপ দেয়ার বিষয়ে তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে, তাই ভাল-খারাপের দায়ভারও পুরোটাই তার উপরে বর্তায়। মোট কথা, এটি ব্যক্তিনির্ভর বিতর্ক, দলীয় নয়। চিন্তাজগতের নতুনত্ব ও সৃষ্টিশীলতা এই বিতর্কের প্রাণ। সাধারণত বারোয়ারি বিতর্কের বিষয়গুলো সংসদীয় বা সনাতনী বিতর্কের তুলনায় একটু ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। বারোয়ারি বিতর্ক বলতে গেলে এক ধরনের একক অভিনয়। তবে এখানে বক্তার বক্তব্য হচ্ছে স্ক্রিপ্ট, অভিনয়ের ক্ষেত্র হলো মঞ্চ আর বিতর্কের ক্ষেত্র হলো সামনে থাকা ডায়াস। আবার উপস্থাপনার দিক থেকে আবৃত্তির সাথে অনেক মিল থাকে এ বিতর্কের। অনেকটা শৈল্পিক ধাঁচের হলেও, আর সব বিতর্কের মতো বারোয়ারি বিতর্কেও যুক্তিনির্ভর কথা থাকতে হয়। এখানে কথাগুলো হবে সুচারু শব্দচয়নে গাঁথা ও মনোমুগ্ধকর এবং এর উপস্থাপনা হবে চমকপ্রদ। এ উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য আনতে কণ্ঠের ওঠানামায়, আবেগের কম-বেশিতে কখনো গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নাটকীয়তা ও আবৃত্তির ঢং আসতে পারে। সবশেষে আবৃত্তি, একক অভিনয়, উপস্থিত বক্তৃতা আর বিতর্ক এই চারে মিলে বারোয়ারি বিতর্ক হয় বলে আমরা উপসংহার টানতে পারি।

বারোয়ারি বিতর্কে যেহেতু কোনো দল নেই, সুতরাং এ প্রতিযোগিতায় যে কোনো সংখ্যক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করতে পারে। সাধারণত বারোয়ারি বিতর্কে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর জন্যে তিন থেকে চার মিনিট সময় বরাদ্দ থাকে।

প্রদর্শনী বিতর্ক : প্রদর্শনী বিতর্কগুলোর মাঝে গঠনগত দিক থেকে সাধারণত বিশেষ কোনো নতুনত্ব থাকে না। ব্যাকরণিক জায়গা থেকে প্রদর্শনী বিতর্কগুলো মূলত সংসদীয় ফরম্যাটে হয়ে থাকলেও এসব বিতর্ক দর্শকদের বিনোদন দেয়ার উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হয়ে থাকে। বিতর্কের মতো গুরুগম্ভীর বিষয়ে মাঝে মাঝে আনন্দেরও প্রয়োজন হয় বৈকি!

পৃথিবীর কোনো কিছুই স্থায়ী না, সবকিছুই আপেক্ষিক। বিতর্কও এর বাইরে নয়। তাই সময়ের প্রয়োজনে বিতর্কের ফরম্যাটেও প্রতিনিয়ত এসেছে নানাবিধ পরিবর্তন। তবে প্রচলিত বিতর্কের ফরম্যাটগুলোর মাঝে মোটামুটিভাবে এ কয়টি ফরম্যাটই বর্তমানে বেশি দেখা যাচ্ছে।

উজ্জ্বল হোসাইন : ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন (সিকেডিএফ)।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়