প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২১, ০৮:৩৬
প্রবীণদের যেসব আচরণ মেনে নেয়া কষ্টকর
প্রবীণদের যেসব আচরণ পরিবারের সদস্যরা মেনে নিতে কষ্ট পান, সেসব বিষয় নিয়ে আজকের আলোচনা। প্রবীণ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রবীণদের চাহিদা, সংকট ও চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় তাদের আচরণ কী ধরনের প্রভাব ফেলে তা বুঝতে চেষ্টা করেছি। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করছি।
|আরো খবর
কেস-১ : নাম জাহানারা (ছদ্মনাম), বয়স ৪৫ বছর, পেশা গৃহিণী, শিক্ষা মাস্টার্স। স্বামী সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় বসবাস করেন। তার দুই মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। শাশুড়ি বেশিরভাগ সময় জাহানারার সঙ্গেই থাকেন। মাঝে মধ্যে অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও থাকেন। জাহানারার শাশুড়ির বয়স ৮০ বছর অতিক্রম করেছে। তিনি দৈনন্দিন কাজগুলো কারও সহযোগিতা ছাড়াই করতে পারেন। শাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্ক মোটামুটি ভালো। জাহানারা তার শাশুড়ির একটি আচরণে খুবই বিরক্ত। সেটি হলো, বাসায় আত্মীয়স্বজন এলেই দুঃখ করে বলবেন, ‘আমার ছেলের ঘরে যদি একটা নাতি থাকত। তাহলে আর কোনো দুঃখ থাকত না।’
জাহানারা শাশুড়ির মুখে এসব কথা শুনে বিরক্ত বোধ করে। দুই-একবার মৃদু আপত্তি জানিয়েছে; কিন্তু কোনো ফল হয়নি। জাহানারার দুই মেয়েও দাদির ওপর বিরক্ত। নাতনিরা সামনে থাকলে কিছু বলেন না। সামনে না থাকলে আত্মীয়স্বজনের কাছে নাতি না থাকার দুঃখ করেন।
কেস-২ : নাম আবিদা সুলতানা (ছদ্মনাম), বয়স ৫৫, পেশা সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষা মাস্টার্স। স্বামী আইনজীবী। বনানীতে বসবাস করছেন। আবিদা দুই কন্যাসন্তানের জননী। দুই কন্যাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। শাশুড়ির বয়স ৭৫ বছর, থাকেন আবিদার সঙ্গে। শাশুড়ি কারও ওপর নির্ভরশীল নন। আবিদা অফিসের কাজে খুবই ব্যস্ত থাকেন। সকাল ৯টায় বাসা থেকে বের হয়ে ফেরেন রাত ৮টার দিকে। বাসায় আবিদার শাশুড়ির কাজের লোকদের সঙ্গে যখন-তখন ঝগড়া বাধিয়ে দেন। প্রায়ই কাজের লোক রাগ করে কাজ ছেড়ে দেয়। কাজের লোক সারাদিন কী কী কাজ করেছে তার একটা ফিরিস্তি আবিদা ঘরে পা দিতেই শুরু করেন। আবিদা শাশুড়িকে অনুরোধ করেছেন, কাজের মেয়ে যা করতে পারে তাই করুক। আপনার কোনো কথা বলার দরকার নেই। আমার কাজের লোক ছাড়া চলবে না। এসব হাল্কা কথায় আবিদার শাশুড়ি দমে যাননি। তিনি কাজের লোকের সঙ্গে তর্কবিতর্ক অব্যাহত রেখেছেন।
কেস-৩ : নাম সহিদুল, বয়স ৪২, পেশা ব্যবসা। দুই পুত্রসন্তানের জনক। স্ত্রী গৃহিণী। বাবা-মা সহিদুলের সঙ্গে থাকেন। বাবার বয়স ৭২ বছর, মায়ের বয়স ৬৭ বছর। তারা দুইজনই অত্যন্ত ধার্মিক। সহিদুল বাবা-মার খোঁজখবর নেন। তাদের প্রয়োজনকে খুবই গুরুত্ব দেন। সহিদুলের বাবা-মা দুইজনই তার ওপর বিরক্ত। কারণ চিকিৎসার ব্যাপারে সহিদুল যথাযথ গুরুত্ব দেন না। সহিদুলের ভাইবোনরা এজন্য ভীষণ বিরক্ত। সহিদুলের বক্তব্য হলো, তিনি সবসময় বাবা-মাকে ডাক্তার দেখান, ওষুধপত্র কিনে দেন। কিন্তু এতে তারা সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। সহিদুল বাবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করেন। ব্যবসা রেখে যখন তখন বাবা-মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারছেন না। ভাইবোনদের মধ্যে সহিদুল সবার ছোট এবং আর্থিকভাবে দুর্বল। ভাইবোনরা মাঝে মধ্যে টাকা-পয়সা দেয় এবং এ নিয়ে আবার খোঁটাও দেয়। সহিদুলের স্ত্রী শ্বশুর-শাশুড়ির সেবায় আন্তরিক, তারপরও সন্তুষ্ট করতে পারছেন না।
কেস-৪ : নাম রফিক, বয়স ৫০, পেশা ব্যাংকার। এক ছেলে দুই মেয়ে। বসবাস করেন গ্রীন রোডে। স্ত্রী গৃহিণী। বাবা-মা থাকেন তার সঙ্গে। রফিকের বাবা সরকারি চাকরি থেকে ১২ বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন। বাবা-মা দুইজনেরই উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ রয়েছে। মায়ের অ্যাজমার সমস্যা রয়েছে। রফিকের বাবা-মা দুইজনই ভোজনরসিক। খাবার-দাবারের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। খাবার একটু খারাপ কিংবা কাক্সিক্ষত স্বাদ না হলে চরম বিরক্তি প্রকাশ করেন। তাদের ধারণা, উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার শরীরকে কর্মক্ষম রাখবে। রফিকের বাবা নিজেই বাজার করেন। প্রতিদিন বাজার থেকে এসেই কোনটার কত দাম তা বলতে থাকেন। জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে, এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একসময় ১০০ টাকা বাজারে নিয়ে গেলে দুই ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র কিনে আনতে পারতেনÑ এসব বলে আক্ষেপ করতে থাকেন। রফিকের স্ত্রীকে ডেকে কী কী রান্না কীভাবে হবে তার বায়ন দেন। অতীতের ভুল-ভ্রান্তির জন্য তিরস্কার করেন। রফিকের বাবা-মাকে ডাক্তার পরিমিত খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। তারা দুইজনই ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করেন। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। রফিকের স্ত্রী এবং কাজের লোককে কারণে-অকারণে বকা দেন। কেস-৫ : নাম মাহবুব, বয়স ৫৬, পেশা ব্যবসা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণে মাস্টার্স করেছেন। দুই ছেলে এক মেয়ে। মাহবুবের স্ত্রী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ব্যবসা মোটামুটি ভালোই চলছে। মাহবুবের বাবার বয়স ৮০ বছর, মায়ের ৭২ বছর। দুইজনই তার কাছে থাকেন। মাহবুবের ছেলেমেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মাহবুবের বাবা প্রায় প্রতিদিনই নাতি-নাতনিকে নামাজ পড়ার জন্য তাগিদ দেন। নামাজ না পড়লে বকাবকি করেন। ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসরণ করার জন্য উপদেশ দেন। নাতি-নাতনিদের বন্ধু-বান্ধবকে সন্দেহের চোখে দেখেন। বাসায় ওদের বন্ধু-বান্ধব এলে নানা ধরনের প্রশ্ন করেন। নাতিদের ঘরের দরজা বন্ধ থাকলে বিরক্তি প্রকাশ করেন। লেখাপড়ার অগ্রগতি নিয়ে চরম হতাশা ব্যক্ত করেন। ভবিষ্যতে কত ধরনের দুর্গতি কপালে আছে তার ফিরিস্তি দেন। মাহবুবের বাবা মাহবুবকে বকেন ছেলেমেয়েদের সঠিক শাসন না করায়।
কেস-৬ : নাম আসমা, বয়স ৪৮, পেশা গৃহিণী, তিন মেয়ের জননী। স্বামী মারা গেছেন ২ বছর আগে। বড় দুই মেয়ে চাকরি করে। ছোট মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আসমার মা থাকেন তার সঙ্গে। মায়ের বয়স ৭৪ বছর। আসমারা তিন ভাই এক বোন। বাবা মারা গেছেন কম বয়সে। মা অন্য ভাইদের সঙ্গে থাকতে পারেন না। আসমা মাকে অনেক ভালোবাসেন; কিন্তু মাকে কোনো কথা শোনাতে পারেন না। খাওয়া-দাওয়ায় সতর্ক হতে বললে তিনি খাওয়া বন্ধ করে দেন। জেগে থাকলে তিন ছেলে এবং ছেলে বউদের নিন্দা করেন। মোবাইল ফোনে আত্মীয়স্বজনের কাছে নালিশ করেন। অতীতের তিক্ত ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে আনন্দ পান। কাউকে অপমান করতে একটুও ভাবেন না। টাকা-পয়সা নিজের হেফাজতে রাখতে পছন্দ করেন। বাড়িতে জমিজামার আয়-ব্যয় নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে তর্কবিতর্কে লিপ্ত হন। আসমার মা নিজের দুঃখ বলতে পছন্দ করেন।
উপরে ছয়টি ঘটনা থেকে আমরা কতকগুলো বিষয় বুঝতে পারব। সেগুলো হলোÑ প্রবীণরা বাজারের জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানো, নিকটতমদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ, চিকিৎসার ব্যাপারে অনেক বেশি সতর্ক, ঝুঁকিপূর্ণ খাবার গ্রহণের মানসিকতা, অন্যের ওপর মতামত চাপিয়ে দেয়া, নিজের প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দেয়া, পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা ইত্যাদি। শুধু প্রবীণ হলেই হবে না, একজন মানবিক বুদ্ধিমান প্রবীণ হতে হবে। যিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তিনি প্রবীণ জীবনকে ততখানি আনন্দদায়ক করতে পারবেন। প্রবীণদের মনে রাখতে হবে, সময়ে অনেক কিছু পাল্টে যায়, নতুন নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। প্রস্তুতি নিতে হবে যৌবনেই। যে প্রবীণ যৌবণে ধূমপান, মাদক গ্রহণ, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেছেন তাদের প্রবীণ জীবনে শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখা খুবই কঠিন ব্যাপার। যৌবনে যে প্রবীণ স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন না, বার্ধক্যে তার স্বাস্থ্যহানি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। যে নবীন যৌবনে আয়ের একটি অংশ প্রবীণ জীবনের জন্য সঞ্চয় করেননি, তিনি বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়বেন। যৌবনে যেসব মানুষ সামাজিক কর্মকা-ে কম অংশ নেবে এবং আত্মকেন্দ্রিক বন্ধুবান্ধবহীন জীবন কাটাবেন তাদের বার্ধক্যে নিঃসঙ্গতায় ভোগার সম্ভাবনা থাকবে। যৌবনে সহযোগিতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা এসব গুণ অর্জন করতে না পারলে তিনি নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে দিন অতিবাহিত করতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হবে। খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ তৈরি হলে শরীর সুস্থ থাকবে। কথা বলার ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ তৈরি করলে নিজে সুখী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অহেতুক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, সংশয় তৈরি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে লাভ হয় না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে সহজ-স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলে নিজের লাভ বেশি। কাউকে নিখুঁত ভাবার সুযোগ নেই।
পরামর্শ-উপদেশ কেউ না চাইলে স্বপ্রণোদিত হয়ে উপদেশ-পরামর্শ দেয়া ঠিক হবে না। সবকিছুতেই নিজের সম্পৃক্ততা কিংবা নিয়ন্ত্রণ আশা করা ঠিক হবে না। কাউকে ছোট করার বা হেয়প্রতিপন্ন করার মনমানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারা বড় ধরনের মানবিক গুণ। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবকে সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা অব্যাহত রাখলে সম্পর্ক নিবিড় হবে। কারও উপকার করে সেটা লোকজনকে বলে বেড়ানো এক ধরনের হীনম্মন্যতা ছাড়া আর কিছু নয়। একজন প্রবীণকে স্বস্তিদায়ক শান্তিপূর্ণ প্রবীণ জীবন নিশ্চিত করতে ওপরের বিষয়গুলোকে অবশ্যই খেয়াল করতে হবে। লেখক : সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম