মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কচুয়ায় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ
  •   নির্মাণের এক বছর না যেতেই ফরিদগঞ্জ কেন্দ্রীয় মডেল মসজিদের বেহাল দশা
  •   শেষ হলো পদ্মা-মেঘনায় জাল ফেলার নিষেধাজ্ঞা
  •   ফরিদগঞ্জে প্রবাসীর স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার
  •   মোবাইল ব্যবহারে নিষেধ করায় শিশু শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৩, ১৮:৫১

কোরবানী ও আকিকা: প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা

মুফতি মাওলানা মোঃ জাফর আলী
কোরবানী ও আকিকা: প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। ইবাদতের মাঝে দু’টি ধাপ রয়েছে। কিছু ইবাদত রয়েছে শারীরিক এবং কিছু রয়েছে আর্থিক। কোরবানী ও আকিকা আর্থিক ইবাদত। এ দু’টি কেবল অর্থ-সম্পদের মালিকদের জন্য আবশ্যক।

কোরবানী: এর শাব্দিক অর্থ নৈকট্য লাভ করা, নৈকট্য লাভের উপায় হিসেবে যে কোন বস্তু ব্যবহার করা ইত্যাদি। পরিভাষায়, নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট পশু জবাই করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি হাসিল করাই কোরবানী।

কোরবানীর গুরুত্ব: সামর্থ্যবান মুসলমানের উপর কোরবানী ওয়াজিব। এটি আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর স্মৃতি বিজড়িত এক মহান ইবাদত। এটি নিছক গোশত খাওয়ার কোন পর্ব নয়। হাসি-তামাশা বা খোশ-গল্পের মাধ্যমে অপচয়ের উৎসব নয়। এর মধ্যে বান্দার জন্য অফুরন্ত কল্যাণ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর কোরবানীর পশুসমূহকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।” (সূরা হাজ্জ: ৩৬)

ইবরাহীম (আঃ)-এর মাধ্যমে এর প্রচলন শুরু হলেও পরবর্তীদের জন্য অদ্যাবধি এর ধারা অব্যাহত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর আমি তাঁর (ইসমাঈল আঃ) পরিবর্তে জবাই করার জন্য দিলাম একটি মহান কোরবানী এবং এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম।” (সূরা সফফাত:১০৭-১০৮)

আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, “আপনি আপনার প্রতিপালকের নামে কোরবানী করুন।” (সূরা কাউসার:২)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইসলামের একটি মহান নিদর্শন ও সুন্নাতে ইবরাহীম (আঃ) হিসেবে প্রতি বছর মদীনায় কোরবানী আদায় করেছেন এবং সাহাবীগণও নিয়মিভাবে এটি আদায় করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহ্র সামর্থ্যবানদের মাঝে এটি চালু রয়েছে। এটি কিতাব ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত (উম্মতের ঐকমত্য) দ্বারা সুপ্রমাণিত। (মিরআত: খ. ৫, পৃ. ৭১) সুতরাং এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

কোরবানীর উদ্দেশ্য: আমাদের সকল কাজের পেছনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। যে কোন ইবাদত পালনের ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্যহীন ও যাচ্ছেতাইভাবে করার মাঝে ফায়েদা নেই। মহান ইবাদত কোরবানীর পেছনেও সুমহান উদ্দেশ্য রয়েছে। সেটি হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কেবল লোক দেখানো অথবা গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কোরবানী নয়; যদি এমনটি হয় তবে এর কারণে মহান ইবাদতটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “কোরবানীর পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর নিকটে পৌঁছে না। বরং তাঁর নিকটে পৌঁছে কেবল তোমাদের তাকওয়া বা খোদাভীতি।” (সূরা হাজ্জ:৩৭) কার কোরবানির পশু কত মোটা-তাজা অথবা বেশি দামী সেটা দেখার বিষয় নয়, বরং কার অন্তরে তাকওয়ার পরিমাণ কতটুকু সেটাই কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

কোরবানীর ফজীলত: সুন্নতে ইবরাহীম (আঃ) হিসেবে আমাদের মাঝে প্রচলিত মহান ইবাদত কোরবানী। এতে সীমাহীন ফজীলত রয়েছে। কোরবানীর দিন আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও পছন্দনীয় কাজ হলো পশুর রক্ত প্রবাহিত করা। হাদীস শরীফে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “কোরবানীর দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় আমল আল্লাহর নিকট আর কিছু নেই। ঐ ব্যক্তি (কোরবানীদাতা) কিয়ামতের দিন কোরবানীর পশুর শিং, লোম ও ক্ষুরসমূহ নিয়ে উপস্থিত হবে। আর কোরবানীর রক্ত জমিনে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদার স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানী দ্বারা নিজেদের নফসকে (আত্মা) পবিত্র কর।” (সুনান তিরমিযী, হাদীস ন. ১৪৯৩)

যাদের উপর কোরবানী ওয়াজিব: ধনী-গরিব সকলের উপর সমানভাবে কোরবানী ওয়াজিব নয়, বরং কেবল ধনীদের উপর কিছু শর্ত সাপেক্ষে এটা ওয়াজিব। শর্তগুলো হলো প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ এবং ১০ জিলহজ্জ হতে ১৩ জিলহজ্জের সূর্যাস্তের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা অথবা সমমূল্যের টাকা-পয়সা) মালের মালিক ও মুসলমান হওয়া।

কোরবানীর নিসাব পরিমাণ মাল যাকাতের মতো এক বছরকাল মালিকের হাতে থাকা শর্ত নয়; বরং কোরবানীর দিনগুলোতে হাতে থাকলেই কোরবানী ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে‘, খ. ৪, পৃ. ১৯৬; রদ্দুল মুহতার, খ. ৬, পৃ. ৩১২)

কোরবানীর পশু: নিজের ইচ্ছা মতো যে কোন পশু দিয়ে কোরবানী দেওয়া যাবে না; বরং শরীয়ত নির্ধারিত পশু দিয়ে কোরবানী দিতে হবে। কোরবানীর পশু তিন প্রকার: উট, গরু ও ছাগল। দুম্বা ও ভেড়া ছাগলের অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেকটি নর ও মাদী। এগুলোর বাইরে অন্য পশু দিয়ে কোরবানী করার প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) থেকে পাওয়া যায় না। (মিরআত, খ. ৫, পৃ. ৮১; ফিকহুস সুন্নাহ, খ. ২, পৃ. ২৯) এ কারণে গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কোরবানী করা জায়েজ নয়। (কাযীখান, খ. ৩, পৃ. ৩৪৮) মহিষ দিয়েও কোরবানী দেওয়া যাবে, এটা গরুর অন্তর্ভুক্ত।

কোরবানীর পশুর বয়স: যে কোন বয়সের পশু দিয়ে কোরবানী দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে শরীয়ত একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেমন, উটের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫ বছর এবং গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ বছর পূর্ণ হওয়া (এর কম হলে কোরবানী বৈধ হবে না) আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১ বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত। তবে ৬ মাস বয়সী ভেড়া ও দুম্বা যদি এমন মোটা-তাজা হয় যে, সেটা দেখতে ১ বছর বয়সী মনে হয়; তবে সেটা দিয়ে কোরবানী দেওয়া জায়েজ।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “তোমরা দুধ দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁত ওঠা (মুসিন্নাহ তথা দু’বছর বয়সী) পশু ব্যতীত জবাই করো না। তবে কষ্টকর হলে এক বছর পূর্ণকারী ভেড়া (দুম্বা বা ছাগল) কোরবানী করতে পারো।” (মুসলিম, মিশকাত, হাদীস ন. ১৪৫৫)

কয়েক জন শরীক হয়ে কোরবানী দেওয়া: কোরবানীর পশুতে শরীক নির্ধারণ করা জায়েজ আছে। তবে ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা একটি এক জনের পক্ষ থেকে কোরবানী দিতে হবে। এগুলোতে কয়েকজন মিলে কোরবানী দিলে জায়েজ হবে না। উট, গরু এবং মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাত জনের অধিক শরীক হলে কারো কোরবানী সহীহ হবে না। (কাযীখান, খ. ৩, পৃ. ৩৪৯; বাদায়ে‘উস সানায়ে‘, খ. ৪, পৃ. ২০৭-২০৮) গরু, মহিষ ও উটে এক জন এক ভাগের কম দিয়ে শরীক হতে পারবেন না।

কোরবানী না করার পরিণতি: সামর্থ্যবানদের উপর কোরবানী ওয়াজিব। সামর্থ্যবানদের এটি পালন করা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিরত থাকা গুনাহের কাজ। কোরবানীর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেউ কোরবানী না করলে তাকে হাদীস শরীফে কঠোরভাবে তিরস্কার করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানী করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়। (সুনান ইবন মাজাহ, হা. ন. ৩১২৩ )

আকিকা: আকিকা মানে কাটা, ছিন্ন করা ইত্যাদি। সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিকল্পে পশু জবাই করাকে আকিকা বলে। আকিকা করা সুন্নত। এর সাথে সন্তান বন্ধককৃত। এর দ্বারা সন্তানের বিপদ-আপদ দূর হয়। সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে সম্ভব না হলে পরবর্তী সপ্তম দিনে অথবা জীবনের যে কোন পর্যায়ে আকিকা করা যাবে। এমনকি নিজের আকিকা নিজে করা যাবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজেই নিজের আকিকা করেছেন।

কোরবানীর সাথে আকিকা: আমাদের মধ্যে অনেকেই কোরবানীর সাথে আকিকা দিয়ে থাকেন। আলাদাভাবে আকিকার পশু ক্রয় না করে কোরবানীর পশুতে অংশ হিসেবে আকিকা দিয়ে থাকেন।

কোরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কোরবানী ও আকিকা দুটোই সহীহ হবে। (রদ্দুল মুহতার, খ. ৬, পৃ. ৩৬২)

কোরবানী ও আকিকা দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সকল ইবাদত কবুলের জন্য অন্যতম শর্ত হলো, ইখলাস (একনিষ্ঠতা) ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অনুসরণ (তাঁর দেখানো পন্থায় পালন করা)। তাই লোক দেখানো মনোভাব বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কোরবানী করা উচিত। সুতরাং কোরবানীর পশুর গলায় ছুরি চালানোর পাশাপাশি নিজের লোভ-লালসা, হিংসা, গীবত, মিথ্যাচার, সুদ, ঘুষসহ যাবতীয় কুরিপুর মূলে ছুরি চালাতে হবে। তবেই কোরবানীর যথার্থতা পাওয়া যাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে উত্তম তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), রামপুর আদর্শ আলিম মাদরাসা, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়