প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
রমজানের আগাম প্রস্তুতিতে বিশ্বনবির ঐতিহাসিক ভাষণ
মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম
মসজিদে নববি। সাহাবিগণের পদভারে ঠাসা। কানায় কানায় পরিপূর্ণ। হঠাৎ নড়ে ওঠল নবিজির হুজরার পর্দা। এগিয়ে এলেন বিশ্বনবি (স)। শাবান মাস শেষের দিকে। আজ রমজান মাসের আগের জুমা। সকলের মাঝে এক জান্নাতি আমেজ। সকলের হৃদয়-মন জুড়ে রমজানের প্রস্তুতি। নবিজির উপস্থিতিতে ছড়িয়ে পড়ল পিনপতন নীরবতা। নবিজি মিম্বরে আরোহণ করলেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে দিলেন এক ঐতিহাসিক ভাষণ। তাবৎ মুসলিম উম্মাহর জীবনে সে ভাষণ বহন করে চলেছে সোনালি তাৎপর্য। হাদিসের পাতা থেকে সে ভাষণই হুবহু তুলে ধরা হলো পাঠকের উদ্দেশ্যে-
|আরো খবর
হজরত সালমান ফারেসী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, শাবান মাসের শেষ দিনে রাসুলুল্লাহ (স) আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে লোকসকল! একটি মহিমান্বিত মাস তোমাদেরকে ছায়া হয়ে ঘিরে ধরেছে। এ মাস একটি বরকতময় মাস। এটি এমন এক মাস, যার মধ্যে একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। আল্লাহ এ মাসের সিয়াম ফরজ করেছেন আর নফল করে দিয়েছেন রাতের কিয়ামকে। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল আমল করবে, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করে, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ সম্পাদন করল। এ মাস সবরের (ধৈর্যের) মাস; আর সবরের প্রতিদান জান্নাত। এ মাস সহমর্মিতার। এটি এমন এক মাস যাতে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তা তার গুনাহ মাফের কারণ হবে। হবে জাহান্নামের অগ্নিমুক্তির উপায়। তার সাওয়াব হবে রোজাদারের সমান। অথচ রোজাদারের সাওয়াব একটুও কমানো হবে না।
আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের সকলে তো রোজাদারের জন্য ইফতারির আয়োজন করতে সমর্থ নয়। জবাবে রাসুলুল্লাহ (স) বললেন, এ সাওয়াব আল্লাহ তায়ালা ঐ ইফতার পরিবেশনকারীকেও প্রদান করেন, যে একজন রোজাদারকে এক চুমুক দুধ, একটি খেজুর অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে ইফতার করায়। আর যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে পেট ভরে খাইয়ে পরিতৃপ্ত করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে আমার হাউজে কাউসার থেকে এভাবে পরিতৃপ্ত করবেন, যার পর সে জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্বে আর পিপাসার্ত হবে না। এমনকি সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটি এমন এক মাস, যার প্রথম অংশে রয়েছে রহমত, মধ্য অংশে মাগফিরাত, শেষাংশে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত। যে ব্যক্তি এ মাসে তার অধীনস্তদের ভার-বোঝা সহজ করে দেবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন। (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ১৯৬৫; আত তারগীব ৫৮৯; ইবনু খোযায়মা ১৮৮৭; শুয়াবুল ঈমান ৩৩৩৬)
পবিত্র মাহে রমজান সমুপস্থিত। রহমত, বরকত ও নাজাতের রমজান আমাদের চেতনার দুয়ারে কড়া নাড়াচ্ছে। আর ক’দিন পরই মাহে রমজান। রমজানের আগমনে মুমিন বান্দামাত্রই আনন্দ প্রকাশ করে থাকেন। আর আনন্দিত হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। রাসূলে করিম সা. নিজেও রমজানের আগমনে অতিশয় আনন্দিত হতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে রহমত-বরকত ও কল্যাণ বর্ষণ এবং অবতরণের উপলক্ষ্য ও অনুষঙ্গগুলোর কারণে ব্যাকুল হতেন। সাহাবিদের বলতেন, তোমাদের দ্বারে বরকতময় মাস রমজান এসেছে। (নাসায়ি, হাদিস ২১০৬)
রমজানের কল্যাণ লাভ মুমিনের পরম সৌভাগ্যের বিষয়। তাই রমজান মাস আসার আগেই মুমিন-মুসলিমরা এর ফজিলত হাসিলের জন্য নিজেকে তৈরি করে থাকেন।
মহানবি সা. রমজানের দু’মাস আগে থেকেই রমজানপ্রাপ্তির জন্য দোয়া করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বরকত দান করুন। আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ (শুয়াবুল ঈমান, ৩৮১৫)
রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে মহানবি সা. শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, ‘নবি করিম সা. (প্রায়) পুরো শাবান মাসই নফল রোজা পালন করতেন। (মুসলিম, ২৭৭৯)
তবে রমজানের দু’-এক দিন আগে থেকেই মহানবি সা. রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। তবে কেউ আগে থেকে রোজা রাখায় অভ্যস্থ হয়ে গেলে তার বিষয়টি আলাদা। হজরত আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে মহানবি সা. বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন রমজানের এক দিন বা দু’দিন আগে রোজা না রাখে। তবে আগে থেকে এ দিনে রোজা রাখায় কেউ অভ্যস্থ হয়ে গেলে সে ওই দিনও রোজা রাখতে পারে।’ (বুখারি, ১৮১৫)
রমজান রহমত, বরকতময় ও নাজাতের মাস। পুণ্য হাসিলে এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর কিছু হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘রমজান মাস এমন একটি মাস, যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে। যে কিতাবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই হেদায়াত ও সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত। যা সঠিক পথ দেখায়, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেয়। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই মাস পাবে, সে যেন এ মাসে অবশ্যই রোজা রাখে।’ (সুরা আল বাকারা, ১৮৫)
নবি করিম সা. ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাস এলেই জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানদেরকে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়।’ (মুসলিম, ১০৭৯) আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত। মহানবি সা. বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসে রাতে ও দিনে জাহান্নামিদের মুক্তি দিয়ে থাকেন। এভাবে রমজানের প্রতিদিন ও রাতে মুসলমানের দোয়া কবুল করা হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, ৬৬৪)
আল্লাহর কোনো বান্দা যদি নেক উদ্দেশ্যকে অন্তরে ধারণ করে আর সঠিক নিয়তের সাথে উত্তম পন্থায় কর্মসম্পাদন করে, আল্লাহ তার সেই আমলকে কখনও বরবাদ করে দেন না; বরং সেটি সাদরে গ্রহণ করে তার যথাযথ পুরস্কার দিয়ে থাকেন। তাকে সেই কাজ করার ধৈর্য, সততা ও একনিষ্ঠতা দান করে থাকেন।
সামনে এমন এক মাস, যে মাসের একটি রাতকে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। যে মাসের যেকোনো পুণ্য ও কল্যাণময় কাজের পুরস্কার বহু গুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ মাসের নফল ইবাদত অন্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান। আর একটি ফরজ ইবাদতের সাওয়াব সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান করে বান্দার আমলনামায় লিখে দেওয়া হয়। তাই এ মাসকে ইবাদতে ভরিয়ে দিতে হবে। তবেই মিলবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। সে সন্তুষ্টির কথা তিনিই বলেছেন।
রোজার পুরস্কার সম্পর্কে মহানবি সা. বলেন, ‘এই রমজানে মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। তবে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কিন্তু রোজার বিষয়টি একেবারেই ব্যতিক্রম। কেননা রোজা শুধু আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো।’ (মুসলিম, ১৫৫১)
মুমিনের ইবাদত হবে সার্বক্ষণিক। সে সবসময় আল্লাহর রহমতের দিকে তাকিয়ে থাকবে। উত্তম সময়গুলোকে বেশি করে কাজে লাগাবে। আল্লাহ তায়ালা তার বিশেষ অনুগ্রহে বান্দাকে এমন কিছু সময় উপহার দিয়েছেন, যার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বান্দা সম্মানের উচ্চ মাকামে পৌঁছে যেতে পারে। তেমনি একটি মাস রমজান। ইবাদতে পূর্ণতা লাভে বান্দার এক অনন্য সুযোগ। অন্যান্য মাসে ইবাদত তো করবই তেমনি এ মাসটির বিশেষ মর্যাদাকে নিজের জীবনে অবশ্যই কাজে লাগাব। তাই রমজান আসার আগেই এ মাসের কল্যাণ হাসিলের মানসিকতায় নিজেকে বলীয়ান করব। বেশি বেশি দোয়া, দরূদ, তাওবাহ-ইসতিগফার ও ইসলামি জীবন-যাপনের মাধ্যমে রোজার শিক্ষাকে নিজের জীবনে ধারণ করব। তাহলে চাইলেও শয়তান আপনাকে দিয়ে আর পাপ কাজ করাতে পারবে না। কারণ আপনি আল্লাহর হয়ে গেছেন। আর যে আল্লাহর হয়ে যায় তার ক্ষতি করার সাধ্য কারও নেই।
রমজান মাসের ফজিলত হাসিলের জন্য নিজের মনের অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। আমলের খাতায় উত্তম আমলগুলো একের পর এক যোগ করতে হবে। আমলগুলো আল্লাহর কাছে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যেখানে নিয়তে কোনো গড়বড় থাকবে না। উদ্দেশ্য একটিই, আল্লাহকে রাজি-খুশি। তাই এখনি সংকল্প করুন, নিজের জীবনটাকে আল্লাহর বিধানের বাইরে নিয়ে যাবেন না। তবে আপনার রমজান আপনার জন্য অমর শিক্ষা রেখে যাবে। আল্লাহর দেওয়া ঘোষণা আপনার জন্য পূর্ণ করা হবে। রমজান চলে যাওয়ার পরও এই অনুশীলন আপনি ভুলে যাবেন না। রমজান মাসে আপনার গুনাহ মাফের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকবে ঠিকই। এ ক্ষেত্রে আপনি সফলও হবেন, অন্য দিকে রমজান আপনাকে পূর্ণ ঈমানের অধিকারী সাচ্চা মুসলিম বানিয়ে দেবে। কাজে আপনার সততা থাকবে।
হারামের ধারে কাছেও যাবেন না। এমনকি আল্লাহর বিধানের লঙ্ঘনও করবেন না। আপনার মহব্বত থাকবে সত্য ও সুন্দরের প্রতি। পুণ্যের দিকে। এই মানসিক অবস্থায় যখন আপনি চলে যাবেন, আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবেন না। আল্লাহর অসীম দয়ায় আপনার নাজাতও মিলে যাবে।
আল্লাহর রহমত কে না চায়? জানবেন, তিনি ছাড়া মানুষকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা অন্য কারো নেই। হয়তো এই সূক্ষ্ম কথা আপনি বুঝতে পারছেন না। আপনার চাওয়া আল্লাহর বিধানের অনুরূপ হয়নি বিধায় তিনি আপনার মনের ইচ্ছাকে পূরণ করছেন না। তাই বলে ভেঙে পড়া, নিরাশ হওয়া যাবে না। মনে রাখবেন, আল্লাহ অবশ্যই সেই ক্ষমতা রাখেন, যিনি অতীতের ঘাটতি ও বর্তমানের পূর্ণতার সমন্বয়ে বান্দাকে অগণিত দান করতে পারেন। রমজানকে সামনে রেখে মনের চাওয়াকে আরও প্রশস্ত করতে হবে। এর সাথে থাকবে উত্তম আমলের সুন্দর মানসিকতা। তাই আপনার ইবাদতগুলোকে আল্লাহর সামনে এমনভাবে পেশ করতে হবে যে, ইবাদতে কোনো ধরনের শিরক থাকবে না। নিজের অন্তর হিংসাবিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকবে। তাহলে রোজা অবশ্যই নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে।
রমজান আসার আগে থেকেই নিজেকে গুছিয়ে নিন। ধরে নেবেন, এটিই আপনার জীবনের শেষ রমজান। তাই আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ থাকবে, হে আল্লাহ, তুমি আমাকে এই রমজানের ফজিলত হাসিলের তওফিক দাও। আমার ইবাদতগুলো যেন এমন হয় যে, ইবাদত হবে তোমারই দাসত্ব।
লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স। ০১৭১১ ৩৩৩৯৯৬