শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

রোজার ফজিলত ও গুরুত্ব

মুফতি মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক

রোজার ফজিলত ও গুরুত্ব
অনলাইন ডেস্ক

রোজা ফারসি শব্দ। আরবিতে সওম। বহুবচনে সিয়াম। সাওম বা সিয়ামের বাংলা অর্থ বিরত থাকা। রোজা ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের তৃতীয়। ২য় হিজরির শাবান মাসে মদিনায় রোজা ফরজ হয়।

ঈমান, নামাজ ও জাকাতের পরই রোজার স্থান। পরিভাষায়, সাওম বলা হয়, প্রত্যেক সজ্ঞান, বালেগ মুসলমান নর-নারী সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজাভঙ্গকারী সকল কাজ থেকে বিরত থাকা। সুতরাং রমজান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, মুকিম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েজ-নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা নারীর উপর পূর্ণ রমজান রোজা রাখা ফরজ। পবিত্র কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের আগের লোকেদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিলো, যাতে তোমরা মুত্তাক্বী হতে পারো। (সূরা বাকারা-১৮৩)

মহান আল্লাহ এই উম্মতের ঈমানদারগণকে সম্বোধন করে বলেন, তারা যেন সিয়াম পালন করে। সিয়ামের অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে খাঁটি নিয়াতে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস হতে বিরত থাকা। এর উপকারিতা এই যে, এর ফলে মানবাত্মা পাপ ও কালিমা থেকে সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার ও পবিত্র হয়ে যায়। এর সাথে সাথেই মহান আল্লাহ বলেন, এই সিয়ামের হুকুম শুধুমাত্র তাদের ওপরেই হচ্ছে না, বরং তাদের পূর্ববর্তী উম্মতের প্রতিও সিয়ামের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। এই বর্ণনার উদ্দেশ্য এটাও যে, উম্মতে মুহাম্মাদী যেন এই কর্তব্য পালনে পূর্বের উম্মতদের পিছে না পড়ে।

অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন, সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। (সূরা বাকারা-১৮৫)।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন তোমরা (রমজানের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা রাখবে আর যখন (শাওয়ালের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা বন্ধ করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে ত্রিশ দিন রোজা রাখবে। - সহীহ বুখারী, হাদিস : ১৯০৯; সহীহ মুসলিম, হাদিস : ১০৮০ (১৭-১৮)

কোরআনের আয়াত ও হাদিসের আলোকে প্রমাণিত, রমজানের রোজা রাখা ফরজ। রমজানের রোজা ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দেওয়া গুনাহের কাজ। এজন্য কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। হাদিস শরীফে ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ত্যাগকারী ও ভঙ্গকারীর জন্য কঠিন শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।

হযরত আবু উমামা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমি ঘুমিয়েছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম আমার নিকট দুই ব্যক্তি আগমন করল। তারা আমার বাহুদ্বয় ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে এলো। তারপর আমাকে বললো, আপনি পাহাড়ের উপর উঠুন। আমি বললাম, আমি তো উঠতে পারবো না। তারা বললো, আমরা আপনাকে সহজ করে দিবো। আমি উপরে উঠলাম। যখন পাহাড়ের সমতলে পৌঁছালাম, হঠাৎ ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, এসব কিসের আওয়াজ? তারা বললো, এটা জাহান্নামীদের আর্তনাদ। তারপর তারা আমাকে নিয়ে এগিয়ে চললো। হঠাৎ কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদেরকে তাদের পায়ের মাংসপেশী দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের মুখের দুই প্রান্ত ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে এবং তা থেকে রক্ত ঝরছে। আমি বললাম, এরা কারা? তারা বললো, যারা ইফতারের সময় হওয়ার আগেই রোজা ভেঙ্গে ফেলে।- সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস : ১৯৮৬; সহীহ ইবনে হিববান, হাদিস : ৭৪৪৮; সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদিস : ৩২৮৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস-১৬০৯; তবারানী, হাদিস : ৭৬৬৬।

রমজান মাসের রোজা না রাখলে মানুষ গুনাহগার হয় এবং ওই একটি রোজার পরিবর্তে সারাজীবন রোজা রাখলেও এর ক্ষতিপূরণ হয় না। নি¤েœ এ বিষয়ে হাদিসটি বর্ণনা করা হলো-

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে রমজানের একটি রোজাও ভঙ্গ করে, সে আজীবন রোজা রাখলেও ঐ রোজার হক আদায় হবে না।- মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস : ৯৮৯৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদিস : ৭৪৭৬; সহীহ বুখারী ৪/১৬০।

হযরত আলী (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রমজান মাসের একটি রোজা ভঙ্গ করবে, সে আজীবন সেই রোজার (ক্ষতিপূরণ) আদায় করতে পারবে না।- মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস : ৯৮৭৮।

রোজা কেনো রাখতে হবে

প্রথমত, রোজা এজন্যই রাখতে হবে, রোজা রাখা আল্লাহর হুকুম। রোজা রাখাকে আল্লাহ তা’য়ালা ফরজ করে দিয়েছেন। আল্লাহর হুকুম পালন করা প্রতিটি মুমিন মুসলমানদের জন্য ফরজ। আল্লাহর ফরজ বিধানগুলো প্রতি মুমিন মুসলমান পালন করতে হবে এজন্যই আমরা রোজা রাখি।

কুরআনে রোজার বিধানের আয়াত

পবিত্র কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন, হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।- (সূরা ২. আল-বাকারা,আয়াতনং ১৮৩)

আল্লাহ তা’য়ালা আরো এরশাদ করেন, নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া-একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব, যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান।- (সূরা ২. আল-বাকারা, আয়াতনং ১৮৪)।

আল্লাহ তা’য়ালা আরো এরশাদ করেন, রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর। (সূরা ২. আল-বাকারা, আয়াতনং ১৮৫)

আল্লাহ তা’য়ালা আরো এরশাদ করেন, সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের নিকট গমন হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছদ। আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা নিজদের সাথে খিয়ানত করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন। অতএব, এখন তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা অনুসন্ধান করো। আর আহার করো ও পান করো যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কালরেখা থেকে স্পষ্ট হয়। অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো। আর তোমরা মাসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না। এটা আল্লাহর সীমারেখা, সুতরাং তোমরা তার নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবেই আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ মানুষের জন্য স্পষ্ট করেন যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে। (সূরা ২. আল-বাকারা, আয়াতনং ১৮৭)।

রোজার ফজিলতের হাদিস

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার নিজের জন্য; তবে রোজা নয়, যেহেতু তা আমারই জন্য এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো।’ রোজা ঢালস্বরূপ। সুতরাং তোমাদের কারো রোজার দিন হলে সে যেনো অশ্লীল না বকে ও ঝগড়া-হৈচৈ না করে; পরন্তু যদি তাকে কেউ গালাগালি করে অথবা তার সাথে লড়তে চায়, তবে সে যেনো বলে, ‘আমি রোজা রেখেছি, আমার রোজা আছে।’ সেই সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! নিশ্চয়ই রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট কস্তুরীর সুবাস অপেক্ষা অধিকতর সুগন্ধময়। রোজাদারের জন্য রয়েছে দুটি খুশি, যা সে লাভ করে; যখন সে ইফতার করে তখন ইফতারি নিয়ে খুশি হয়। আর যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন তার রোজা নিয়ে খুশি হবে। (বুখারী ১৯০৪, মুসলিম ১১৫১নং)।

সাহল বিন সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, জান্নাতের এক প্রবেশদ্বার রয়েছে, যার নাম ‘রাইয়ান।’ কিয়ামতের দিন ঐ দ্বার দিয়ে রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া তাদের সাথে আর কেউই ঐ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে না। বলা হবে, ‘কোথায় রোজাদারগণ?’ সুতরাং তারা ঐ দরজা দিয়ে (জান্নাতে) প্রবেশ করবে। অতঃপর যখন তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি প্রবেশ করবে, তখন সে দ্বার রুদ্ধ করা হবে। ফলে সে দ্বার দিয়ে আর কেউই প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারী ১৮৯৬নং, মুসলিম ১১৫২নং, নাসাঈ, তিরমিযী)।

হুযাইফা (রাঃ) বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)কে বলতে শুনেছি যে, ‘মানুষের পরিবার, ধন-সম্পদ ও প্রতিবেশীর ব্যাপারে ঘটিত বিভিন্ন ফিতনা ও গোনাহর কাফ্ফারা হল নামাজ, রোজা ও সদকাহ।’ (বুখারী ১৮৯৫, মুসলিম ১৪৪নং)।

আবু সাঈদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘যে বান্দা আল্লাহর রাস্তায় একদিন মাত্র রোজা রাখবে সেই বান্দাকে আল্লাহ ঐ রোজার বিনিময়ে জাহান্নাম থেকে ৭০ বছরের পথ পরিমাণ দূরত্বে রাখবেন।’ (বুখারী ২৮৪০নং, মুসলিম ১১৫৩নং, তিরমিযী, নাসাঈ)।

আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি রোজা রাখায় অভ্যাসী হবে, তাকে (কিয়ামতের দিন) ‘রাইয়ান’ দুয়ার হতে (জান্নাতের দিকে) আহবান করা হবে।’ (বুখারী ১৮৯৭, মুসলিম ১০২৭নং)।

আমর বিন আবাসাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন মাত্র রোজা রাখবে সেই ব্যক্তি থেকে জাহান্নাম ১০০ বছরের পথ পরিমাণ দূরে সরে যাবে।’ (নাসাঈ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৬৩৩০নং উকবাহ হতে, ত্বাবারানী কাবীর ও আওসাত্ব, সহীহ তারগীব : ৯৭৫নং)

উসমান বিন আবুল আস কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘রোজা হল দোযখ থেকে বাঁচার জন্য ঢালস্বরূপ; যেমন যুদ্ধের সময় নিজেকে রক্ষা করার জন্য তোমাদের ঢাল হয়ে থাকে।’ (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামেইস সাগীর)।

আবু উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি রোজা রাখবে, আল্লাহ সেই ব্যক্তি ও দোযখের মাঝে একটি এমন প্রতিরক্ষার খাদ তৈরি করে দেবেন; যা আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী জায়গা সমপরিমাণ চওড়া।’ (তিরমিযী, সহীহুল জামেইস সাগীর)।

আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘রোজা হলো জাহান্নাম থেকে রক্ষার জন্য ঢাল ও দুর্ভেদ্য দুর্গস্বরূপ।’ (আহমাদ, মুসনাদ, বাইহাকী শুআবুল ঈমান, সহীহুল জামেইস সাগীর)।

আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন রোজা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তাঁকে পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তাঁর ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর।’ আর কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাত্রে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তাঁর ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর।’ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘অতএব তাদের উভয়ের সুপারিশ গৃহীত হবে।’ (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম কাবীর, হাকেম, মুস্তাদ্রাক, ইবনে আবিদ্দুনয়্যার ‘কিতাবুল জু’, সহীহ তারগীব)।

আবু উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কোন আমল অবগত করুন; যদদ্বারা আল্লাহ আমাকে লাভবান করবেন।’ (অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যার মাধ্যমে আমি জান্নাত যেতে পারব।’) তিনি বললেন, তুমি রোজা রাখ, কারণ এর সমতুল্য কিছু নেই।’ পুনরায় আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে কোন আমলের আদেশ করুন।’ তিনিও পুনঃ ঐ কথাই বললেন, ‘তুমি রোজা রাখ, কারণ এর সমতুল কিছু নেই।’ (নাসাঈ, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ, হাকেম, মুস্তাদ্রাক, সহীহ তারগীব)।

হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমার বুকে হেলান দিয়ে ছিলেন। সেই সময় তিনি বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পর যে ব্যক্তির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে একদিন রোজা রাখার পর যে ব্যক্তির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের আশায় কিছু সাদকাহ করার পর যে ব্যক্তির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে সেও জান্নাত প্রবেশ করবে।’ (আহমাদ, মুসনাদ, সহীহ তারগীব)।

চাঁদ দেখে রোজা রাখা

রমজানের চাঁদ দেখে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোজা রাখে। (কুরআনুল কারীম বাকারা-১৮৫)। আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ এবং চাঁদ দেখে ঈদ কর। কিন্তু যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে গণনায় ৩০ পুরা করে নাও।’ (বুখারী ১৯০০, মুসলিম ১০৮০নং)।

তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ এবং চাঁদ দেখে ঈদ কর। কিন্তু যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে শা’বানের গুনতি ৩০ পূর্ণ করে নাও।’

হাদিসে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, রমজানের রোজা ফরজ হওয়া তথা তা শুরু করার ব্যাপারটা চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। আর এর মানেই হলো, চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোজা রাখা নিষিদ্ধ।

কুরাইব বলেন, একদা উম্মুল ফায্ল বিন্তুল হারেষ আমাকে শাম দেশে মুআবিয়ার নিকট পাঠালেন। আমি শাম (সিরিয়া) পৌঁছে তাঁর প্রয়োজন পূর্ণ করলাম। অতঃপর আমার শামে থাকা কালেই রমজান শুরু হলো। (বৃহস্পতিবার দিবাগত) জুমআর রাত্রে চাঁদ দেখলাম। অতঃপর মাসের শেষ দিকে মদিনায় এলাম। আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) আমাকে চাঁদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কবে চাঁদ দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘আমরা জুমআর রাত্রে দেখেছি।’ তিনি বললেন, ‘তুমি নিজে দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘জি¦ হ্যাঁ। আর লোকেরাও দেখে রোজা রেখেছে এবং মুআবিয়াও রোজা রেখেছেন।’ ইবনে আববাস (রাঃ) বললেন, ‘কিন্তু আমরা তো (শুক্রবার দিবাগত) শনিবার রাত্রে চাঁদ দেখেছি। অতএব, আমরা ৩০ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অথবা নতুন চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোজা রাখতে থাকবো।’ আমি বললাম, ‘মুআবিয়ার দর্শন ও তাঁর রোজার খবর কি আপনার জন্য যথেষ্ট নয়?’ তিনি বললেন, ‘না। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে এ রকমই আদেশ দিয়েছেন। (মুসলিম ১০৭৮নং)

ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, একদা লোকেরা নতুন চাঁদ দেখতে জমায়েত হলো। আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)কে খবর দিলাম যে, আমি চাঁদ দেখেছি। তিনি আমার এ খবরে রোজা রাখলেন এবং লোকেদেরকে রোজা রাখতে আদেশ করলেন। (আবু দাঊদ ২৩৪২, দারেমী, সুনান ২/৪, ইবনে হিববান, সহীহ ৮৭১নং, হাকেম, মুস্তাদ্রাক ১/৪২৩, দারাকুত্বনী, সুনান, বাইহাকী ৪/২১২, ইরওয়াউল গালীল)

ইফতার

যে খাদ্য বা পানীয় দ্বারা ইফতার করা হয়, তাকে ‘ইফতারি’ বলা হয়। ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা উত্তম। ইফতারের আগেই ইফতারি সামনে নিয়ে অপেক্ষা করা এবং যথাসময়ে ইফতার করা সুন্নাত।

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি খুশি; একটি ইফতারের সময়, অপরটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’ (মুসলিম)। আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ, ‘তোমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত : ১৮৭)।

হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে তারা আমার বেশি প্রিয়, যারা দ্রুত ইফতার করে।’ (তিরমিজি, আলফিয়্যাতুল হাদিস : ৫৬০, পৃষ্ঠা : ১৩১)। নবীজি (সাঃ) বলেন, ‘যখন রাত্র সেদিক থেকে ঘনিয়ে আসে ও দিন এদিক থেকে চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায়, তখন রোজাদার ইফতার করবে।’ (বুখারি, সাওম অধ্যায়, হাদিস : ১৮৩০)। হযরত সাহল ইবনে সাআদ (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যত দিন লোকেরা ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার করবে, ততো দিন তারা কল্যাণের ওপর থাকবে।’ (বুখারি, সাওম অধ্যায়, হাদিস : ১৮৩৩)।

খেজুর দ্বারা ইফতার করা সুন্নাত; যেকোনো ফল দ্বারা ইফতার করলেও সুন্নাত আদায় হবে। মিষ্টান্ন দ্বারা ইফতার করলেও সুন্নাত পালন হবে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ রোজা রাখলে খেজুর দিয়ে যেন ইফতার করে, খেজুর না হলে পানি দ্বারা; নিশ্চয়ই পানি পবিত্র।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ; আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৬২, পৃষ্ঠা: ১৩১-১৩২)।

ইফতার করা যেমন ফজিলতের, ইফতার করানোও তেমনি বরকতের। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াব কম করা হবে না।’ সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ)! আমাদের অনেকেরই রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই।’ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘পানিমিশ্রিত এক পেয়ালা দুধ বা একটি খেজুর অথবা এক ঢোঁক পানি দ্বারাও যদি কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, তাতেও সেই পরিমাণ সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তিসহকারে আহার করাবে, আল্লাহ তা’আলা তাকে আমার হাউসে কাউসার থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ)।

রমজান মাস সহমর্মিতা ও সমবেদনার মাস। তাই ব্যয়বহুল বাহারি ইফতারের আয়োজন না করে পাড়া–প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, নিকটজন, গরিব মিসকিন, দরিদ্র অসহায়দের ইফতারের বিষয়ে যত্নবান ও সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়। পথশিশু, ছিন্নমূল ও পথিকদের ইফতারের ব্যবস্থা করাও কর্তব্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইফতার মাহফিল ও ইফতার পার্টির আয়োজন না করে গরিব অসহায়দের দান–খয়রাত করা সমীচীন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তৃপ্তিসহ পেট পুরে পানাহার করল, তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত যাপন করল, সে মুমিন নয়।’ (মুসলিম)

সাহরি

সাহরি আরবি শব্দ যা ‘সাহর’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ রাতের শেষাংশ, শেষ তৃতীয়াংশ বা ভোর রাত। পরিভাষায় রোজা রাখার নিয়তে শেষ রাতে অর্থাৎ সুবহে সাদিকের পূর্বে যে খাবার গ্রহণ করা হয় তাকে সাহরি বলা হয়। রোজা রাখার নিমিত্তে এ খাবার গ্রহণ করা সুন্নাত।

এছাড়াও সাহরির গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে তিনি আরো বলেছেন, যদি একঢোক পানিও হয় তা তোমরা সাহরিতে গ্রহণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা ও তার ফেরেশতারা সাহরি গ্রহণকারীর উপর রহমত বর্ষণ করেন। (মুসনাদে আহমদ: ১১১০১)

সাহরি এই বরকতময় মাসের একটি অন্যতম নেয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে। এ প্রসঙ্গে নবী পাক (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাওয়ার মাধ্যমে দিনে রোজা রাখার শক্তি অর্জন করো আর দিনে হালকা ঘুমের মাধ্যমে রাত জেগে ইবাদত করার শক্তি অর্জন করো।’ (ইবনে মাজা: ১৬৯৩)

রাসূল (সাঃ)-এর যুগে অর্থাৎ ইসলামের প্রাথমিক যুগে সাহরি খাওয়ার নিয়ম ছিলো না। ইশার নামাজের পর খেয়ে কিংবা না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলে রোজা শুরু হয়ে যেতো। এবার কেউ শেষ রাতে উঠে খেতে চাইলেও সুযোগ ছিলোনা এবং স্ত্রী সহবাসেরও কোন সুযোগ ছিলোনা। হাদিসে এসেছে, একবার সাহাবী সিরমা উবনে কায়েস মাগরিবের নামাজ পড়ে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে গেলেন। হযরত ওমর (রাঃ) ইশারের পর স্ত্রীর সাথে মিলিত হলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইশার পড়ে ঘুমিয়ে গেলেন। পরবর্তীতে জেগে উঠে কিছু খেয়ে নিলেন। পরেরদিন ভোরে যখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে এসবের সমাধান জানতে চাওয়া হলে আল্লাহ তালা এই আয়াত নাজিল করেন, ‘খাও, পান করো ফজরের কালো রেখা থেকে সাদা রেখা স্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত।’ (সূরা বাকারা: ১৮৭, তাফসীরে ইবনে কাসীর: ১/৫১১)। এরপর থেকে সাহরির খাওয়ার নিয়ম শুরু হয়। তবে কেউ যদি সাহরি না খেতে পারে তাহলে তার রোজা হয়ে যাবে।

সাহরি খাওয়া যে উত্তম তা প্রকাশ করার জন্য মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘তোমরা সাহরি খাও। কারণ, সেহরীতে বরকত আছে।’ (বুখারী ১৮২৩, মুসলিম ১০৯৫নং)। ‘তোমরা সাহরি খেতে অভ্যাসী হও। কারণ, সাহরিই হল বরকতময় খাদ্য।’(আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ সহীহুল জামেইস সাগীর)।

ইরবায বিন সারিয়াহ বলেন, একদা রমাযানে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমাকে সাহরি খেতে ডাকলেন; বললেন, ‘বরকতময় খানার দিকে এসো।’ (আহমাদ, মুসনাদ, আবু দাঊদ, নাসাঈ, ইবনে হিববান, সহীহ, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ, সহীহুল জামেইস সাগীর)।

সাহরিতে বরকত থাকার মানে হল, সাহরি রোজাদারকে সবল রাখে এবং রোজার কষ্ট তার জন্য হালকা করে। আর এটা হল শারীরিক বরকত। পক্ষান্তরে শরয়ী বরকত হল, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ পালন এবং তাঁর অনুসরণ।

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এই সাহরির গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে তা দিয়ে মুসলিম ও আহলে কিতাব (ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের) রোজার মাঝে পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন। তিনি অন্যান্য ব্যাপারে তাদের বিরোধিতা করার মত তাতেও বিরোধিতা করতে আমাদেরকে আদেশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের রোজা ও আহলে কিতাবের রোজার মাঝে পার্থক্য হল সেহরী খাওয়া।’(মুসলিম ১০৯৬, আবু দাঊদ ২৩৪৩, ফাসিঃ মুসনিদ ৯৮পৃঃ)

তারাবীহ

তারাবিহ’র আভিধানিক অর্থ বিশ্রাম নেওয়া ও প্রশান্তি লাভ করা। এটি ‘তারবিহাহ’ শব্দের বহুবচন। পরিভাষায় ‘রমজান মাসে এশার নামাজের পর আদায়কৃত সুন্নাত নামাজ তারাবিহ নামে সুপরিচিত।’ (কামুসুল ফিকহ)।

চার রাকাত পরপর বিরতির মাধ্যমে বিশ্রাম নেওয়া হয় বলে এর নাম তারাবিহ। তারাবিহর নামাজে দেহ–মনে প্রশান্তি আসে বলেই এর নাম তারাবিহ বা প্রশান্তির নামাজ। ২০ রাকাত তারাবিহর নামাজ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমাদান মাসে তারাবিহ নামাজ পড়বে, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৬)।

রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করেছেন, আর আমি তোমাদের জন্য তারাবিহ নামাজকে সুন্নাত করেছি; যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমাদানে দিনে রোজা পালন করবে ও রাতে তারাবিহ নামাজ আদায় করবে, সে গুনাহ থেকে এরূপ পবিত্র হবে, যেরূপ নবজাতক শিশু মাতৃগর্ভ থেকে নিষ্পাপ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়।’ (নাসায়ী, পৃষ্ঠা: ২৩৯)।

২০ রাকাত তারাবিহর নামাজ প্রতিষ্ঠিত নিরবচ্ছিন্ন সুন্নাত। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, ‘তবে তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, নিশ্চয়ই উবাই ইবনে কাআব (রাঃ) রমজানে রাত জাগরণে ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর নামাজ পড়তেন।’ তাই উলামায়ে কিরাম মনে করেন, এটাই সুন্নাত, কেননা তা আনসার ও মুহাজির সব সাহাবির মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত, কেউ তা অস্বীকার করেননি।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রুম্মান (রহঃ) বলেন, ‘হযরত উমর (রাঃ)-এর খিলাফতের সময় মানুষ ২৩ রাকাত (বিতরসহ তারাবিহ নামাজ) দ্বারা রাত জাগরণ করত। (মুআত্তা ইমাম মালিক, খণ্ড: ১, হাদিস: ২৮১; আবু দাউদ, খণ্ড: ১, হাদিস: ৪২৮৯)।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘নবী কারিম (সাঃ) ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ পড়তেন, তারপর বিতর নামাজ পড়তেন।’ (মাজমুআ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া, খণ্ড: ১১, পৃষ্ঠা: ৩৯৩)।

ইতেক্বাফ

ইতিকাফ’ আরবি শব্দ, অর্থ হলো অবস্থান করা, আবদ্ধ করা বা আবদ্ধ রাখা। পরিভাষায় ইতিকাফ হলো ইবাদতের উদ্দেশ্যে ইতিকাফের নিয়তে নিজেকে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবদ্ধ রাখা। যিনি ইতিকাফ করেন তাঁকে ‘মুতাকিফ’ বলে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা ‘মাকামে ইবরাহিম’কে নামাজের জায়গা বানাও এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকুণ্ডসিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। আর যতক্ষণ তোমরা ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করো, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেয়ো না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা তাকওয়া লাভ করতে পারে। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৫)। হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সাঃ) আজীবন রমজানের শেষ দশকগুলো ইতিকাফ করেছেন। তাঁর ওফাতের পরও তাঁর বিবিরা ইতিকাফ করতেন। (বুখারি ও মুসলিম)

রমজানের শেষ দশক তথা ২০ রমজান সূর্যাস্তের আগে থেকে ঈদের চাঁদ তথা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়া বা ৩০ রমজান পূর্ণ হয়ে ওই দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইতিকাফ করা সুন্নতে মুআক্কাদাহ কিফায়াহ।

লাইলাতুল ক্বদর

আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মাহাত্ম্যপূর্ণ রজনীতে। আপনি কি জানেন মহিমাময় রাত্রি কী? মহিমান্বিত রাত্রি হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাত্রিতে ফেরেশতারা রুহুল কুদুস হযরত জিবরাইল (আ.) সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন; তাদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সকল বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে ফজর পর্যন্ত।’ (সুরা-৯৭ কদর, আয়াত: ১-৫)।

আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ বা কদর রজনী, এর ফারসি হলো শবে কদর। অর্থ সম্মানিত মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত, সম্ভাবনাময়, ভাগ্যনির্ধারণী রজনী।

শবে কদর’ কথাটি ফারসি। শব মানে রাত বা রজনী আর কদর মানে সম্মান, মর্যাদা, গুণাগুণ, সম্ভাবনা, ভাগ্য।

রমজানের শেষ দশদিনের যেকোনো বেজোড় রাতে লাইলাতুলকদর তালাশ করা যায়, অর্থাৎ ২১,২৩,২৫,২৭,২৯ রমজান দিবাগত রাতগুলো। তবে অনেক আলেমদের গবেষণা ও ব্যাখ্যায় এবং বুজুর্গানেদ্বীনের মতে ২৬ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ সাতাশ তারিখে পবিত্র শবে কদরের অন্যতম সম্ভাব্য রাত।

পরিশেষে বলব, রমজান এমন একটি মাস, যে মাসে একটি নফল ইবাদত করলে অন্য মাসে একটি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব। একটি ফরজ ইবাদত করলে অন্য মাসে ৭০ টি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব। এ মাসে রোজা আল্লাহর বিধান। এ মাসে অফুরন্ত রহমত বরকত কল্যাণ বর্ষিত হয়। রমজানের সাহারি, ইফতার, তারাবি, কোরআন তেলাওয়াত করার মাধ্যমে অফুরন্ত সওয়াব হাসিল হয়। রমজানে লাইলাতুল কদর রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রজনী। রমজান কোরআন নাজিলের মাস। এ মাসে বেশি পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ তাহলিন করা উচিত। গরিব অসহায় অভাবগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসা উচিত।

মুফতি মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক : ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়