শুক্রবার, ০১ নভেম্বর, ২০২৪  |   ৩০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুরে রাজনৈতিক মামলায় আসামীদের আটক অভিযান অব্যাহত। যুবলীগ, কৃষকলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৫ নেতা-কর্মী আটক
  •   ছেঁড়া তারে প্রাণ গেল যুবকের
  •   চাঁদপুরে গণঅধিকার পরিষদের ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন
  •   রাজধানীতে কচুয়ার কৃতী সন্তানদের সংবর্ধনা
  •   সম্প্রীতির চমৎকার নিদর্শন আমাদের বাংলাদেশ --------------জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন

প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২২, ২০:৩৫

কিশোর গ্যাংকে নিবৃত করতে কঠোর হন

মোঃ মাসুদ হোসেন
কিশোর গ্যাংকে নিবৃত করতে কঠোর হন

গত কয়েক বছর ধরে কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ বা সংঘবদ্ধ অপরাধের ভয়ঙ্কর চিত্র মানুষের সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই থেকে কিশোর অপরাধ নিয়ে সমাজে আজকাল আলোচনাও চলছে বেশ। তাদের উৎপাতে সামাজিক অবস্থান আজ বিকলের পথে। অসহায়রা হয়ে আছে আজ নিরুপায়। তাদের কারনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া অনেক ছাত্রীও জিম্মি। এসব ছাত্রীরা হচ্ছেন ইভটিজিং এর শিকার। গ্যাং এর সদস্যদের দেয়া প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে হতে হয় বিভিন্ন লাঞ্চনার শিকারও। প্রতিবাদ করলে পরিবার ও শিক্ষক সমাজের অভিভাবকও হচ্ছেন গুম কিংবা খুন। এদের কয়েকজনের সংঘদোষে বেড়ে উঠা অন্য কিশোররাও হয়ে উঠছেন এদের গ্যাং এর সদস্য। বিস্তৃত হচ্ছে অপরাধ চক্র। এক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গ্যাং। এসব গ্যাংয়ে থাকছে একাধিক মেয়ে সদস্য। মূলত ছোট অপরাধ থেকে তাদের যাত্রা শুরু। আস্তে আস্তে ইভটিজিং বা বখাটেপনা করলেও পরবর্তীতে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কেনা-বেচা, ধর্ষণের মতো নৃশংস ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন কিশোররা। এমনকি দলবেঁধে বিরোধীপক্ষের ওপরও হামলা করছেন তারা। গত কয়েক বছর ধরে প্রায়শই খবরের শিরোনাম হচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’। এমন চক্রের সংখ্যা নেহাত কমও নয়। অপরাধ বিশ্লেষক ড. জিয়া বলেছেন, কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রভাবিত হয় সহজে। তাদের নতুন করে সবকিছু বুঝতে শেখার এই সময়টাতেই যদি ‘ক্ষমতা’ বিষয়টি তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তবে তারা সহিংসতাকেই হাতিয়ার মনে করে। কিশোর গ্যাং নামক এই সন্ত্রাসী সংস্কৃতির অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হলেও ২০১৭ সালে উত্তরায় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আদনান কবির খুনের পর এদের কর্মকাণ্ড আলোচনায় আসে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে মাঠে নামে।

সারা দেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোররা ব্যবহৃত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। তবে দিন যত যাচ্ছে তাদের অপরাধগুলো ক্রমেই হিংস্র, নৃশংস ও বিভীষিকাপূর্ণরূপে দেখা দিচ্ছে। সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে।পারিবারিক পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই এ সমস্যার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা অথবা ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবারে সন্তানদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়। নেশাগ্রস্ত পরিবার যেখানে মাদক/নেশাজাতীয় দ্রব্যের নিয়মিত আসর বসে, সেখানে কম বয়সে অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের কেউ গ্যাং সদস্য থাকলেও কিশোররা এ পথে আসতে উৎসাহিত হয়। পরিবারের কোনো সদস্য বা পিতা-মাতা রোল মডেল হতে ব্যর্থ হলে অথবা পিতা-মাতার কর্ম অদক্ষতা ও বেকারত্বের ফলে আর্থিক উপার্জনের জন্য সন্তানদের মাঝে গ্যাং সদস্য হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। আবার কখনো কখনো কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী পিতা-মাতার পক্ষে সন্তানকে সময় দেওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গ্যাং তৈরির মধ্য দিয়ে সন্তান একাকিত্ব ও হতাশা দূর করার চেষ্টা করে। একাধিক বিবাহ এবং পারিবারিক অশান্তিও গ্যাং তৈরির কারণ হতে পারে।

শিক্ষাব্যবস্থাও এ কালচার গড়ে ওঠার পেছনে কিছুটা দায়ী। বিশেষ করে করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার এই সুযোগে তাদের হাতে স্মার্ট ফোন চলে যাওয়ায় তারা আরো বখাটে হয়েছে বেশি। এতে স্কুলের পাঠদান প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা জাগ্রত হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদককে কেন্দ্র করে আড্ডা ইত্যাদি তৈরি হয়, যা থেকে গ্যাংয়ের উদ্ভব বেড়েছে। বর্তমানে কিশোর গ্যাং এর উৎপাতে দেশের সামাজিক জনজীবন বিপর্যস্ত। এর প্রভাবে দেশের সবগুলো জেলাই কমবেশি খুন, গুম, ধর্ষণ, আত্মহত্যা কিংবা সামাজিক লাঞ্চনা হয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনার সিংহভাগ খবর পেয়ে থাকি পত্রিকার পাতায়। বাকী ঘটনাগুলো সবার অজান্তেই থেকে যায়। আবার স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা কিংবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা গ্যাংয়ের সদস্যদের নেতারা নিজেরাই তাদের স্বার্থে নিষ্পত্তি করে দেন। সচেতনদের পক্ষ থেকে কোন মতে থানায় অভিযোগ করা হলেও উপরোক্ত ব্যক্তিদের অনুরোধে কিংবা প্রভাবের কারনে ছাড়া পেয়ে যান অপরাধীরা। এতে ভুক্তভোগীরা নিরুপায় হয়েই সব মেনে নিতে হয়। আর অপরাধীরা আরো অপরাধ করতে দ্বিধা বোধ করে না। আমার দেখা, এক বড় ভাই নিজের এলাকা ছেড়ে নানার এলাকায় এসে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বড় হয়েছে এবং অত্র এলাকায় একটা প্রভাব বিস্তার করে এলাকার সামাজিক মানুষের সাথে ছোট থেকে শুরু করে বড় ধরনের অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। এমন করতে করতে তিনি বহুবার জেলও খেটেছেন। পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর বিভিন্ন তদবিরে কয়েকদিন জেল খেটে বের হয়ে আবারো সেই অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। কয়েক বছর পর ঐ এলাকায় তার নেতৃত্ব তৈরি হয় একটি কিশোর গ্যাং। চলতে থাকে তাদের এমন কর্মকাণ্ড। এ গ্যাং এর সদস্যরা এলাকায় কোন না কোন অপরাধ করেই থাকে প্রতিনিয়ত। তাদের বেশিরভাগ সদস্যরা কারো কারো বাবা মায়ের উৎসাহ, কারো স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রভাব আবার কারো রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে বেশ। এদের মত সারা বাংলাদেশেই রয়েছে কিশোর গ্যাং এর ছোট বড় টিম।

বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিদিনই দেশজুড়ে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, জমিদখল, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ধর্ষণ এবং খুন-খারাবি ইত্যাদি অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এদের অত্যাচার নির্যাতনে সমাজ বিষিয়ে উঠেছে। মানুষ অস্বস্তিকর অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। সমাজের নিরীহ অংশ বিশেষ করে যাদের কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি নেই বা প্রভাবশালী মহলের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই তাদের আতঙ্কই বেশি। তারা তাদের সহায়-সম্পদ ও উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটায়; কখন কারা জায়গা-জমি দখল করতে আসে বা চাঁদা দাবি করে অথবা স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েটিকে কখন কোন বখাটে বিরক্ত করে বা স্কুলে যাওয়া ছেলেটিকে তাদের গ্যাংয়ের দলে ভিড়িয়ে ফেলে। এ ছাড়া এসব গ্যাংয়ের উৎপাতে পাড়ায় পাড়ায় মারামারি কাটাকাটি তো লেগেই আছে। এই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বর্তমানে তরুণদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষার লক্ষ্যে এখনই এর লাগাম টেনে ধরা দরকার। না হলে ভবিষ্যতে এটি খুব ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, এদের বয়সসীমা ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই বেশি হয়ে থাকে। তারা নির্দিষ্ট একটি এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে এবং সর্বদা আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্যাংয়ের প্রচার-প্রচারণার নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা গ্যাং সংগঠন নিয়ে গর্ববোধ করে এবং গ্যাং সদস্য হিসাবে পরিচিত হয়ে তৃপ্তি অনুভব করে। এ ছাড়া আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা অস্ত্র যেমন- ছুরি, রামদা, হকিস্টিক, বন্দুক ইত্যাদি সংগ্রহে রাখে। কিশোর গ্যাং নির্মূলে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো এগিয়ে আসতে হবে। গ্যাং সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ডাটা বেইজ তৈরি করতে পারলে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ। যেসব স্থানে গ্যাং সদস্যরা আড্ডা দেয়, সেসব জায়গায় সিভিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি থাকতে হবে। গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক ও নিয়ন্ত্রকদের সুপারিশ গ্রহণ না করে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। যে কোনো ধরনের অপরাধ বড় রূপ নেওয়ার আগে অপরাধীকে গ্রেফতার করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, চাঁদপুর সদর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়