প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
শোক ও সঙ্কট উত্তরণের আগস্ট
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
আগস্ট বাঙালির ভগ্নদূত। আগস্ট বাঙালির সংশপ্তক বটে। বাঙালির কাছে আগস্ট যেন এক মৃত্যুর দূতের উপমা। আগস্ট কেড়েছে এ উপমহাদেশের মুক্তির দূত কিশোর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে। কেড়েছে বাঙালির সুখে-দুখে অনন্য শরণ রবীন্দ্রনাথকে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও গিয়েছেন এই আগস্টেই বাঙালিকে ছেড়ে। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগস্টেই সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন। আগস্টের এই প্রয়াস কিন্তু প্রথম প্রয়াস নয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন দীপ কেড়ে নেয়ার চেষ্টায় আততায়ী ঘাতক ছিলো সদা তৎপর। সেই শৈশবে ড্রাই বেরিবেরি রোগের দানব বঙ্গবন্ধুর জীবন সংশয় ঘটিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন রোগা আর লিকলিকে। তার সাথে চোখের রোগ গ্লুকোমা এসে যোগ দেয় সেই মারণ-দূতের স্কোয়াডে। কিন্তু কোলকাতার ধন্বন্তরী ডাক্তারদের সাথে লড়াইয়ে পেরে ওঠেনি ঘাতক ব্যাধি। তারপর মৃত্যু এসে নৌকাডুবির ছলে প্রাইমারি স্কুল পড়ুয়া খোকাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল চির ঘুমের দেশে। কিন্তু মায়ের অপার দোয়ায় সে যাত্রাতেও বঙ্গবন্ধুর জীবনের দীপ ছিল জ্বলজ্বলে, দীপ্যমান। বঙ্গবন্ধু ছেচল্লিশের দাঙ্গায় প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলেন কোলকাতার রক্ত-রঞ্জিত রাস্তায়। কিন্তু আঁধারের আড়াল সেবার ত্রাতা হয়ে তাঁকে মৃত্যুর দর্শন হতে ফিরিয়ে আনে জীবনের আলোয়। ঊনিশশো বায়ান্ন সালের ফেব্রুয়ারিতে টানা তেরদিন কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় অনশনে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। মৃত্যু আর জীবনের ব্যবধান তখন ডাঃ মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলি। শেখ মুজিবের পিতা সেবার ঘাবড়ে গিয়েছিলেন পুত্রের হেন অবস্থায়। কিন্তু নিয়তি যাকে শোষণমুক্তির দূত হিসেবে পাঠিয়েছে তাঁকে কি আর এতো সহজে শিকারে পরিণত করতে পারে মারণ-নিষাদ? এরপর বেশ কিছুদিন নিরাপদে কাটলেও ঘাতক কিন্তু পিছু ছাড়েনি মুজিবের। বরং রঙ লুকিয়ে প্রতীক্ষায় ছিল অনুকূল পরিবেশের। ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনকে ঘিরে শেখ মুজিব গং-এর নামে পাকিস্তানী স্বৈরশাহী যে সাজানো ষড়যন্ত্র মামলা দিয়েছিলো তাতেও সামরিক জল্লাদ ঘুর ঘুর করছিলো অশরীরী হয়ে মুজিবের আশেপাশে। কিন্তু তীব্র গণআন্দোলন আর মুজিবের দূরদর্শী বুদ্ধিমত্তায় সেবারও অদৃশ্য ঘাতক হয় ব্যর্থ মনোরথ। ঊনিশশো একাত্তরে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের লায়ালপুর মিয়ানওয়ালি কারাগারে মুজিবের কবর খুঁড়ে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে ঘাতকেরা। কিন্তু ইন্দিরার কূটনীতি সেবার হারিয়ে দিয়েছিল ঘাতক ভুট্টোকে। স্বদেশে মুজিব ফিরে এসে মুক্ত নিঃশ্বাসে ফের বেঁচে উঠলেন নিজের জনগণকে কাছে পেয়ে। লক্ষ লক্ষ জনসমুদ্রে স্বজন ফিরে পাওয়ার আনন্দ-কল্লোল জাগ্রত হলো। কিন্তু ঘাতক রোগ ছিলো এবার ঘাপটি মেরে। মুজিবের পিত্ত থলিতে পাথরের দানব হয়ে মৃত্যুদূত লুকিয়ে ছিল সেই কারাদশা হতে। অস্ত্রোপচারের ছুরির নিচে গিয়ে মুজিব নিজেকে সোপর্দ করলেন সার্জনের হাতে। মুজিবভক্ত চৌকষ ডাক্তারেরা মুজিবকে কখনো নিরাশ করেন নি। তারা সব সময় মুজিবকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁর স্বস্তি সুচিকিৎসার মাধ্যমে। পাশাপাশি স্রষ্টা নিজেও চাননি ডাক্তারের কারণে মুজিবের মতো মানচিত্র-জনকের প্রাণহানি হোক। তাই পিত্তথলির প্রদাহ ও সংক্রমণ জনকের মৃত্যু ঘটাতে পারে নি। বোধ হয় সবাই ঘাতক আগস্টেরই প্রতীক্ষায় ছিল। নইলে যেদিন শেখ মুজিব বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন সেদিনই ঘাতকের চূড়ান্ত আঘাতের কথা ছিল। কিন্তু নিয়তি চেয়েছে আগস্টকে ঘাতক বানাতে, যে আগস্টে ক্ষুদিরাম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলেরা পৃথিবী ছেড়ে যাত্রা করেছেন ঊর্ধ্বলোকে। তাইতো পনর আগস্ট হয়েছে রক্তে রঞ্জিত, কলঙ্কিনী। রবীন্দ্রনাথের কাছে মৃত্যু শ্যামের মতো, নজরুলের কাছে মৃত্যু হলো জীবনে না বলা কথার সমাধি-কথক। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে মৃত্যু উপনীত হয়েছে ইতিহাসের আকাশ হয়ে ওঠার আহ্বান নিয়ে। বাঙালির প্রতি অতি প্রেমে নাজুক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজ মৃত্যুতে হয়ে গেছেন বিশ্ববন্ধু, বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব। আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে করে তুলেছে সত্যিকারের অমর, অজর।