প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
১৯৭৫ সাল আগস্ট থেকে নভেম্বর বাঙালি জাতির জন্য সবচেয়ে ক্রান্তিকাল। ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তির গভীর ষড়যন্ত্র। প্রথম আঘাত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা। ১৫ আগস্ট ভোরবেলা রেডিও চালিয়ে সবাই শুনছে- ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, জাতির ক্রান্তিকালে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। আপনারা সবাই শান্ত থাকুন’। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর খুনি মোস্তাককে তারা ক্ষমতার মসনদে বসান। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এই দু মাস নানা অস্থিরতার মাঝে দেশ চলছে। তেমন কিছু খেয়াল নাই। কলেজে ভর্তি হওয়ার লক্ষ্যে ঢাকা যাই। চাঁদপুর গভ. টেকনিক্যাল স্কুল থেকে এসএসসি শেষ করে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার লক্ষ্যে ঢাকা তেঁজগাও Intermediate Technical College (বর্তমান Govt. Intermediate College)-এ ভর্তি পরীক্ষা দিই এবং উত্তীর্ণ হই। ঢাকা আজিমপুর মামার বাসায় উঠি। আবার সেই বিধিবাম ঢাকা কোথায় থাকবো, খরচ চলবে কীভাবে সেই পুরানো কথা। বাবার আর্থিক অসচ্ছলতা। কোনো কাজ নেই। আমরা ভাই-বোন ৭ জন। সবাই লেখাপড়া করছি। মা সংসারের হাল ধরেছেন। কৃষিকাজ করে খাবারের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাবার কোনো কাজ ছিল না। দাদার অগাধ সম্পত্তি! তা রক্ষা করার জন্য বাবা চাকুরি ছেড়ে চাঁদপুর চলে আসেন। কিন্তু দাদার অসহযোগিতার কারণে বাবা বড় বিপদে পড়েন। কী আর করা। পড়ালেখা করতে হবে। অবশেষে কুমিল্লায় থাকেন আমার ফুফাতো ভাই বাবার ভাগিনা ব্যাংক ম্যানেজার উনার কৃপায় কুমিল্লা থাকাণ্ডখাওয়ার ব্যবস্থা হওয়ায় আমি ট্রান্সফার নিয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি। এদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে সকাল-বিকেল চলছে যুদ্ধ। অবশেষে ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন। তারপর থেকে দেশের অবস্থা মোটামুটি শান্ত হতে শুরু করে। দেড় বছরের মাথায় কলেজ জীবন শেষ করতে হয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে ১৯ দফা দেশ গড়ার কর্মসূচি দেন। তারই অংশ হিসেবে কলেজ থেকে দাউদকান্দির সুন্দলপুরে খাল কাটা কর্মসূচিতে যাই। আমরা ছিলাম খুনি মীরজাফর মোস্তাকের বাড়ির কাছাকাছি। সে সুবাদে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে ষড়যন্ত্রকারী মীরজাফর খন্দকার মোস্তাকের বাড়ি দেখার সুযোগ হয়। কুমিল্লায় কলেজ জীবন একা একা নতুন পরিবেশ মানিয়ে নিতে প্রথম বেশ কষ্ট হতো। কিন্তু লেখাপড়া করার জন্য থাকতে হবে। সরকারি কলেজে পড়বো তা না হলে চাঁদপুর কলেজেই পড়া হতো। কিন্তু চাঁদপুর কলেজ তখন সরকারি হয়নি।
ফ্ল্যাশ ব্যাক ১৯৭৩। সময়টা ছিল বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন। একদিকে বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রম যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে গড়ে তোলার জন্য। অন্যদিকে প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা। মুক্তিযোদ্ধাসহ সবাইর প্রচণ্ড চাওয়া। জাসদ আর গণবাহিনী। একাই যুদ্ধ করে চলেছেন দেশটাকে গড়ে তোলার জন্য। বর্তমানে টিভিতে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতাগুলো দেখলে বোঝা যায়। কতটাই না স্রোতের বিপরীতে তিনি দেশের হাল ধরেছেন। চারদিকে হাহাকার। সবাইর চাওয়া। দেওয়ার কেউ নেই। তার মাঝেও বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন।
১৯৭৪ সাল। সবচেয়ে দুর্যোগময় মুহূর্ত। প্রচণ্ড খাদ্যের অভাব। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নানা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেশের মানুষকে বিষিয়ে তুলছে। কিন্তু এ কথা কেউ বোঝার চেষ্টা করছে না যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। প্রচণ্ড আইনশৃঙ্খলার অবনতি। চারদিকে খুন, ব্যাংক ডাকাতি, খাবার লুটপাট। ছিনতাই সব মিলিয়ে এক অসহনীয় অবস্থা। নিরাপত্তার প্রচণ্ড অভাব। তখন বঙ্গবন্ধু গঠন করলেন রক্ষীবাহিনী। আমাদের স্কুলে ছিল ক্যাম্প। তাই অনেক কিছুই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। অনেক স্বনামধন্য লোককেই ক্যাম্পে নিয়ে কীভাবে শায়েস্তা করেছেন। রক্ষীবাহিনী নামানোর পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি হতে শুরু করলো।
১৯৭৫ সাল। দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোকে এক প্লাটফর্মে এনে দেশ গড়ার জন্য গঠন করলেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। প্রত্যেক জেলায় নিয়োগ দিলেন একজন রাজনৈতিক নেতাকে গভর্নর বানালেন। উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের সুখণ্ডদুঃখের কথা শুনবেন। জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে থাকবে। প্রশাসন চলবে তার নিজস্ব গতিতে। আর রাজনীতিবিদরা দেশ গড়ার কাজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই সুন্দর চিন্তা সেদিন ব্যর্থ হয় আমলাতান্ত্রিকতার কাছে। সে সাথে যুক্ত হয় আমেরিকার যুদ্ধে হেরে যাওয়ার কূটচাল। সবমিলিয়ে আরো নানা সমস্যা আর অসহযোগিতার কাছে হেরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে জীবন দিতে হয় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। তারপর ইতিহাসের চাকা আবার উলটো দিকে ঘুরতে থাকে। বাংলাদেশ বেতার হয়ে যায় রেডিও বাংলাদেশ। স্বাধীনতার স্লোগান ‘জয় বাংলা’ নিষিদ্ধ হয়। আরো অনেক কিছুই ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে থাকে। সবচেয়ে মজার ঘটনা হলো, পাকিস্তানের বন্ধু চীন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। আজ সেই চীনই বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।