প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২২, ০৯:০০
একাকী প্রবীণ জীবন এবং বিয়ে বিতর্ক
একাকী প্রবীণ জীবন বলতে আমরা বুঝি যারা স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ভাই-বোন ছাড়া জীবনযাপন করেন। এরকম পরিস্থিতি নানা কারণে মানুষের জীবনে আসতে পারে। বেশিরভাগ মানুষই যৌবনে উপনীত হয়ে বিয়ে করে ঘরসংসার শুরু করে। একসময় সংসারে অনেক লোক বসবাস করে, যেমন মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে। ভাই-বোন বড় হয়ে নিজেরা নতুন সংসার করে। মা-বাবা মারা যান। ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে যায়। তারা লেখাপড়া শেষ করে কাজেকর্মে, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দেয়। একসময় তারাও নতুন সংসার তৈরি করে। একপর্যায়ে সংসারে শুধু প্রবীণ স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কেউ থাকে না। প্রকৃতিগত এবং বয়সের কারণে প্রবীণ পুরুষ আগে মৃত্যুবরণ করেন। প্রবীণ নারী অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘজীবী হন। আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ফলে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনুযোগ অব্যাহত রাখছে। সবাই স্বাধীনভাবে নিজের জীবন চালাতে চায়। এ চাওয়াটুকু খুবই স্বাভাবিক। এ স্বাধীনতা একটা সময় বিচ্ছিন্ন বন্ধুহীন, স্বজনহীন করে দেয়। সমাজটা একটা সময়ে গড়ে উঠেছিল পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করে টিকে থাকবেÑ এ দার্শনিক ভিত্তি থেকে।
|আরো খবর
এই সেদিনও সংসারে তিনিই কর্তা ছিলেন, যিনি সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতেন। একে অপরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতেন। ভাই-বোনকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে অনেক মেধাবী সন্তান নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভাবেননি। কৃষি, ব্যবসা, ছোট চাকরি ইত্যাদি করে সংসার টেনে নিয়েছেন। এমন মানুষও আমি দেখেছি, যিনি পরিবার-পরিজনের কথা ভেবে বিয়ে করেননি। সমাজের এ চেহারাটা পাল্টে গেছে। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করতে গেছেন। প্রায় ৬০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিক গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছেন। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী কাজের সন্ধানে শহরের দিকে ছুটে আসছেন। গ্রামে কর্মক্ষম যুবকের সংখ্যা কমে গেছে। গ্রামে আয় কমে গেছে, একই সঙ্গে ব্যয় বেড়ে গেছে। শুধু কৃষি কাজের ওপর নির্ভর করে কর্মক্ষম মানুষ গ্রামে থাকতে চায় না। কৃষি জমির মালিকানা না থাকা, উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়া, কৃষি শ্রমিকের অভাব, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এ খাতে মানুষের অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে স্থানান্তর। স্থানান্তর বেড়ে যাওয়ায় নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী নানা ধরনের সংকটে পড়ছে। এ নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী হলো শিশু এবং প্রবীণ। প্রবীণদের মধ্যে একাকী প্রবীণরা সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছেন। তাদের একাকিত্ব ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত আসামির মতো। ফাঁসির আসামি যেমন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে, তেমনি একাকী প্রবীণও মৃত্যুর জন্য বেঁচে থাকেন। ফাঁসির আসামির স্বজনরা যেমন তাকে দেখতে আসে, একাকী প্রবীণকেও মাঝে মধ্যে কেউ কেউ দেখতে আসে। গ্রামে একাকী প্রবীণের সংখ্যা অনেক কম। একাকী প্রবীণরা অসহায়ভাবে গ্রামে বেঁচে আছেন। তারা খাবার, আবাসন, কাপড়, চিকিৎসার দারুণ সংকটে পড়ে দিশাহারা। প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের করুণা ও দয়ায় কিংবা ভিক্ষে করে জীবনযাপন করছেন। মারা গেলে চাঁদা তুলে কিংবা সামর্থ্যবানদের আর্থিক সহায়তায় দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে হয়। প্রায় গ্রামেই এখন দুই-একটা বাড়ি আছে যেখানে মালিকরা থাকে না। বাড়ি কেয়ারটেকার দেখে অথবা তালা মারা থাকে। বছরে দুই-একবার মালিকপক্ষ বাড়িতে আসে দুই-চার দিন থেকে আবার চলে যায়। গ্রামের নেতৃস্থানীয়রা সামান্য উদ্যোগ নিলে এসব বাড়িতে একাকী প্রবীণরা দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পারেন। একাকী প্রবীণরা এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাহায্য-সহযোগিতা পাবেন। স্থানীয় দরদি মানুষের আর্থিক সহায়তায় একাকী প্রবীণের কষ্ট কমবে।
একাকী প্রবীণরা একত্রে থাকলে একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবেন। একাকী প্রবীণরা বিয়ে করতে চাইলে সমাজের বিবেকবান মানুষের উচিত হবে সম্মানের সঙ্গে প্রবীণদের বিয়ের ব্যবস্থা করা। ইসলাম ধর্মে একজন পুরুষ একত্রে চারজন স্ত্রী রাখতে পারেন। একজন একাকী প্রবীণ পুরুষ চারজন একাকী প্রবীণ নারীকে বিয়ে করতে পারেন। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী একজন পুরুষ একাধিক বিয়ে করতে পারেন। অতএব হিন্দু একাকী প্রবীণ পুরুষ একাকী প্রবীণ নারীকে বিয়ে করে একাকিত্ব ঘোচাতে পারেন। গ্রামের চেয়ে শহরে একাকী প্রবীণের সমস্যা বাড়ছে। ধনী এবং দরিদ্রদের মধ্যে একাকী প্রবীণদের বেশি দেখা যায়। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বেশি থাকায় এখানে একাকী প্রবীণদের সমস্যা নগণ্য। দরিদ্র প্রবীণরা একসময় আয়রোজগার করতে পারেন না, নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। দরিদ্র প্রবীণের সন্তানরাও নিঃস্ব। তাদের পক্ষে প্রবীণ মা-বাবার সেবাযতœ করা অসম্ভব। শহরের দরিদ্র প্রবীণরা দ্রুত একাকী প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করেন। বস্তি, স্টেশন, টার্মিনাল, ঘাট, ফুটপাত, পার্ক বহুতল ভবনের আশপাশে একাকী প্রবীণরা রাতযাপন করেন। শহরে একাকী প্রবীণরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। একসঙ্গে ভিক্ষে করেন, একসঙ্গে রাতযাপন করেন। অসুখ-বিসুখে একে অপরকে দেখাশোনা করেন। একাকী প্রবীণ পুরুষ একাকী প্রবীণ অন্ধ নারীকে বিয়ে করে ফুটপাতে সংসার করার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছি। প্রবীণ পুরুষ আমাকে জানিয়েছেন, অন্ধ প্রবীণ নারী দুই দিন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কাবু হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। এখন তারা বিয়ে করেছেন। একসঙ্গে ভিক্ষে করেন। হোটেলে খান ফুটপাতে ঘুমান। প্রবীণ নারীকে তিনবেলা ওষুধ খাইয়ে দেন। ফুটপাতে থাকা কমবয়সী ভিক্ষুকরা তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। তিনি এসবে কান দেন না। তিনি মনে করেন তিনি মহৎ কাজ করেছেন। দরিদ্র প্রবীণরা অনেক সময় সাহস করে বিয়ে করে ফেলেন। তারা সমাজের মানুষের কথাকে তেমন একটা পাত্তা দেন না। আবার একাকী প্রবীণরা নিজেরা বিয়ে না করেও একসঙ্গে থাকেন। সারাদিন ছোটখাটো কাজকর্ম কিংবা ভিক্ষে করে রাতে সবাই একত্রিত হন। একে অপারের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা ভাগাভাগি করে নেন। একাকী প্রবীণদের জন্য শহরে রাতযাপনের ব্যবস্থা করলে তারা স্বস্তিতে রাতে ঘুমাতে পারবে। অসহায় একাকী প্রবীণরা শহরে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রবীণরা একাকী প্রবীণদের নানাভাবে নাজেহাল করে থাকে। একাকী প্রবীণদের টাকা-পয়সা প্রায়ই চুরি হয়ে যায়। ভিক্ষে করে যে ক’টি টাকা রোজগার করেন তা হাতছাড়া হলে মনে দারুণ কষ্ট পান। একাকী প্রবীণরা শারীরিক অক্ষমতার কারণে নানা ধরনের দুর্ভোগে পড়েন। যিনি চোখে দেখেন না আবার কানেও শোনেন না তার অবস্থা খুবই ভয়ানক। একাকী প্রবীণরা একাধিক রোগে ভুগতে থাকেন। শহরের ধনী একাকী প্রবীণের জীবন বড়ই বেদনাদায়ক। আমি একজন বিদ্বান ব্যক্তিকে চিনি, যাকে বাংলাদেশে অনেকেই চেনেন। তার একমাত্র মেয়ে মারা গেছেন। প্রায় বছর খানেক পর স্ত্রী মারা গেছেন। তার বয়স বর্তমানে ৭৮ বছর। একই বাড়িতে তার ৯৩ বছর বয়স্ক শাশুড়িও থাকেন। কাজের লোক আর শাশুড়ি এই ভদ্রলোকের দেখাশুনা করেন। ঢাকা শহরের ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরা, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় একাকী প্রবীণদের অবস্থান বেশি। তাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকেন অথবা শহরের অন্য কোথায়ও আলাদা বাড়িতে থাকেন। ধানমন্ডিতে আমি একজন একাকী প্রবীণ নারীকে চিনি, যিনি এক সময় আমার সহকর্মী ছিলেন। লেকের পাড়ে এক বিঘা জমির ওপর আড়াইতলা বাড়ি। ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকে। স্বামী বছর তিনেক আগে মারা গেছেন। পুরো বাড়ি খালি। দারোয়ান, কাজের লোক আর পাঁচটা দেশি কুকুরের বসবাস। সকালে ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে গেলে মাঝে মধ্যে দেখা পাই। সেই হাসি মুখখানি আমাকে প্রীত করে। আমি বুঝতে পারি তিনি কতটা অসহায়। আমার সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ, তিনি পেশায় আইনজীবী। সকালে তার সঙ্গে আমি নিয়মিত ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে যাই। একসঙ্গে ফিরে আসি। তিনি দাবি কনে, তিনি ভালো আছেন। আমি তার নিঃসঙ্গতা এবং একাকিত্বকে উপলব্ধি করতে পারি। তার বয়স বাড়তে থাকলে নির্ভরতাও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। বার্ধক্য আমাদের উন্নয়নের ফসল। এই ফসল আমাদের ভোগ করতে হবে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই কঠিন। অচিরেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে চলে যাব। তখন পাল্লা দিয়ে গড় আয়ুও বেড়ে যাবে। উন্নত আয়ের দেশ হলে তখন গড় আয়ু ১০০ বছরের কাছে চলে আসবে।
গ্রামে একসময় প্রবীণ ব্যক্তির স্ত্রী মারা গেলে ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন উদ্যোগী হয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করতেন। যুক্তি দেখানো হতো, সেবাযতœ, সংসার দেখাশোনা করার জন্য একজন লোক লাগবে। প্রবীণ নারীর স্বামী মারা গেলে তাকে পুনর্বিবাহ করার জন্য কাউকে উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। আমাদের দেশের নব্বই ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। আমরা আধুনিকতার নামে খ্রিস্টান ধর্মের মূল্যবোধ ব্যক্তিজীবনে চর্চা করার চেষ্টা করছি। খ্রিস্টীয় ধর্ম অনুযায়ী একজন পুরুষের একজন স্ত্রী থাকবে। আমরা প্রকারন্তরে এটাই মেনে চলছি। ইসলাম ধর্মে একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখার বিধান রয়েছে, তাই একজন একাধিক প্রবীণ পুরুষ একাধিক একাকী প্রবীণ নারীকে বিয়ে করতে পারেন। এতে নিঃসঙ্গতা যেমন কাটবে, তেমনি ব্যয়সাশ্রয়ী জীবনযাপন সম্ভব হবে। খাবার টেবিলে নানারকম খাবার সঠিক পুষ্টি জোগাতে সহায়তা করবে। একাকী প্রবীণরা পুষ্টিহীনতার হাত থেকে রক্ষা পাবে। আমাদের সমাজ ভীষণভাবে একাকি প্রবীণদের বিয়ে করার বিপক্ষে। আমরা প্রবীণদের মা-বাবা হিসেবে দেখতে চাই। তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করুক, এটা আমরা চাই না। প্রবীণের যৌনজীবনকে আমরা গুরুত্ব দিতে চাই না বরং অবহেলা করি। একাকী প্রবীণ সঙ্গী পেলে বা বিয়ে করলে বেশি ভালো থাকবেন। সমাজের কথা, নিজেদের মানসম্মানের কথা ভেবে প্রবীণকে সঙ্গিহীন রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। একাকী প্রবীণ সঙ্গী পেলে নতুন উদ্যমে ঘরসংসারে মন দেবেন। রোগ-শোক মোকাবিলা করার সাহস পাবেন। একে অপরের জন্য অনেক বেশি আন্তরিক হবেন। নির্ভরশীল একাকী প্রবীণকে স্থানীয়ভাবে দীর্ঘমেয়াদি সেবাদানের কর্মকৌশল গ্রহণ করতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে একাকী প্রবীণ নারী ও পুরুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তারা বিয়ে করতে ইচ্ছুক। একাকী প্রবীণের বিয়ে নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা গভীর নীরবতা রয়েছে। সব পক্ষ নানা অজুহাতে মুখ বন্ধ করে আছে। সুষ্ঠু-স্বাভাবিক জীবনের জন্য একাকী প্রবীণের সঙ্গী এখন সময়ের দাবি।
লেখক : সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম ট্রেজারার, বাংলাদেশ জেরোন্টলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএ)