সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা

ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা
হোজাইমা সারোয়ার

নারী মানেই মা, মেয়ে আর কন্যাসন্তানের সমন্বিত রূপ। যাদের ছাড়া হয় না কোনো কিছুর উন্নতি বা অগ্রগতি, তেমনিভাবে ভাষার জন্যে, দেশের জন্যেও তাদের অবদান ছিলো অনস্বীকার্য। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় শতাব্দীকাল আগেই বলে গেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দেশের আপামর জনতা নেমে এসেছিল রাজপথে। সেই রাজপথে পুরুষদের পাশাপাশি ছিলেন নারীরাও। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। মিছিল, মিটিং থেকে শুরু করে সবখানেই ছিল নারীর সক্রিয় অবস্থান। বিশেষ করে, আন্দোলনের পোস্টার, ব্যানার, কার্টুন লেখায় নারীদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

এটা কোনো কল্পকাহিনী নয়, ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল নারীদের উল্লেখযোগ্য পদচারণা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীরা রাতের আঁধারে নিজেকে গোপন রেখে নানা ধরনের সেøাগান সংবলিত পোস্টার আঁকত রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে। অন্যদিকে মেডিকেলের ছাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায়। কেউবা আবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা সংগ্রহ করেছেন আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে নারীরাই পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে ভাঙে পুলিশের ব্যারিকেড। অনেকেই আবার ছাত্রদের নিজেদের কাছে আগলে রাখে পুলিশের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে অনেক নারীকে খাটতে হয়েছে জেলÑকাউকে আবার ছাড়তে হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

১৯৪৭-এ করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সুপারিশ করা হয়। তখন থেকে ভাষা আন্দোলনের দানা বাঁধে। বাংলাভাষার দাবিকে জোরদার করতে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘তমুদ্দিন মজলিস’ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। অন্দরমহলে অবস্থান করেও আবুল কাসেমের স্ত্রী রাহেলা, বোন রহিমা এবং রাহেলার ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া ভাষা আন্দোলনের জন্য কাজ করে গেছেন।

১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভায় ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, ‘বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে।’ একজন নারীর মুখে এমন সাহসী বাণী উচ্চারণ সত্যিই সবার মনেপ্রাণে-উদ্দীপনা জোগায় যা দুঃসাহসিকতার অবদান রাখে।

১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। রাজপথের সেই মিছিলে সামনের সারিতে অবস্থান ছিল ছাত্রীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের ছাত্রীরা আন্দোলনকে চাঙা করতে অর্থ সংগ্রহ ও রাতভর পোস্টার লেখার কাজ করেন। এদের মধ্যে রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া আহমদ, হালিমা খাতুন, সারা তৈফুর, শামসুন্নাহার আহসান, শরীফা খাতুন, শামসুন নাহার প্রমুখ অন্যতম।

সেই সময়ে পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী আহত হয়। পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার মূল কাজটা রওশন আরা বাচ্চুসহ আরও কয়েকজন ছাত্রীর দ্বারাই সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে ১৯৫২ সালে সুফিয়া আহমদ তুরস্কে পাকিস্তান সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের ছাত্রী সদস্য হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম নারী, যিনি দুইবার জাতিসংঘে কোনো দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

নারীদের ভাষা আন্দোলনের অংশগ্রহণের সবচেয়ে বড় দুঃখের দিন ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ জন ছাত্রী গ্রেপ্তার হয়। শুধু ঢাকার ভেতরেই নারীরা ভাষা নিয়ে আন্দোলন করেননি। বরং তারা পুরো দেশ নিয়ে ভাষা আন্দোলনে একাত্ম হতে গিয়ে অনেকেই পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জের মমতাজ বেগমের নামের সঙ্গে কমবেশি অনেকেই পরিচিত। তার নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলের আগে কখনও নারায়ণগঞ্জে নারীদের মিছিল সংঘটিত হয়েছে বলে জানা যায়নি। সেটিই ছিল নারীদের সংঘটিত প্রথম মিছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কারানির্যাতনের একপর্যায়ে সরকারের চাপে স্বামী তাকে তালাক দেন। তাছাড়া মমতাজ বেগমের ছাত্রী ইলা বকশী, বেনু ধর এবং শাবানীর মতো কিশোরীকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সিলেটের সালেহা বেগম ভাষাশহীদদের স্মরণে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করেন, এ অপরাধের কারণে তাকে স্কুল থেকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। বিশেষ করে চট্টগ্রামের প্রতিভা মুৎসুদ্দী কল্যাণময়ী এ নারী ভাষা সংগ্রামী আমাদের সমাজের এক মহান আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। অপরদিকে সিলেটের ছাত্রীরা আন্দোলনে জোরাল ভূমিকা রাখেন। আন্দোলন ও সংগ্রামের সূতিকাগার বলে খ্যাত কুমিল্লার এক সংগ্রামী নারী অধ্যাপিকা লায়লা নূর। ১৯৪৮ থেকে বায়ান্নর সব আন্দোলনেই ছিল তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। তিনি কারাগারে নির্যাতনের শিকার হন ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করার কারণে। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে নড়াইলে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। সেদিন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানালে সব ছাত্রীদের মধ্যে তিনজন একাত্মতা প্রকাশ করেন ও মিছিলে যোগ দেন। তারা হচ্ছেনÑসুফিয়া খাতুন, রিজিয়া খাতুন ও রুবি।

বাঙালি নারীর অগ্রগতির বড় ধাপ ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া। সে সময়ের পরিস্থিতিতে সব ধরনের সামাজিক, ধর্মীয়, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রীয় বাধা পেরিয়ে ভাষার জন্য রাজপথে অবস্থান করাটা ছিল নারীদের জন্য একটি দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাদের এ সক্রিয় অংশগ্রহণ একটি সচেতন প্রয়াস। ভাষা আন্দোলনে নারীদের ছিল প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অবদান, যা তাদের সাহসিকতাকে আরও সমৃদ্ধ করে। পরবর্তী সময়ে সেই চেতনা ধারণ করেই তারা এগিয়ে যায়, বাংলাদেশের মানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকা আঁকতে। আজও নারীর অবদানে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমরা। চেতনার সেই শক্তিকে ধারণ করে, আমাদের পথচলা হয়ে উঠুক পরিপূর্ণ।

স্বত্ব : আলোকিত বাংলাদেশ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়