প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২১, ২৩:০৫
মানবতার এই ফেরিওয়ালাদের ঘুম নেই
রাত যতই গভীর হোক, ওরা জেগে থাকে। ঘুম ঘুম চোখেও ওরা দৃষ্টি রাখে। কোথাও কোন বৃদ্ধ বাবা অক্সিজেনের অভাবে কাতরাচ্ছেন নাতো? শহরের অপর প্রান্তে করোনার অসহ্য যন্ত্রনায় কোন এক মায়ের প্রশ্বাসে বিঘ্ন ঘটছে নাতো? খবর পেলেই অক্সিজেনের সিলিন্ডার কাঁধে তুলে নিয়ে ওরা ছুটে যায়। মূমুর্ষের মুখে হাসি ফোটায়। নিম্নবিত্ত কোন পরিবার অনাহারে দিন কাটাচ্ছে কি-না সে দুশ্চিন্তাও করতে হয় ওদের। ভাবতে হয় মহামারিতে কেমন আছে পথশিশুরা? সদা জাগ্রত এই ভাবুক তারুণ্যের দলটির নাম 'তারুণ্যের অগ্রদূত'।
|আরো খবর
"তারুণ্যের গর্জন, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস বদলে দিবে আমাদের সমাজ" -এই স্লোগান নিয়ে ২০১৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বর চাঁদপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় তারুণ্যের অগ্রদূত নামক সামাজিক সংগঠনটি। সংগঠনের একঝাঁক তরুণের দলপ্রধান ভিভিয়ান ঘোষ। স্কুল জীবন থেকে জেলা শহরে 'বিতার্কিক ভিভিয়ান' নামে পরিচিত হলেও আজ তার বড় পরিচয় মানবতার ফেরিওয়ালা।
করোনাকালীন দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ঘরে বসে মুঠোফোনে ফেসবুকিং বা গেমস খেলে ওরাও পার করে দিতে পারতো সময়। কিন্তু হৃদয়ে যাদের মানবতার শক্তি পুঞ্জিভূত তারা কি করে ঘরে বসে থাকে? তাই শুরুতে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যানার-ফেস্টুন প্রদর্শন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং মাস্ক বিতরণ করলেও সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নেয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে।
চাঁদপুরের করোনা পরিস্থিতি যে অবনতির দিকে যাচ্ছে, কোন একদিন জেলায় অক্সিজেনের জন্য হাহাকার পড়বে তা সবার আগে উপলব্দি করেছিলো এই তরুণরা। দু'টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ম্যানেজ করে শুরু করেছিলেন বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা কার্যক্রম। কে জানতো ভিভিয়ানদের সেদিনকার উদ্যোগটিই বাঁচাবে জেলার ২৫টিরও বেশি প্রাণ!
চলতি বছর ২৮ এপ্রিল দুটি সিলিন্ডার নিয়ে অক্সিজেন সেবা সার্ভিস শুরু করে সংগঠনটি। এ কাজ করতে গিয়ে মানবিক তরুণরা সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খায় এ বছরের ২ মে। দুপুরে জরুরী নম্বরে বাবুরহাট থেকে কল আসে একজন মূমুর্ষূ রোগীর জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। তড়িঘড়ি করে যখন রওনা হবেন তখনই জানতে পারেন যাকে বাঁচাতে তারুণদের এই সীমাহীন চেষ্টা তিনি আর বেঁচে নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিন হয়তো এই তরুণরা বলেছিলো, ইস! যদি আরেকটু আগে খবর পেতাম!
তারপর আরও সতর্ক হলো তারুণ্যের অগ্রদূত। ওরা বুঝলো অক্সিজেনের ডাক মানেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ। তাই খবর পাওয়ার সাথে সাথে নিজের ব্যক্তি জীবনের কাজ রেখে অন্যের প্রাণ বাঁচাতে ছুটে গিয়েছে ওরা। তেমনই একটি দিন ছিলো ৮ই মে। সদর হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছিলো অক্সিজেন সাপোর্টে থাকা এক রোগীর অক্সিজেন শেষ। হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট, রোগী শ্বাস নিতে পারছেন না। দ্রুত বেগে ছুটে গেলেন দুই তরুণ নূরুল কাদের ও ইমরান। এ যাত্রায় জীবন বাঁচাতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর গিললো তারা।
১৬ই মে ফোনটি আসে শহরের পুরান বাজার থেকে। এক মা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। সিলিন্ডার নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো ওরা। নূরুল কাদেরের সাথে এবার সঙ্গী হলেন অপর তরুণ বাসেদ। বাসায় গিয়ে অক্সিজেন মুখে দিতেই মায়ের বুকে প্রশান্তি নেমে এলো তা দেখা প্রশান্ত হলো এই মানবিক তরুণরা।
১৯ জুন যখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত তখন খবর আসলো করোনায় আক্রান্ত এক রোগীর অক্সিজেন প্রয়োজন। সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া হলো তার স্বজনের কাছে। পহেলা জুলাইয়ের ঘটনাটি একটু ভিন্ন। চাঁদপুরে তখন ঝর বৃষ্টি বইছে। এই বৃষ্টির মধ্যে অক্সিজেন সংকটে ভুগছেন পুরান বাজার মক্কামেল এলাকার এক রোগী। এবার আর ফোন নয়, বৃষ্টিতে ভিজে সশরীরে তারুণ্যের অগ্রদূত কার্যালয়ে উপস্থিত হলেন এক বৃদ্ধ। মায়াবী কণ্ঠে চাইলেন অক্সিজেন সেবা। যেই কথা সেই কাজ। মক্কামেলে পৌঁছে গেলো আরেকটি সিলিন্ডার।
৭ জুলাইয়ের সেবাটি ছিলো আরেকটু কষ্টের। জেলা শহর ছেড়ে সিলিন্ডার পৌঁছাতে হয়েছে শাহরাস্তি উপজেলায়। অক্সিজেনের অভাবে কাতরানো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ভাইয়ের আর্তনাদ মুঠোফোনে সইতে পারেনি ওরা। তাই ছুটে গিয়েছে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
এভাবে ১০ জুলাই চাঁদপুর সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগের সুস্থতায়, ১৩ জুলাই শহরের পুরান বাজার করোনা আক্রান্ত রোগীর বাড়ি, ১৫ জুলাই বাগড়া বাজারে আরেক কোভিড পজেটিভ রোগীর বাড়ি, ১৮ জুলাই স্বামীর জন্য স্ত্রীর অক্সিজেন নিতে আসা, ১৯ জুলাই শহরের গুয়াখোলা এলাকায় করোনা রোগীর সেবায়, ২৫ জুলাই অক্সিজেনের লেভেল ৬০ এর নিচে নেমে যাওয়া আরেক রোগীর সেবায় অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিলো তারা।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৬০ বছরের এক বৃদ্ধ মহিলা যখন বিছানায় কাতরাচ্ছেন, পাচ্ছেন না স্বাভাবিক অক্সিজেন তখন তারুণ্যের অগ্রদূতের ভিভিয়ান ঘোষ অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটে যান ২৭ জুলাই রাতে। ২৯ জুলাই স্বেচ্ছাসেবী দুই তরুণ আরমান ও শরীফ ছুটে যান আরো দু'টি সিলিন্ডার নিয়ে। একটি যায় হাজীগঞ্জ উপজেলায়, অপরটি সদর হাসপাতাল। পরদিন ৩০ জুলাই আরেকটি সিলিন্ডার পৌঁছানো হয় করোনা আক্রান্ত আরেক মায়ের সেবায়।
দিন যতই গড়াচ্ছে অক্সিজেন সেবার তালিকাটি হয়তো আরও বেশি লম্বা হবে। সারাদিন ব্যস্ততা শেষে সবাই রাতে যখন ঘুমায় তখনও তারুণ্যের অগ্রদূতের কোন না কোন তরুণ জেগে থাকেন আরেকটি জরুরী ফোন কলের আশায়। প্রত্যাশা, যদি আরেকজন মানুষের প্রাণ বাঁচানো যায় তবে মন্দ কী?
এই তারুণ্যরাইতো তারা, যারা পথ শিশুদের স্কুল খুলে নিরক্ষরদের অক্ষর জ্ঞান শিখেয়েছেন। শেখাচ্ছেন এখনও। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা তাদের জন্মদিন জানে না বলে বছরে একদিন কেক কেটে পালন করা হয় পথশিশুদের জন্মউৎসব। তাদের দেওয়া হয় জন্মদিনের স্বাদ। 'স্বপ্ন দেখার ক্লাস'-এ চলে শিশুদের সাংস্কৃতিক মেধার প্রতিফলন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জেলার ১৬ জন ভিক্ষুককে অতিথি করে ওরা জানান দিয়েছিলো ইচ্ছা থাকলে শুধু ধনীদের নয়, ধন কুড়ানোদেরও অতিথি করা যায়।
এই তরুণরাইতো তারা যারা স্বউদ্যোগে ত্রাণের প্যাকেট বানিয়ে রমজানে দারিদ্র মানুষের সেহেরি ইফতার নিশ্চিত করেছিলো। এই তারুণ্যরাই রমজানের আগে ও পরে তালিকা করে করে প্রকৃত নিম্নবিত্তদের ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছিলো।
এই তারুণ্যে তারাই যাদের কাছে মৃত্যু পথযাত্রী কেউ কোনদিন রক্ত চেয়ে ফিরেনি। ওদের টগবগে রক্তের লাল ভালোবাসায় আশা ফিরে পেয়েছিলো বহু মূমুর্ষূ। তারুণ্যের এই দলটিই প্রতি বছর শীতে শীতার্থদের পাশে ভালোবেসে দাঁড়ায় নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে। তারুণ্যের উদ্দীপনায় জাগ্রত এই দলটিই প্রতি বছর ঈদ কিংবা পূজায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নতুন পোশাক দিয়ে উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে দেয়।
এই তরুণরাই আবার কোন এক অস্বচ্ছল মায়ের হাতে সেলাই মেশিন তুলে দিয়ে তার সংসার চালানোর অবলম্বন করে দেয়। ওরাই আবার স্বউদ্যোগে শ' তিনেক গাছ লাগিয়ে আগামী প্রজন্মকে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন শেখায়। এরাই জাতীয় দিবসের ডকুমেন্টরি তৈরি করে শিশুদের জানায় বাঙ্গালী, বাংলা ভাষা ও বাংলা দেশের প্রকৃত ইতিহাস।
মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাঁদপুর তারুণ্যের অগ্রদূতের এই মানবিক তরুণদের মত উদ্যমী তরুণ খুব বেশি প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত ওরা ভেবে যায়, সমাজের জন্য ইতিবাচক আর কি করা যায়। কী করলে মিটবে সামাজিকতার দায়? ওরা সাহসী, ওরা নির্ভিক, ওরা নির্ঘুম মানবতার ফেরিওয়ালা।