প্রকাশ : ২৪ মে ২০২২, ০০:০০
গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা সম্পন্ন!
* কোরাম পূর্ণ না হওয়ায় দেড় ঘণ্টা পর সভা শুরু * সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া * নিয়মমাফিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে : জেলা প্রশাসক * গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করার ক্ষমতা সভাপতি-সেক্রেটারীসহ কারোরই নেই : বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অ্যাফিলিয়েটেড অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক আহাম্মদ আলী
ফোন করে ডেকে এনেও নির্ধারিত সময়েও কোরাম পূর্ণ করা যায়নি। সমিতির সদস্য নন, এমন লোক এনে বাইরে জড়ো করা হয়েছে। এমনকি সভাস্থল কিছু বহিরাগতকে দিয়ে পূর্ণ করে তা পরিপূর্ণ দেখানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কোরাম সঙ্কটের মধ্য দিয়েই গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে সম্পন্ন করা হয়েছে চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভা শুরুর নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টার মধ্যে কোরাম পূর্ণ না হলে সভা মুলতবি ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু গঠনতন্ত্রের এই ধারার তোয়াক্কা না করে সভা সম্পন্ন করা হয়েছে। সেজন্যে সভার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালনা পর্যদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা। আর এমন পরিস্থিতি সেবামূলক এই সংগঠনে এই প্রথম ঘটলো। এভাবেই ক্ষোভের সাথে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানালেন চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদধারী ব্যক্তিসহ সদস্যরা। এ ঘটনাকে কারো কারো ব্যক্তিগত অভিলাষ পূরণ করার অপচেষ্টা বলে আখ্যায়িত করেছেন অনেকে।
|আরো খবর
চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতির ৭ম বার্ষিক সাধারণ সভা ছিলো ২১ মে শনিবার। এদিন বিকেল ৩টা ছিলো সভার পূর্ব নির্ধারিত সময়। কিন্তু দেখা গেলো যে, নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও কোরাম পূর্ণ হয়নি। ওদিক দিয়ে সময় চলে গেছে দেড় ঘণ্টা। তখনও কোরাম পূর্ণ হয়নি। সমিতির সদস্য এবং রাজনৈতিক দলের একজন শীর্ষ নেতা অনবরত ফোন করেও উপস্থিতি তেমন একটা করাতে পারেননি। এদিন তাঁর তৎপরতায় বুঝা গেছে নিজস্ব স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নের কোনো খায়েশ ছিল তাঁর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়তো হয়ে ওঠেনি।
সভা বিকেল তিনটায় শুরুর পূর্ব নির্ধারিত সময় থাকলেও সমিতির সভাপতি জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ নিজেই সভাস্থলে ঢুকেন বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের সময়। তিনি সভামঞ্চে আসনগ্রহণ করেন ৪টা ৪২ মিনিটে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে সভা শুরু হয়। সভায় অনিবার্য কারণে উপস্থিত ছিলেন না সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, ৭ম বার্ষিক সাধারণ সভা উদ্যাপন উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও পরিচালনা পর্ষদ সদস্য কাজী শাহাদাতসহ সমিতি পরিচালনা পর্ষদের মোট ২১ জনের মধ্যে ১৫ জন সদস্য। এঁরা হচ্ছেন : সহ-সভাপতি ও পুলিশ সুপার মোঃ মিলন মাহমুদ বিপিএম (বার), সহ-সভাপতি ও সিভিল সার্জন ডাঃ মোহাম্মদ সাহাদাৎ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মোঃ জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. শায়ের গফুর, কোষাধ্যক্ষ এমএ মাসুদ ভূঁইয়া, সদস্য মমিন উল্লা পাটওয়ারী বীর প্রতীক, সুভাষ চন্দ্র রায়, অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খান, ডাঃ সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী, ডাঃ জে আর ওয়াদুদ টিপু, কাজী শাহাদাত, এমএ বারী খান, ডাঃ বিশ্বনাথ পোদ্দার, তমাল কুমার ঘোষ ও ডাঃ এসএম মোস্তাফিজুর রহমান। এঁরা বার্ষিক সাধারণ সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। পরিচালনা পর্ষদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এমন ১৫ জনের অনুপস্থিতিতেই সভাটি সেদিন গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করেই শেষ পর্যন্ত করা হয়েছে।
নির্ধারিত সময়ে কোরাম সঙ্কট এবং সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের অনুপস্থিতিতেই বার্ষিক সাধারণ সভা করা হয়। এটাকে নিয়মবহির্ভূত এবং সংগঠনের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছেন সমিতির বেশ কিছু সদস্য। একইভাবে এই সভার সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিমের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি সেদিন খুবই অসুস্থ ছিলাম। সেজন্য আমি সভায় উপস্থিত থাকতে পারি নাই। উপস্থিত থাকলে হয়তো বলতে পারতাম সভা কখন শুরু হয়েছে। এরপর এই প্রতিবেদক যখন তাঁকে মিটিং শুরু হওয়ার সময় রেকর্ড করা আছে বলে জানালেন এবং এক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রে সময়ের বিষয়টি তাঁর দৃষ্টিতে আনা হলো তখন তিনি বললেন, এদিক থেকে তো তাহলে সভা হয় নাই।
বার্ষিক সাধারণ সভার আহ্বায়ক কাজী শাহাদাত বলেন, অনিবার্য কারণে সভায় আমার উপস্থিত থাকার অপারগতার বিষয়টি আমি লিখিতভাবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে জানিয়েছি। পরবর্তীতে কোরাম পূর্ণ না হওয়ার বিষয়টি প্রামাণ্য হিসেবে জেনেছি। এমতাবস্থায় সভার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট ১ ঘন্টার মধ্যে সভার কোরাম যে পূর্ণ হয়নি সেটি সাধারণ সম্পাদক ও আমার অনুপস্থিতিতে হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ইকবাল আজম) সঞ্চালক হিসেবে সভাটি শুরুর জন্যে অনুমতি নিতে গিয়ে সভাপতি হিসেবে জেলা প্রশাসক মহোদয়কে গঠনতন্ত্র দেখিয়ে সভাটি মুলতবি করার বিষয়টি জানানো উচিত ছিলো। তিনি সেটি কেনো করেননি সেটিই এখন প্রশ্ন।
এ বিষয়ে হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইকবাল আজমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি মহোদয়ের নির্দেশে সভা পরিচালনা করেছি মাত্র। এর বাইরে অন্য কিছু করার এখতিয়ার আমার নেই। সভাপতি মহোদয় বলেছেন সভা পরিচালনা করতে, আমি তাই করেছি। তখন গঠনতন্ত্রের ধারার বিষয় বলাটা আমার জন্য সমীচীন হতো না।
এ বিষয়ে সমিতির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশের সাথে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি গিয়াসউদ্দিন মিলনের কথা হলে তিনি বলেন, কোরাম পূর্ণ হয়নি কথাটি সঠিক নয়। কোরাম পূর্ণ হওয়ার পরই আমরা সভা শুরু করেছি। তখন তাঁকে বলা হয়, গঠনতন্ত্রে কোরাম পূর্ণ হওয়ার জন্যে তো এক ঘন্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। সভা শুরুর পূর্ব নির্ধারিত সময়তো ছিলো ৩টা। কিন্তু আপনারা তো দেড় ঘন্টা পর ৪টা ৪২ মিনিটে সভা শুরু করেছেন। এর জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, আমাদের ব্যস্ততা থাকে, রাষ্ট্রীয় কাজ থাকে। আমরা তো সভার শুরুতেই গিয়ে বসে থাকবো না। অনুষ্ঠানস্থল থেকে যখন আমাকে ফোন করে উপস্থিতি এবং কোরাম পূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করা হয়েছে তখনই আমি এসেছি।
চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় জেলা প্রশাসকের হোয়াটসঅ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জারে লিখেন যে, চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতি সরকারের সমাজসেবা বিভাগ কর্তৃক রেজিস্টার্ড সংগঠন। গত ২১ মে ২০২২ শনিবার এ সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভাটি সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত গঠনতন্ত্রের আলোকে সম্পন্ন হয়নি বলে ছবি আকারে গঠনতন্ত্রের যে অনুচ্ছেদ আপনাকে পাঠালাম তার আলোকে মনে হয়েছে। সাধারণ সভা বিষয়ক এ অনুচ্ছেদের আলোকে সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজনের প্রস্তুতিসহ অনেক কিছু সম্পাদিত হলেও সভাটি সে আলোকে সম্পন্ন হয়নি। সভা শুরুর জন্যে বিতরণকৃত নোটিসে যে সময় অর্থাৎ বিকেল ৩টা উল্লেখ করা হয়েছে, সে সময়ের এক ঘণ্টায় বিকেল ৪টা পর্যন্ত সভাটি বৈধভাবে সম্পন্ন করার জন্যে যে ৭৫জন আজীবন সদস্যের উপস্থিতির অনিবার্যতা ছিলো, সেটা ছিলো না। উপস্থিতির স্বাক্ষর শীট রোববার এনডিসি নেবার পরও আমরা ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে সে সত্যতা পেয়েছি। অতএব সভাটি গঠনতন্ত্রের আলোকে আপনি যাতে মুলতবি করেন সেটি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সভাটির আহ্বায়কের অনুপস্থিতিতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালনকারী চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সমিতির আজীবন সদস্য জনাব ইকবাল আজম কর্তৃক সভা শুরুর অনুমতি গ্রহণের পূর্বে আপনাকে জানানোটা অবশ্য করণীয় ছিলো। তাহলে আপনি গঠনতন্ত্র অনুসরণ করতে পারতেন। জ্ঞাতব্য বিষয় হচ্ছে : জনাব ইকবাল আজম সেটি জানিয়েছিলেন কিনা? আপনাকে সভা চলাকালে কিংবা পূর্বে তিনি গঠনতন্ত্রের কপি দিয়েছিলেন কিনা? তারপরেও সভায় নির্বাচনের বিষয়ে যে কমিটি গঠন হয়েছে, সেটা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হয়েছে কিনা? দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে আমরা উক্ত বার্ষিক সাধারণ সভাটি গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে সম্পন্ন হয়েছে মর্মে একটি সংবাদ পরিবেশন করবো। সেজন্যে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর জবাব প্রদান করলে ভালো হয়। রোববার চাঁদপুর প্রেসক্লাব সভাপতির নিকট প্রদত্ত আপনার বক্তব্যটি খোলসা হয়নি বলে উপরোক্ত প্রশ্নগুলো করলাম। জবাব দিলে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা হবে বলে বিশ্বাস করি। তিনি কাজী শাহাদাতের দীর্ঘ এ লেখার জবাবে বেলা ২টায় খুবই সংক্ষিপ্তভাবে লিখেছেন, নিয়মমাফিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির এফিলিয়েটেড অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক আহাম্মদ আলীর কাছে গঠনতন্ত্রের ১৩ অনুচ্ছেদের ৬ ধারার বিষয়টি উল্লেখ করে ২১ মে অনুষ্ঠিত চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভার বৈধতার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। তিনি এ বিষয়ে স্পষ্ট বলেন, গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করার ক্ষমতা সভাপতি-সেক্রেটারি কারোরই নেই।
উল্লেখ্য, চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতির গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ ১৩-এর ৬নং প্যারায় উল্লেখ রয়েছে, সভা শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টার মধ্যে কোরাম পূর্ণ না হলে সভা মুলতবি ঘোষণা করা হবে এবং পরবর্তী দিন একই সময়ে একই স্থানে অথবা পরবর্তী নতুন তারিখে নতুন নোটিস প্রদানের মাধ্যমে সভা আহ্বান করা যাবে।