রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৪

বাংলাদেশে ই-কমার্সের উত্থান ও চ্যালেঞ্জ

তথ্য-প্রযুক্তিকণ্ঠ ডেস্ক
বাংলাদেশে ই-কমার্সের উত্থান ও চ্যালেঞ্জ

তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের উত্থান এক নতুন অর্থনৈতিক বিপ্লবের সূচনা করেছে। শহর থেকে গ্রাম, তরুণ উদ্যোক্তা থেকে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী সবাই এখন অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। কোভিড-১৯ মহামারির সময় এই খাতের প্রসার আরও ত্বরান্বিত হয়। তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবেলা না করলে এই খাতের স্থায়িত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

ই-কমার্সের সূচনা ও বিকাশ

বাংলাদেশে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে, যখন কিছু ওয়েবসাইট ঘড়ি, মোবাইল এবং ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বিক্রি শুরু করে। তখন অনলাইন কেনাকাটা ছিলো মূলত সৌখিন পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ধীরে ধীরে এই খাত প্রসারিত হয় এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, পোশাক, খাদ্যদ্রব্য, বই, ওষুধসহ নানা পণ্য অনলাইনে বিক্রি শুরু হয়।

বিশেষ করে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় ই-কমার্স খাতে ৩০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটে। মানুষ ঘরে বসে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে শুরু করে এবং ব্যবসায়ীরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজেদের পণ্য তুলে ধরেন। এই সময়েই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্যে ই-কমার্স একটি বড়ো সুযোগ হয়ে উঠে।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে বাংলাদেশে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে। ই-ক্যাবের সদস্য সংখ্যা প্রায় তিন হাজার এবং এই খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ যুক্ত। ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা, ওয়েবসাইট, অ্যাপ এবং মার্কেটপ্লেসÑসব মিলিয়ে একটি বিশাল ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে।

ঢাকার বাইরে কৃষিভিত্তিক ই-কমার্স, হস্তশিল্প, গ্রামীণ পণ্য এবং নারীদের উদ্যোগও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। একজন উদ্যোক্তা এখন গ্রামে বসেই সারা দেশের ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন।

সম্ভাবনা

বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের সম্ভাবনা বিশাল। এর মাধ্যমে শহর-গ্রামের বৈষম্য কমানো সম্ভব। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়ন, দেশীয় পণ্যের প্রসার এবং রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়ানো সম্ভব।

সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি, মোবাইল ব্যাংকিং এবং ইন্টারনেটের বিস্তার এই খাতকে আরও শক্তিশালী করেছে। ভবিষ্যতে এই খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

চ্যালেঞ্জ

তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জ

১. বিশ্বাসযোগ্যতা সংকট

কিছু প্রতারণামূলক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কারণে ক্রেতাদের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। পণ্য না পৌঁছানো, মানহীন পণ্য এবং টাকা ফেরত না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

২. লজিস্টিকস ও ডেলিভারি সমস্যা

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্রুত ও নিরাপদ ডেলিভারি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক সময় পণ্য পৌঁছাতে বিলম্ব হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৩. ডিজিটাল পেমেন্ট ও নিরাপত্তা

অনলাইন পেমেন্টে এখনো অনেকের অনীহা রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা, তথ্য চুরি এবং ট্রানজেকশন জটিলতা অনেককে বাধাগ্রস্ত করে।

৪. নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণের অভাব

ই-কমার্স খাতে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর নীতিমালা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে প্রতারণা রোধ, মান নিয়ন্ত্রণ এবং ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা কঠিন।

৫. প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা

দ্রুতগতির ইন্টারনেট, দক্ষ জনবল এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের অভাব অনেক উদ্যোক্তার জন্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

উত্তরণের উপায়

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্যে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন

সরকারি পর্যায়ে শক্তিশালী নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে কার্যকর অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা চালু করা

ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থাকে সহজ ও নিরাপদ করা

লজিস্টিকস খাতকে আধুনিক ও দক্ষ করে গড়ে তোলা

উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান

সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। যদি সঠিকভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যায়, তাহলে এই খাত দেশের অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে। রপ্তানি, কর্মসংস্থান, এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যমে এটি একটি শক্তিশালী খাত হয়ে উঠতে পারে।

বিশেষ করে গ্রামীণ ও নারীবান্ধব ই-কমার্স উদ্যোগ, কৃষিভিত্তিক পণ্য এবং দেশীয় ব্র্যান্ডের প্রসারে এই খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশে ই-কমার্সের উত্থান একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছে। এটি শুধু প্রযুক্তির ব্যবহার নয়, বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতীক। তবে এই খাতের স্থায়িত্ব ও সফলতা নির্ভর করছে এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সক্ষমতার ওপর। সরকার, উদ্যোক্তা এবং ভোক্তা সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে ই-কমার্স একটি বিশ্বাসযোগ্য, নিরাপদ, এবং সমৃদ্ধ খাত হিসেবে গড়ে উঠে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়