প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৫৪
রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর

গ্রামে-গঞ্জে কিংবা সেকেলে মানুষদের কাছে রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর যেন এক রূপকথার গল্পের মতো। আগেকার দিনে বার লাখ পাওয়ারের পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন না দিলে অনেকের বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফিভার ভালো হতো না। মাংশপেশিতে পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন দেওয়ার ব্যথা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন।
রিউম্যাটিক ফিভার কী
* রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর হৃদপিণ্ডের একটি প্রদাহজনিত রোগ যাতে হৃদপিণ্ড, অস্থিসন্ধি, মস্তিষ্ক ও ত্বক আক্রান্ত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
* গলার অভ্যন্তরে গ্রুপ-এ স্ট্রেপ্টোকক্কাস জাতীয় ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ হলে তা যদি সময়মত চিকিৎসা করা না হয় তবে রিউম্যাটিক ফিভার হয়।
সাধারণত এ ধরনের সংক্রমণের এক থেকে দেড় মাস পরে রিউম্যাটিক ফিভার দেখা দেয়। এটি মূলত দেহের অভ্যন্তরে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধমূলক প্রতিরক্ষা প্রতিক্রিয়ার পরিণাম বা ফলশ্রুতি।
* এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়।
রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বরের লক্ষণ
* জ্বর এবং অস্থিসন্ধির তীব্র ব্যথা এ রোগের সাধারণ উপসর্গ। অস্থিসন্ধির মধ্যে হাঁটু, গোড়ালি, কনুই, মণিবন্ধ উল্লেখযোগ্য। সাধারণত বড় বড় গিঁটের পাশাপাশি ছোট ছোট গিঁটও আক্রান্ত হয়। বড় বড় গিঁটগুলোর ক্ষেত্রে একটা আক্রান্ত হলে আগেরটা ভালো হয়ে যায় এবং এভাবে একটার পর একটা আক্রান্ত হয় ও পূর্ববর্তী অস্থিসন্ধির ব্যথার উপসর্গ দূর হয়ে যায়। এটাকে মাইগ্রেটরি জয়েন্ট পেইন বা ভ্রাম্যমাণ অস্থিসন্ধির ব্যথা নামে অভিহিত করা হয়।
* কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওর হয়। এতে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া এবং হৃৎস্পন্দনের হার বৃদ্ধি পায়।
* শরীরে ক্লান্তি ও অবসন্নতা বাড়ে।
* অস্বাভাবিক অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁকিসহ দৈহিক চলন পরিলক্ষিত হয়।
* ছোট ছোট গোলাপি ও ব্যথাহীন নডিউল দেখা দেয়। এগুলো আক্রান্ত অস্থিসন্ধির কাছাকাছি থাকে।
* হৃদপিণ্ডের আবরণী থলিতে (পেরিকার্ডিয়াম) ফ্লুইড সঞ্চিত হয়।
* হৃদপিণ্ড আকারে বড় হয় এবং নূতন হার্ট সাউন্ড বা হৃদয়-মর্মর শুনতে পাওয়া যায়।
* যে কারুরই রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর হতে পারে। তবে সাধারণত পাঁচ থেকে পনের বছর বয়সী স্কুলগামী শিশুদের বাতজ্বর বেশি হয়। তবে বয়ষ্ক মানুষ এবং তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের বাতজ্বর হতে দেখা যায় না।
রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর সনাক্তের পরীক্ষা
* রক্তের ইএসআর পরীক্ষা : উচ্চমাত্রার ইএসআর সনাক্তকরণ
* রক্তে গ্রুপ-এ স্ট্রেপ্টোকক্কাসের সংক্রমণজনিত অ্যান্টিবডি পরিমাপ যা স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চমাত্রার হয়ে থাকে।
* একটা ইসিজি করানো
* ইকোকার্ডিওগ্রাম
* বুকের এক্স-রে
চিকিৎসা
* উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান। যথা : জ্বর, ব্যথা দূর করার ঔষধ সেবন
* গ্রুপ-এ স্ট্রেপ্টোকক্কাস সংক্রমণ রোধকারী অ্যান্টিবায়োটিক সেবন।
* হার্ট ফেইলিওরের রোগীকে শ্বাসকষ্ট নিরোধক ঔষধ প্রদান
* কনজেস্টিভ কার্ডিয়াক ফেইলিওরে মূত্রকারক ঔষধ প্রদানের মাধ্যমে জলভার কমানো
* হার্টের ভাল্বের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হলে শৈল্য চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া
আক্রান্ত রোগীর বয়স তিরিশ বছর না হওয়া অব্দি বা কমপক্ষে পাঁচ বছর পেনিসিলিন জি ট্যাবলেট সেবন
রোগ প্রতিরোধ
* ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রাখা
* ত্বকে যে কোন সংক্রমণ এবং গলায় জীবাণু সংক্রমণের দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ
* একবার যার বাতজ্বর হয়েছে তাকে পরবর্তীকালে আবার বাতজ্বরে আক্রান্ত না হওয়ার জন্যে সাবধানী প্রয়াসরূপে পেনিসিলিন জি সেবন করতে দেওয়া
* মাংসপেশিতে ১.২ মিলিয়ন শক্তির বেনজাথিন পেনিসিলিন একুশ দিন পর পর একটা করে কয়েকবার প্রয়োগ করা।
বাতজ্বর নির্ণয়ের জোন্স প্রদত্ত মুখ্য নিয়ামক
* কার্ডাইটিস বা হৃৎপেশির প্রদাহ
* একাধিক গিঁটের ব্যথা ও প্রদাহ
* অনিয়ন্ত্রিত মাংশপেশির চলন
* হাতের তালুতে র্যাশ
* চামড়ার নিচে নডিউল
বাতজ্বর নির্ণয়ের জোন্স প্রদত্ত গৌণ নিয়ামক
* জ্বর
* গিঁটে গিঁটে জ্বালা করা
* পূর্বে বাতজ্বর হওয়ার ইতিহাস
* ইএসআর ও সি-রিঅ্যাক্টিভ প্রোটিনের বৃদ্ধি
* ইসিজিতে পি-আর বিস্তার দীর্ঘ হওয়া
* রক্তে গ্রুপ-এ স্ট্রেপ্টোকক্কাস অ্যান্টিবডির উচ্চমাত্রার উপস্থিতি
সিদ্ধান্ত গ্রহণ
দুটি মুখ্য নিয়ামক অথবা একটি মুখ্য নিয়ামক এবং দুটি গৌণ নিয়ামক তার সাথে স্ট্রেপ্টোকক্কাল সংক্রমণের প্রমাণ থাকলে তবে বলা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তি বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফিভারে ভুগছে।