প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৪
মাইকেল মধুসূদন দত্ত : লিভার সিরোসিসের শিকার

অমিত মেধাবী এক সাহিত্যিক ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ – ২৯ জুন ১৮৭৩)। অমিতব্যয়িতা আর শৃঙ্খলাহীন জীবনের দাম চুকাতে চুকাতে তিনি চরম দারিদ্র্যে মাত্র উনপঞ্চাশ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান মৃত্যুহীন দেশে। সার্থক বাংলা নাটকের স্রষ্টা এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তা মদে মত্ত হয়ে দারিদ্র্য ও বেদনা ভুলে থাকতে চেয়ে বারোটা বাজিয়ে দিলেন অকালে তাঁর লিভার নামের মাতৃস্থানীয়া অঙ্গটাকে। মৃত্যুর আগে আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে ঠাঁই পেয়ে প্রথম দিকে শুশ্রূষা এবং ওষুধপত্রের দরুণ তার রোগের কিছুটা উপশম হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অচিরেই তাঁর স্বাস্থ্য অবনতির দিকে এগিয়ে যায়। যকৃৎ, প্লীহা এবং গলার অসুখে তার দেহ অনেক দিন থেকেই জীর্ণ হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময় তার যকৃতের সিরোসিসের জটিলতা থেকে দেখা দিয়েছিল উদরী রোগ। সেই সঙ্গে হৃদরোগের লক্ষণও স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল। সব মিলিয়ে তার শরীর শেষ অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছিল। তাঁর বাল্যবন্ধু গৌর চন্দ্র বসাক হাওড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসলে তাঁকে একদিন দেখতে এসে নিজেই অবাক হয়ে যান। মাইকেলের মুখ দিয়ে সেদিন চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছিলো। উনত্রিশে জুন লিভারের সিরোসিস কবিকে চূড়ান্ত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
লিভার সিরোসিস কী
স্বাভাবিক অবস্থায় সুস্থ লিভার থাকে মসৃণ। কিন্তু লিভারে যখন সিরোসিস হয় তখন তাতে ছোট ছোট অর্বুদ তৈরি হতে পারে, মসৃণতা নষ্ট হয় এবং ফাইব্রোসিসে লিভার আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ লিভারের সারাদেহে ক্ষতচিহ্ন শুকানোর মতো অমসৃণতা তৈরি হয়। ফলে লিভার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায় এবং বিভিন্ন এনজাইম বা উৎসেচক তৈরি ও নিঃসরণ করতে পারে না।
লিভার সিরোসিসের কারণ
* অতিরিক্ত মদ্যপান
* হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের সংক্রমণ
* ফ্যাটি লিভার বা লিভারের গঠন চর্বির মতো থলথলে হয়ে যাওয়া
লিভার সিরোসিসের লক্ষণ
* জন্ডিস
* বমি বমি ভাব ও খাবারে অরুচি
* পেট ফুলে যাওয়া, পেটে পানি জমা
* ওজন হ্রাস পাওয়া
* ত্বকে তীব্র চুলকানি
* শ্রান্তি ও অবসাদ
* রক্তক্ষরণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া
* পায়ে,হাঁটুতে, গোড়ালিতে পানি জমা বা ইডিমা হওয়া
* ত্বকে, বিশেষত পেটের চামড়ায় মাকড়সার মতো রক্তনালীর জালক দেখা দেওয়া (স্পাইডার নেভি)
* ফ্যাকাশে ভঙ্গুর নখ, বিশেষ করে বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনীর নখ
* ঢাকের কাঠির মতো আঙুলের মাথা (ক্লাবিং) হওয়া
* নারীদের মাসিক ঋতুস্রাব স্বাভাবিক রজঃনিবৃত্তির আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়া
* পুরুষের যৌন সক্ষমতা কমে যাওয়া
* অন্ডকোষ কুঁচকে যাওয়া এবং পুরুষদের স্তন স্ফীত হয়ে যাওয়া বা গাইনিকোম্যাস্টিয়া
* বগলের (অ্যাক্সিলা) কেশ ঝড়ে যাওয়া
* ঝিমুনি ভাব, কথা জড়িয়ে যাওয়া এবং বিভ্রান্তি বা কনফিউশনে ভোগা
রোগ নিরূপণী পরীক্ষা
* রক্তের রুটিন পরীক্ষা
* মূত্রের রুটিন পরীক্ষা
* লিভারের কার্যকারিতা পরীক্ষা (লিভার ফাংশন টেস্ট)
* রক্তক্ষরণের সময় ও রক্ত জমাট বাঁধার সময় পরীক্ষণ
* হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষণ
* পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম
* পেটে সঞ্চিত তরলের আণুবীক্ষণিক পরীক্ষা ইত্যাদি।
* তবে রোগ নিরূপণে রোগী ও রোগীর অভিভাবকদের কাছ থেকে রোগের ইতিহাস জেনে নিতে হবে।
লিভার সিরোসিসের পর্যায় : চারটি পর্যায়ে বিভক্ত।
পর্যায় ১ : স্টেটোসিস : পিত্তনালী ও লিভারের প্রদাহ
পর্যায় ২ : প্রদাহজনিত কারণে লিভারে স্কার বা ক্ষত শুকানোর অমসৃণ ফাইব্রোসিস তৈরি হওয়া।
পর্যায় ৩ : সিরোসিস
পর্যায় ৪ : লিভার ফেইল করা
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা
মূলত দাতার দেওয়া লিভারের অংশবিশেষ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে লিভার সিরোসিসের কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব।
লিভার সিরোসিস একটি কঠিন রোগ। এরোগ না হতে দেওয়াই উত্তম। এর জন্য শুরুতে হেপাটাইটিস বি এর স্ক্রিনিং করিয়ে টিকা নিয়ে রাখা জরুরি। পাশাপাশি মাদক হতে দূরে থাকা এবং স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করাই উত্তম। নিরাপদ ও বিশ্বস্ত যৌনজীবন যাপন করা জরুরি। এক সুঁই ও সিরিঞ্জ যাতে কেবল একবারই ব্যবহৃত হয়। শারীরিক শ্রমে ব্যস্ত থাকা এবং ঘঝঅওউ জাতীয় ব্যথানাশক ঔষধের অতিরিক্ত ব্যবহার এড়াতে হবে।