শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সাক্ষাৎকার : ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ

বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় ভূমিকা রাখবে প্রতিষ্ঠানটি

অনলাইন ডেস্ক
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় ভূমিকা রাখবে প্রতিষ্ঠানটি

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মতলব উত্তর উপজেলার অলিপুর গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন তুখোড় মেধাবী। পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সকল শ্রেণিতেই তিনি রোল ১-এর অধিকারী ছিলেন। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় বৃহত্তর মতলবে দ্বিতীয় এবং অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে চাঁদপুর জেলায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। পরে মানবসেবা ব্রত হিসেবে চিকিৎসা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন।

সম্প্রতি ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘চিকিৎসাঙ্গন’ বিভাগের মুখোমুখি হন। এ সময় তিনি তাঁর শিক্ষা জীবন, শিক্ষকতা জীবন ও চিকিৎসাব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন।

সাক্ষাৎকার নেন : আলআমিন হোসাইন।

চাঁদপুর কণ্ঠ : কেমন আছেন?

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : আলহামদুলিল্লাহ মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছি।

চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে কোথায়?

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে মতলব উত্তর উপজেলার অলিপুর গ্রামে।

চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : আমার মা আমার প্রথম শিক্ষাগুরু। মায়ের কাছেই আমি প্রথম বর্ণমালা শিখি এবং প্রিস্কুল শিক্ষা পুরোটাই মায়ের কাছ থেকে গ্রহণ করি। মা প্রতিদিন আমাকে পড়াতেন। তারপর আমি অলিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হই। স্কুলের সকল শিক্ষকবৃন্দ আমাকে খুবই ভালোবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। বিশেষ করে স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুস সোবহান আখন্দ স্যারের কথা না বললেই নয়। তিনি ছিলেন আমার প্রাথমিক শিক্ষাজীবনের মেন্টর। কিন্তু ঘটনাচক্রে দুর্ভাগ্যবশত বছরের মাঝামাঝি সময়ে সোবহান স্যারকে অন্যত্র বদলি করা হয়। স্যার চলে যান। আমাদেরও মন ভেঙ্গে যায়। আমি তখন ৪র্থ শ্রেণিতে। পরে স্কুল বদল করে দূরবর্তী নিশ্চিন্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেখানেও একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে পড়াশোনা করে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হই। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে আমি পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করি। পঞ্চম শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষায় যথারীতি ভালো ফলাফল অর্জন করে প্রতিযোগিতামূলক বৃত্তি পরীক্ষায় বৃহত্তর মতলব (উত্তর ও দক্ষিণ) উপজেলায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করি। তারপর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত নিশ্চিন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। প্রত্যেক ক্লাসেই আমি ফার্স্টবয় (রোল নং : ১) ছিলাম। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই এবং চাঁদপুর জেলার মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি। ১৯৯৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় স্টার মার্কসহ প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই। স্কুল জীবনের লালিত স্বপ্ন ছিলো নটর ডেম কলেজে পড়ার। এসএসসি পাসের পর যথাযথ প্রস্তুতি নিই এবং কৃতিত্বের সাথে নটর ডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এ কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে স্টার মার্ক (৮৬০ নম্বর)সহ প্রথম শ্রেণিতে এইচএসসি পাস করি। তারপর মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার জন্যে সমন্বিতভাবে প্রস্তুতি নিই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টপ সাবজেক্ট (প্রথম ৩২ জনের একজন), বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাই। তিনটি কাঙ্ক্ষিত জায়গায় একই সাথে সুযোগ পাওয়ায় আমি ত্রিমুখী ভাবনায় পড়ে যাই। কোনটা রেখে কোনটায় ভর্তি হবো। যাই হোক, পরে মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরামর্শে এবং নিজের স্বপ্নপূরণে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র-রাজনীতি, বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত করি। বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলনের পথিকৃৎ মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্র-ছাত্রী দ্বারা পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সন্ধানী’তে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। সন্ধানীর একজন সাধারণ সদস্য থেকে বিভিন্ন সম্পাদকের পদে আসীন হয়ে সন্ধানীর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। পরে সমগ্র বাংলাদেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সন্ধানী নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘সন্ধানী কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ’-এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই।

ছাত্রত্ব শেষ করে যখন চিকিৎসক হই তখন ইন্টার্নি চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাই। ২৫তম বিসিএসের মাধ্যমে আমি সরকারি চাকুরিতে যোগদান করি। তারপর কর্মজীবন ও শিক্ষাজীবন পাশাপাশি চলতে থাকে। ২০১৬ সালে সার্জারিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি এফসিপিএস (সার্জারি) অর্জন করি এবং ২০২০ সালে আমেরিকান কলেজ সার্জন্স থেকে সার্জারিতে এফএসিএস লাভ করি।

চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসক এবং শিক্ষক হওয়ার ভাবনাটি সূচনা হলো কীভাবে?

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : প্রত্যেকটি স্বীকৃত সৎ পেশার মাধ্যমেই মানুষের সেবা করা যায়। তবে চিকিৎসা হচ্ছে এমন একটি পেশা যার মাধ্যমে সরাসরি মানবসেবায় সম্পৃক্ত থাকা যায়, যা অন্য পেশায় একটু কঠিনতর হয়। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিলো চিকিৎসক হবো, মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবো, নিজেও সৎভাবে স্বাবলম্বীভাবে চলবো। কিন্তু এইচএসসি পাসের পর একই সাথে মেডিকেল, বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে যাই। কিন্তু চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ আর হাতছাড়া করিনি। আমার স্কুল ছাত্রজীবন থেকেই শিক্ষকতাকে আমি অনেক বড় ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম। আমার মনে হতো শিক্ষকরা হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান। ফলে শিক্ষকতার প্রতিও আমার একটা দুর্বলতা তৈরি হয়। তাই যখন ভাবতাম, আমি একজন চিকিৎসক হবো, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি এমন একজন চিকিৎসক হবো, যেখানে আমি থাকবো একজন চিকিৎসক ও একজন শিক্ষক। সেই ভাবনা থেকেই আমি রয়েল সাবজেক্ট বলে খ্যাত সার্জারি বিষয় বেছে নিলাম। ফলে বর্তমানে আমি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক।

চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসক এবং শিক্ষক হিসেবে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : তখন আমি সদ্য পাশ করা একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক। ইন্টার্নি হিসেবে মেডিসিন ওয়ার্ডে আমার প্রথম অ্যাডমিশন ডিউটি। একের পর এক রোগী ইমার্জেন্সি বিভাগের মাধ্যমে ভর্তি হয়ে ওয়ার্ডে চলে আসছে আর আমরা ইন্টার্নি চিকিৎসক রোগী রিসিভ করে হিস্ট্রি নিচ্ছি, ডায়াগনোসিস করছি ও চিকিৎসা দিচ্ছি। প্রয়োজনে সিনিয়রদের সহায়তা নিচ্ছি। অনেকগুলো রোগী রিসিভ করার পর এমন একজন রোগী পেলাম, যা সচরাচর আমরা ছাত্রজীবনে দেখিনি, কিন্তু মেডিকেল টেক্সট বইয়ে এই রোগ সম্পর্কে পড়াশোনা করেছি। এটা এমন একটা রোগ, যা খুব দেখা যায় না। আমি তখন আমার সহকর্মী ইন্টার্নি চিকিৎসকদের আমার রোগী ও ডায়াগনোসিস সম্পর্কে বললাম, কিন্তু কেউই আমার কথায় কর্ণপাত করলো না। অবশেষে আমার ইউনিটের সহকারী রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রারকে আমার ডায়াগনোসিস সম্পর্কে বললাম কিন্তু কেউই আমাকে পাত্তা দিলেন না। তারা বললেন, তাদের এতো বছরের ডাক্তারি জীবনে কেউই এমন রোগী দেখেনি, তাই আমি যা বলছি তা সঠিক নয়। আমার মন বিষণ্ণ হয়ে গেলো। কিন্তু আমি স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি যে, আমি টেক্সক্ট বইয়ে এই রোগ সম্পর্কে যেসব উপসর্গ পড়েছি সবই উক্ত রোগীর সাথে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা হাল ছাড়লাম না, আমার মাথায় জেদ চাপলো আমি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক স্যারকে এই রোগ সম্পর্কে বলবো, দেখি স্যার কী বলে! অবশেষে সকাল সাড়ে এগারোটার সময় অধ্যাপক স্যার রাউন্ডে এলেন, একে এক সব রোগীর কাছে যাচ্ছেন, দায়িত্বরত সিএ/আইএমও/রেজিস্ট্রার যার যার বেডের রোগী সম্পর্কে স্যারকে ব্রিফিং দিচ্ছেন। স্যার নেক্সট বলে পরের রোগীতে চলে যাচ্ছেন। এভাবে আমার সেই রোগীও প্রায় অতিক্রম করে চলে যাচ্ছেন, আমি তখন সাহস সঞ্চার করে স্যারকে বললাম, স্যার আমি এই রোগী সম্পর্কে একটু বলতে চাই (সাংগঠনিক কাজে ছাত্রজীবন থেকেই জড়িত থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষকই আমায় নাম ধরে চিনতেন)। তখন স্যার বললেন, হারুন কী বলতে চাও বলো। তখন আমি আমার মতো করে স্যাকে ওই রোগী সম্পর্কে ব্রিফিং দিলাম, মনে হয় স্যারকেও একটু চিন্তায় ফেলে দিলাম। স্যার একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। স্যার তখন সিএকে কয়েকটা ইনভেস্টিগেশন করতে বললেন। আর এটাও বললেন, হারুন যেটা ডায়াগনোসিস করেছে, সেটাও মাথায় রেখো। সকাল থেকে এই প্রথম কেউ আমার ডায়াগনোসিসের গুরুত্ব দিলেন, আমিও কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। দুদিন পর যখন ওই রোগীর সকল পরীক্ষার ফলাফল এলো তখন দেখা গেলো, সবই আমার ডায়াগনোসিসের পক্ষে। স্যার আবার সেই রোগীর কাছে গিয়ে বললেন, হারুনের রোগীর কী খবর। সিএ তখন রোগীর উপসর্গ আবার জানালো এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল জানালো। স্যার আমাকে কাছে টেনে নিলেন এবং বললেন, হারুনের ডায়াগনোসিসই সঠিক। তোমরা তো কেউই এটা বুঝতে পারলে না। স্যার আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, হারুন শুধু রাজনীতি করেনি, শুধু সংগঠন নিয়েই পড়ে থাকেনি, সে ঠিকমতো পড়াশোনাও করেছে, তাই এমন বিরল রোগের ডায়াগনোসিস ঠিকমতো করতে পেরেছে। এবার নিজেকে খুবই সার্থক ও সফল মনে হলো। ছাত্রজীবনে রাজনীতি, সংগঠন যাই করেছি, কখনও কোনো শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি করিনি, সবার দোয়া ও সহযোগিতায় আমি বর্তমানের ডাঃ হারুন।

একটি স্মৃতিকথা আমার আজও খুব মনে পড়ে। সেটা হলো, আমার ইন্টার্নশিপ তখন প্রায় শেষের দিকে। একদিন জাতীয় পত্রিকায় দেখলাম একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সার্জারি বিভাগে রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেয়া হবে। পত্রিকাটি সংগ্রহ করে রাখলাম। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকলাম। অনেকটা কৌতূহলবশত প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র ছাড়াই একটি আবেদনের সাথে এসএসসি, এইচএসসি সার্টিফিকেট, মেডিকেল কলেজের প্রশংসাপত্র ও বিএমডিসি অস্থায়ী রেজিস্ট্রেশনের কপি ডাকযোগে ওই মেডিকেল কলেজের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। যেহেতু সকল কাগজপত্র দিতে পারিনি ভেবেছি আমার তো আর ইন্টার্ভিউ কার্ড আসবে না, কিন্তু ঘটলো উলটো ঘটনা। দশদিন পর আমার ইন্টার্নি হোস্টেলের ঠিকানায় আমার নামে ইন্টার্ভিউ কার্ড আসলো। পাঁচদিন পর ইন্টার্ভিউর তারিখ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সশরীরে উপস্থিত থাকতে বলেছে। সকাল ৯টায় ইন্টার্ভিউ। ওয়ার্ড থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে আগের দিন সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড় হয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে উঠলাম। পরদিন যথাসময়ে ইন্টার্ভিউ বোর্ডে হাজির হলাম। গুরুগম্ভীর চেহারার একজন ভদ্রলোক বললেন, আপনার ইন্টার্নশিপ সার্টিফিকেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিবিএস সার্টিফিকেট, বিএমডিসি পারমানেন্ট সার্টিফিকেট কোথায়? আমি বললাম, স্যার এখনো পাইনি। কেনো? আমি বললাম, স্যার আমার ইন্টার্নশিপ শেষ হতে আরো ৩ সপ্তাহ বাকি। ইন্টার্নশিপ সার্টিফিকেট পেলে বাকিগুলো পাবো, হয়তো আরও একমাস সময় লাগবে। একজন স্যার তখন মাথা উঠিয়ে আমাকে বললেন, তাহলে আবেদন করেছেন কেনো? আমি তখন সবিনয়ে বললাম, বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের যে শেষ তারিখের কথা উল্লেখ করা আছে, তখনও আমার ইন্টার্নশিপ শেষ হবে না। ফলে আমি যখন সকল কাগজপত্র পাবো তখন আর এখানে আবেদন করতে পারবো না। তাই অনেকটা আশান্বিত হয়ে এবং কৌতূহলবশত আবেদন করেছি। তখন স্যারসহ বোর্ডের সবাই হেসে ফেললেন এবং আমায় বললেন, আমরা তো এতোদিন অপেক্ষা করবো না। আমাদের এখনই একজন রেজিস্ট্রার দরকার। আমি বললাম, স্যার আমি জানি এই মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান একজন স্বনামধন্য সার্জন এবং বাংলাদেশের একজন সফল সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এই মেডিকেলের নাম আমি অনেক শুনেছি, তাই আমার খুব ইচ্ছে যদি সুযোগ হয় আমি এই মেডিকেলে কাজ করবো। মনে হলো, আমি তাদের একটু প্রভাবিত করতে পেরেছি। এবার বোর্ডের সবাই একে অপরের দিকে তাকালেন। একজন স্যার আমার আবেদনের উপর ‘ওকে’ জাতীয় কিছু লিখে স্বাক্ষর করে বোর্ডের অন্য একজন সদস্যের হাতে দিলেন এবং বললেন, দেখি কী করা যয়। আমি বোর্ড থেকে বেরিয়ে আমার কর্মস্থলে চলে আসলাম। দু সপ্তাহ পর আমার নামে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আসলো ডাকযোগে। খাম খুলে পড়ে দেখলাম, আমাকে তাঁরা মনোনীত করেছেন এবং ১৫ দিন পর যোগদান করতে বলেছেন। দু সপ্তাহ পর যথারীতি প্রথম শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি।

চাঁদপুর কণ্ঠ : চাঁদপুর মেডিকেল কলেজে যোগদান করেছেন কবে?

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের প্রায় শুরু অর্থাৎ ২০১৯ সালে যোগদান করি।

চাঁদপুর কণ্ঠ : এ প্রতিষ্ঠানের সার্বিক দিক নিয়ে কিছু বলুন।

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ ভৌগোলিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। চাঁদপুর, শরীয়তপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় এই প্রতিষ্ঠানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ বছর অতিক্রম করেছে। এটি খুবই উন্নয়নশীল একটি মেডিকেল কলেজ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিয়মিত তাদের পড়াশোনা কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে। শিক্ষকরাও খুবই আন্তরিকভাবে তাদের পাঠদান করছেন। ফলে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত বিভিন্ন পরীক্ষায় তারা খুবই ঈর্ষণীয় ফলাফল করছে। আগামী কয়েক মাস পর এই মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা এমবিবিএস (ফাইনাল) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে এবং চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তারা চাঁদপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবে। ফলে সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যসেবার মান আরো উন্নত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

চাঁদপুর কণ্ঠ : পাঠদান করতে গিয়ে কী কী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন?

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ একটি নতুন মেডিকেল কলেজ। তাই এখানে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখনো মেডিকেল কলেজের নিজস্ব একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন ও নিজস্ব হাসপাতাল তৈরি হয়নি। চাঁদপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে অস্থায়ী ক্যাম্পাসের মাধ্যমে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। রয়েছে পাঠদান কক্ষের অভাব। নেই কোনো অডিটোরিয়াম। হাসপাতালের বিদ্যমান কিছু কক্ষ এবং স্থানীয়ভাবে পিডব্লিউডির মাধ্যমে ছাদে এবং নিচতলায় কিছু শ্রেণিকক্ষ তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে কোনোভাবে কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দও অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝে ত্যাগ স্বীকার করে তাঁদের পাঠদান অব্যাহত রেখেছেন। মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকবৃন্দের পৃথক রুমে বসার ব্যবস্থা থাকার কথা কিন্তু শুরু থেকেই তাঁরা এই প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। তারপর শিক্ষকরা তাদের পদমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে আন্তরিকভাবে পাঠদান ও হাসপাতালে সেবাদান কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে খুশির খবর হলো, গত আগস্ট মাসে উক্ত মেডিকেল কলেজের ১৩২০ কোটি টাকার ডিপিপি প্রজেক্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) সভায় পাশ হয়েছে। আশা করছি, অচিরেই নতুন ক্যাম্পাসের জমি অধিগ্রহণসহ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হবে।

চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষার্থীদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : একজন চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে তখনই খুব সার্থক মনে হয়, যখন দেখি আমার দেয়া চিকিৎসা বা অপারেশনের মাধ্যমে একজন অসুস্থ রোগী, মৃত্যুপথযাত্রী সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছেন। আত্মবিশ্বাসে এবং কৃতজ্ঞতায় আমাদেরকে আশীর্বাদ করছেন, এটা একজন চিকিৎসক হিসেবে খুবই সুখের স্মৃতি। ঠিক একইভাবে আমরা চিকিৎসকরা শতচেষ্টা করেও কিছু রোগীকে সুস্থ করতে পারি না। বিশেষ করে মারাত্মক দুর্ঘটনায় আহত কোনো রোগীকে যখন চোখের সামনে মরে যেতে দেখি তখন আমাদের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ মনে হয়। তখন আমরা চিকিৎসকরা আমাদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারি। এই দৃশ্য সত্যিই আমাদের খুব পীড়িত করে।

শিক্ষকরা তখনই সার্থক, যখন তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা নির্দেশনা মতো পড়াশোনা করে। ভালো ফলাফল করে, নিজেদের শুধু ভালো চিকিৎসক নয়, ভালো মানুষ হিসাবেও তৈরি করে। এর কোনোরূপ ব্যত্যয় হলেই শিক্ষকরা কষ্ট পান।

চাঁদপুর কণ্ঠ : একজন মানবিক চিকিৎসক হওয়ার জন্যে শিক্ষার্থীদের জন্যে আপনার পরামর্শগুলো কী?

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ অর্থাৎ অধ্যয়ন ছাত্রদের প্রধান তপস্যা। একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো : নিয়মিত পড়াশোনা করবে, দিনের কাজ দিনেই শেষ করবে, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখবে, কখনো কারো ক্ষতি করবে না, পরোপকারী হওয়ার চেষ্টা করবে, কোনো ক্ষতিকর নেশায় জড়াবে না, নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলবে, শিক্ষকদের অনুশাসন মেনে চলবে ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। সর্বোপরি, একজন ভালো চিকিৎসক ও একজন ভালো মানুষ হবে।

চাঁদপুর কণ্ঠ : অবসরে কী করেন?

ডাঃ মোঃ হারুন-অর-রশিদ : অবসরে খবর দেখি, খবরের কাগজ পড়ি এবং পরিবারকে সময় দেয়ার চেষ্টা করি। এছাড়া সমাজসেবামূলক কাজ করার চেষ্টা করি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়