শনিবার, ০২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ৩১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুরে রাজনৈতিক মামলায় আসামীদের আটক অভিযান অব্যাহত। যুবলীগ, কৃষকলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৫ নেতা-কর্মী আটক
  •   ছেঁড়া তারে প্রাণ গেল যুবকের
  •   চাঁদপুরে গণঅধিকার পরিষদের ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন
  •   রাজধানীতে কচুয়ার কৃতী সন্তানদের সংবর্ধনা
  •   সম্প্রীতির চমৎকার নিদর্শন আমাদের বাংলাদেশ --------------জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা

অধ্যাপক মোহাম্মদ রুহুল আমিন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা

মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার মানুষের মৌলিক মানববাধিকার। মানুষ অন্যতম জাতির ভাষা শিখলেও মাতৃভাষার মত স্বচ্ছন্দবোধ ও স্বাদ পায় না। মানুষের মধ্যে পরস্পর ভাবের আদান-প্রদান সাধারণত মাতৃভাষাতেই হয়ে থাকে। বিশ্বে প্রচলিত ভাষাসমূহের মধ্যে বাংলাভাষা অন্যতম একটি ভাষা। এ ভাষাটি বিশেষ গুরুত্বের ও মর্যাদার দাবিদার এজন্য যে, এ ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের ছাত্র ও যুবসমাজ বুকের তপ্ত তাজা খুন ঝরিয়েছে এবং জীবন দান করেছে। আর তারা এটি করেছে এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এজন্য এদিনটি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়েছে এবং বাংলা ভাষাও বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়েছে। একুশে ফ্রেব্রুয়ারি শুধু আমাদের গর্বের ও শোকের দিন নয়। অধিকন্ত তা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃতি লাভ করেছে। যাঁরা বাংলা ভাষার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদেরকে আমরা ভক্তিভরে স্মরণ করছি।

আমরা জানি, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি মূলত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই সূত্রপাত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরই ঔপনিবেশিক সরকার বাঙালিদের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত মাতৃভাষা বাংলাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিদানে অনীহা প্রকাশ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও শাসকগোষ্ঠী সংখ্যালঘুর ভাষা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দানের জন্য অপচেষ্টা করে। ফলে ভাষার প্রশ্নে প্রথম প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলন হয় ১৯৪৮ সালে এবং রক্তদানের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ ঘটিয়ে বৈপ্লবিক আকার ধারণ করে ১৯৫২ সালে। এই ভাষা আন্দোলন পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের গতি নির্ণায়ক হিসেবে বাঙালিদের মধ্যে মনোবল ও সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঞ্চার করে- পরিণামে জন্মলাভ করে রক্তস্নাত বাংলাদেশ।

বর্তমান যুগ জাতীয়তাবাদের যুগ। জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করেই আধুনিককালের সকল জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইড্র উইলসনের জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বক্তব্য জাতীয়তাবাদী মনোভাব সৃষ্টিতে সবিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘ঙহব হধঃরড়হ, ঙহব ঝঃধঃব’ নীতির ব্যাপক প্রসার এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার লাভের সংগ্রাম জাতীয়তাবাদী চেতনাকে মজবুত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে প্রচণ্ডভাবে সাহায্য করে। বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়েও জাতীয়তাবাদী অনুপ্রেরনাই মৌল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে বংশগত, ভাষাগত, ভৌগলিক, ধর্মীয়, সাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষার ঐক্য ইত্যাদির ঐক্যবোধ গভীরভাবে কাজ করে। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো ভাষা ও সাংস্কৃতির ঐক্য। জাতি গঠনের ইতিহাসে পাকিস্তান ছিল এক অভিনব পরীক্ষা। এর দু অংশের মাঝখানে ভিন্ন রাষ্ট্র বিদ্যমান থাকায় গঠনতন্ত্রের দিক থেকে এদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ছিল না। এই অদ্ভুত ভৌগলিক অবস্থানহেতু এর দু অংশের সামাজিক কাঠামো পরস্পর বিরোধী উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে উঠে। এককথায় একই দেশের অধিবাসী হয়ে রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুসংহত করার জন্য একক সামাজিক আদর্শে পাকিস্তান গড়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তানের উভয় অংশের মিলনের একমাত্র সেতু ছিল ধর্ম-ইসলাম। ইসলামিক রাষ্ট্র হলেও এর সমাজ ব্যবস্থায় একক আদর্শগত কোন যোগসূত্র ছিল না। এ কারণে পশ্চিম পাকিস্তানীদের মতে বাঙালিরা ‘পুরোপুরি মুসলমান ছিল না’ এবং এ মনোভাবের ফলে পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শের সহিত পূর্বপাকিস্তানের জনগণ কোনদিন একাত্মতা অনুভব করে নাই। Tepper -এর ভাষায় “In the whole range of history of pakistan, The East Pakistanis did not get an opportunity to be loyal Pakistani and true Banglee which they wanted to become”। বাংলাদেশের মুসলমানদের প্রতি পাকিস্তানীদের সামাজিক অবহেলা ও অবজ্ঞা বাঙালিদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে উদ্ধুদ্ধ হয়ে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামে ব্যর্থ হয়ে রক্তাত্ত সশস্ত্র সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ছাড়পত্র ছিনিয়ে আনতে অনুপ্রাণিত করে। বৃথা যায়নি শহীদ বরকত, সালাম, আব্দুল জব্বার, রফিক, শফিউর রহমান, আউয়ালসহ নাম না জানা আরো অনেকের রক্ত, ব্যর্থ হয়নি সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, শ্রমিক ও ছাত্র জনতার আন্দোলন। আমরা চিরদিন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সরণ করব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ আবুল কাশেম, ড. এনামুল হক, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম সামসুদ্দীন, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, শামসুল হক, অলি আহাদ, মহিউদ্দিন আহমদ, আবদুল মতিন বদরুদ্দিন ওমর, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক আব্দুল গফুর, এম.আর. আকতার মুকুল, আলতাফ মাহমুদ, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, কমরুদ্দীন আহমদ, আবব্দুল মালেক (শহীদ বরকতের মামাসহ) শত শত বুদ্ধিজীবী, সকল ছাত্র নেতা ও রাজনীতিবিদদের।

পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিলো দ্বি-জাতি তত্তে¦র ভিত্তিতে, আর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। ভাষা আন্দোলনে সব বাঙালিরা ছিল ঐক্যবদ্ধ। আন্দোলনে গ্রাম-গঞ্জের, শহর-বন্দরের, অফিস-আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবাই স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল যে বাঙালিরা তাদেরকে বঞ্চিত করা, দমন করা কারোও পক্ষে কোনদিন সম্ভব হবেনা বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়