প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
মুজিব দর্শন ভক্তি প্রজ্ঞা ও যুক্তির মেলবন্ধন। আধুনিক যুগেও পৃথিবীময় আপনার দৃষ্টি প্রসারিত করুন, দেখবেন ভূখণ্ডহীন পরাধীন জাতির দুঃখণ্ডদুর্দশা, শুনবেন তাদের হদয়ের আর্তনাদ। পরাধীনতার গ্লানি থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির স্বপ্ন যিনি দেখিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির জীবনে এসেছিলেন আলোকবর্তিকা হয়ে। তার অসামান্য ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকার স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। তার জীবনাচরণে ছিল ভক্তি, শ্রদ্ধা ও যুক্তির মেলবন্ধন। এই তিনটি মানবীয় গুণাবলি তাকে করেছে অনন্য সাধারণ।
বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ বিশ্লেষণ করলে সর্বত্র চোখে পড়ে ভক্তির প্রগাঢ় উপস্থিতি। মনে হয় স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা তাকে বোঝার উপলব্ধি দিয়েছিলেনÍভক্তিতে শ্রষ্টা, ভক্তিতে মুক্তি এবং ভক্তিতেই শক্তি। পিতা-মাতা, গুরুজন এবং শিক্ষাগুরুদের প্রতি ছিল তার অগাধ শ্রদ্ধা ও ভক্তি। গুণীজনদেরকেও বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষক-ভক্তির অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ রেখেছেন টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা জিটি স্কুলের শিক্ষক বেজেন্দ্রনাথ সূত্রধরের ক্ষেত্রে। বঙ্গবন্ধু ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত এই স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও প্রাইমারি স্কুলের সেই শিক্ষক বেজেন্দ্রনাথ সূত্রধরের কথা ভোলেননি। বঙ্গবন্ধু বেজেন্দ্রনাথ সূত্রধরকে ঢাকা আসার জন্য খবর পাঠান। নির্দিষ্ট তারিখে তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য গেটে উপস্থিত হয়ে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চান। বঙ্গবন্ধু তার আগমন বার্তা পেয়ে সব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে তার প্রাইমারি স্কুলজীবনের শিক্ষকের কাছে নিজেই ছুটে আসেন। অতঃপর স্যারের পায়ে হাত দিয়ে সালামের পর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। শিক্ষাগুরুদের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আরো নিদর্শন পাওয়া যায় তার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটিতে। অনেক রাশভারী ও গম্ভীর শিক্ষকও তাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। যেমনটি করতেন গোপালগঞ্জের খ্রিষ্টান মিশনারি হাইস্কুলের শিক্ষক গিরিশ বাবু। শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত বা আদেশকে তিনি যেভাবে শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে মেনে নিতেন, তা ছিল অতুলনীয়। তিনি শিক্ষকদের কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্তও করেছেন। ছাত্রজীবনে তার আদর্শ শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদের প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র জন্য তাকে কাজ করতে দেখা গেছে। পরবর্তী সময়ে তিনি এর দায়িত্বও নিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নোয়াখালী জেলায় এক জনসভায় গিয়েছিলেন। সেখানে সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে একজন বৃদ্ধ শিক্ষক পরিচয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি চান। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর কানে পৌঁছামাত্র বঙ্গবন্ধু শিক্ষক মহোদয়কে তার কাছে নিয়ে আসেন। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। রাতে তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যিনি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তার মৃত্যুতে (৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) বঙ্গবন্ধু এক শোকবাণীতে বলেন, ‘বাংলার কৃতী সন্তান ও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক বসুর মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। বিজ্ঞান ও মানবতার প্রতি তার অবদান মানুষ চিরকাল স্মরণ রাখবে। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।’ শোকবাণীর এই কথাগুলোতে গুণীজনদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। কথাগুলি ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে নিঃসৃত বাক্যগুচ্ছ। প্রজ্ঞা মানব চরিত্রের অত্যন্ত বিরল মানবীয় গুণ। প্রজ্ঞা হলো জ্ঞানের প্রয়োগ। মানবজীবনে জ্ঞানের পরিচর্যায় প্রজ্ঞা প্রস্ফুটিত হয়। জ্ঞান অন্যের কাছ থেকে অর্জন করা যায়, ভাগাভাগিও করা যায়। কিন্তু প্রজ্ঞা লাভ করা যায় নিজের বোধশক্তি দিয়ে। সেটাকে ভাগাভাগিও করা যায় না। প্রজ্ঞা হচ্ছে জ্ঞান যোগ অন্তরদৃষ্টি যোগ দূরদৃষ্টি। এই তিনটির সমন্বয়ে মানুষ স্বতঃর্স্ফূতভাবে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বঙ্গবন্ধু অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যে কতটা প্রজ্ঞাবান ছিলেন তার প্রমাণ মেলে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে। জাতির দুর্দিনে যখন সঠিক দিকনির্দেশনার প্রয়োজন ছিল সেই সময়ে পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু যখন ৭ই মার্চের ভাষণ শেষ করেন, তখন সকলেই বুঝতে পারেন যে, এর চাইতে ভালো দিকনির্দেশনা সম্পন্ন বক্তৃতা আর হতে পারে না। এ বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু একটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছিলেন। তার চ্যালেঞ্জ ছিল জাতিকে চরম ত্যাগ-তিতিক্ষা, যুদ্ধসহ যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রাখা। অন্য দিকে বিশ্ববাসী যাতে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম হিসেবে আখ্যা দিতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা। বঙ্গবন্ধু তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে এই দুটি বিষয়ের সম্মিলন ঘটাতে পেরেছিলেন। তার এই তাৎপর্যময় ভাষণ বর্তমানে বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান পেয়েছে। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে কতটা প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় এই ভাষণকে ইউনেসকো কর্তৃক ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। প্রজ্ঞার গুণেই তিনি ৫০ বছর আগেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। শিক্ষাকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার হাত ধরেই ১৯৭৩ সালে ৫ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইপিইউ) সদস্য পদ লাভ করে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন তিনি।
সঠিক যুক্তি সংবলিত কর্মপন্থা দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে অতিব প্রয়োজনীয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন যুক্তি দিয়ে যে কোনো কাজ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। তার প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তেই যুক্তির প্রমাণ মেলে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিত্ব পান। কিন্তু কয়েক দিন পরই যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রী হন শেখ মুজিবুর রহমান। সাড়ে আট মাস পর ১৯৫৭ সালের ৩০ মে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। মন্ত্রিসভা থেকে তার পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কারণ ছিল দলকে আরো বেশি শক্তিশালী করা। পদত্যাগের পর তিনি সংগঠনকে আরো বেশি সময় দেন। ফলে সেই সংগঠনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় এবং বর্তমানেও দেশের নেতৃত্বে রয়েছে। যুক্তির বিচারেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু সবসময় ছিলেন সোচ্চার। কারণ তিনি জানতেন দুর্নীতির টাকায় কতিপয় সুবিধাবাদী গোষ্ঠি ফুলে ফেঁপে উঠলেও দেশের মানুষের প্রকৃত সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না। পিছিয়ে পড়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন। ব্যাহত হয় সামাজিক শৃঙ্খলা।
স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, সার্বভৌম বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু অবিসংবাদিত নেতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন আদর্শ, সৎ, দেশপ্রেমিক ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। দেশ পরিচালনায় তার জীবন দর্শন, সততা ও বিচক্ষণতা অনুসরণ স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। তার আদর্শের ধারক ও বাহক হতে পারলে ঘটবে জাতির আত্মবিপ্লব। এগিয়ে যাবে দেশ, সমৃদ্ধ হবে জাতি।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।