বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৪

ভূমিকম্পে শিশুরক্ষার কৌশল

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
ভূমিকম্পে শিশুরক্ষার কৌশল

ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং কয়েক সেকেন্ডের তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পাওয়ার আসলেই কোনো প্রযুক্তি আজও আবিষ্কৃত হয়নি তবে আধুনিক কিছু ডিজিটাল প্রযুক্তি ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হলেও ঘরোয়া কিছু পূর্বপ্রস্তুতি, সচেতনতা এবং সতর্কতার মাধ্যমে অনেকটা নিরাপদে থাকা যায়। শিশুদের বেলায় এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বড়দের তুলনায় শিশুরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তাদের শারীরিক সক্ষমতা কম, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিজ্ঞতা সীমিত এবং বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা অপ্রতুল। অধিকাংশ শিশু ভূমিকম্পের মুহূর্তে আতঙ্কিত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, ফলে তাদের আহত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ অবস্থায় মা বা অভিভাবকরা যদি পর্যাপ্ত প্রস্তুত না থাকে, তবে উদ্ধারকাজ জটিল হয়ে পড়ে। তাই ভূমিকম্পের আগে, সময়ে এবং পরে শিশুদের রক্ষা করার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সচেতনতা জরুরি। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলার মূল শক্তি পূর্বপ্রস্তুতি। শিশুকে ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করতে হলে প্রথমেই তাকে বয়স অনুযায়ী সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যেমন ভূমিকম্পে ‘ডাক, কভার অ্যান্ড হোল্ড’ (নিচে ঝুঁকে পড়া, মাথা ঢেকে ফেলা ও শক্তভাবে ধরে রাখা) অনুশীলন শেখানো জরুরি। ঘরে এমন জায়গা চিহ্নিত করতে হবে যেখানে শিশু নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারবে, যেমন মজবুত টেবিল, খোলা স্থান কিংবা কলামের পাশে। একই সঙ্গে ঘরের ভারী আলমারি, বুকশেলফ, টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি দেয়ালে শক্তভাবে আটকানো আছে কি না, তা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ এগুলো ভূমিকম্পে পড়ে শিশুকে মারাত্মকভাবে আহত করতে পারে। পাশাপাশি জরুরি পরিস্থিতির জন্য একটি ইমার্জেন্সি কিট প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে শিশুর ওষুধ, প্রয়োজনীয় খাবার, পানি, ডায়াপার, ফার্স্ট এইড সামগ্রী ও ব্যাটারি লাইট থাকে।

ভূমিকম্প শুরু হলে প্রতিটি সেকেন্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিশুকে শান্ত রাখা ও দ্রুত নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যাওয়া জরুরি। যদি শিশু ঘরের ভিতরে থাকে, তবে তাকে জোরে ধরাধরি করে দৌড়ানোর পরিবর্তে মজবুত টেবিলের নিচে বা দেয়ালের কোণে নিয়ে গিয়ে মাথা ও ঘাড় দুই হাতে ঢেকে বসতে শেখাতে হবে। শিশুকে কাচের জানালা, আলমারি বা ঝুলন্ত লাইটের নিচে যেতে দেওয়া যাবে না। যদি শিশু হাঁটতে না পারে বা খুব ছোট হয়, তবে অভিভাবক শিশুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে দেয়ালের পাশে বসে মাথা দুই হাতে ঢেকে রাখতে পারেন। বাইরে থাকলে খোলা মাঠে বা ভবন থেকে দূরে যেতে হবে। স্কুলে বা ডে-কেয়ারে শিশুটি কোথায় থাকে, সেখানে কী ধরনের সুরক্ষাব্যবস্থা আছে, কোনো জরুরি বহির্গমন পরিকল্পনা আছে কি না, এসব বিষয় অভিভাবকদের জানা আবশ্যক। শিশুকে তার পূর্ণ নাম, বাবা-মায়ের ফোন নম্বর, ঠিকানা মুখস্থ করানোও জরুরি; যাতে বিপদের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে দ্রুত পরিচয় শনাক্ত করা যায়। আবার ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পরই মূল বিপদ শেষ হয় না। তখনো ধ্বংসাবশেষ পড়া, গ্যাস লিক, আগুন লাগা কিংবা ভবনের পুনঃকম্পনের ঝুঁকি থাকে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই শিশুকে নিয়ে দ্রুত খোলা জায়গা বা পূর্বনির্ধারিত নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। বাড়ি বা স্কুলের দেয়ালে ফাটল, মেঝেতে ধস বা সিঁড়ির ক্ষতি দেখা দিলে সেখানে না ফেরাই ভালো। শিশুকে জুতাহীন অবস্থায় হাঁটতে দেওয়া উচিত নয়, কারণ ভাঙা কাচ বা ধাতব অংশে পা কেটে যেতে পারে। যদি শিশু আহত হয় তবে প্রথমেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় ভিড় বা ধ্বংসাবশেষের কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে না। শিশুর ক্ষুধা বা পিপাসা অনুভব করলে জরুরি কিটের খাবার ও পানি দিতে হবে। যদি শিশু মানসিকভাবে আতঙ্কিত থাকে, তবে তাকে গল্প বলা, গানের মাধ্যমে শান্ত করা বা শরীরের উষ্ণতা ধরে রাখতে কোলে নেওয়া উচিত। অভিভাবকরা নিজেরাও শান্ত থাকলে শিশু দ্রুত মানসিক স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত শিশুকে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের কাছাকাছি যেতে নিষেধ করা।

ভূমিকম্পে শিশুদের রক্ষা শুধু দুর্ঘটনার মুহূর্তে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও অব্যাহত সচেতনতার মাধ্যমে সম্ভব। সচেতন অভিভাবক, সুশৃঙ্খল পরিবার ও প্রশিক্ষিত শিশুÑএ তিনটির সমন্বয়ই ভূমিকম্পে শিশুকে নিরাপদ রাখার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

লেখক : অধ্যাপক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়