প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
জাহাঙ্গীর আলম হৃদয়
অপরূপার জন্মদিনে গাইবো মোরা গান/সেই গানে উঠবে মেতে সকল নতুন প্রাণ/আয়রে নবীন, আয়রে প্রবীণ/আয়রে তোরা আয়/এই আকাশে উড়বো সবাই/নেই বাঁধা আজ/বাবা-মায়ের কথামতো অপরূপায় যাই/সুস্থধারার সংস্কৃতি বিকাশে/কাজ করি সবাই/বাবা-মায়ের কথামতো স্কুলে যাই/জীবন গড়ার পাঠশালাতে চলছি সবাই তাই/লেখাপড়া শিখে মোরা বড় হতে চাই/গরিব-দুঃখীর সহায় হবো/হবো তাদের ভাই।/অপরূপার জন্মদিনে গাইবো মোরা গান/সেই গানে উঠবে মেতে সকল নতুন প্রাণ।
২০ জানুয়ারি ২০২২ সাতাশ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে শাহরাস্তি উপজেলার একমাত্র নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন অপরূপা নাট্যগোষ্ঠী যুব ও মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন।
২৬ বছর শেষে ২৭ বছরে পা রেখেছে অপরূপা নাট্যগোষ্ঠী। এ সংগঠন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে সরকারি নিবন্ধনকৃত সংগঠন। ১৯৯৬ সালের ২০ জানুয়ারি আমার উদ্যোগে বেশ ক’জন মিলে খোলা আকাশের নিচে বসে আলোচনাসাপেক্ষে অপরূপা নাট্যগোষ্ঠী যুব ও মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন শাহরাস্তি নামক সংগঠনের যাত্রা শুরু করি। অপরূপার অর্থ হচ্ছে নানান রুপে রূপায়িত।
আমি রোটাঃ জাহাঙ্গীর আলম হৃদয় অপরূপা নাট্যগোষ্ঠী যুব ও মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ভূঁইয়া মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান সুমন প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ভূঁইয়া মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান সুমন দীর্ঘদিন আমার সাথে ছিলেন। বর্তমানে তিনি সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হওয়ায় দূরে আছেন, মাঝে মাঝে খবর নেন।
‘নাটক হোক অসুন্দরের বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ’ স্লোগানে শুরু করি সাংস্কৃতিক চর্চা। আমাদের সংগঠনের প্রথম নাটক ‘ভালোবাসলেই পাওয়া যায় না’, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘ওরা বেঈমান’ রচনা ও নাট্যনির্দেশক আমিই ছিলাম। অভিনয়ে ছিলেন মাসুদ, সুমন, এমরান, সোহাগ, নকুল ও শাহেদা। গ্রামাঞ্চলে নাট্যচর্চা যে খুব কঠিন কাজ, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, কিছু মানুষ এমনভাবে সমালোচনা করতেন, নাটক হারাম। আমার মরহুম পিতা আবদুল খালেক পাটোয়ারীর কাছে শুধু নালিশ দিতেন। বলতেন, আপনার ছেলে এসব কি করছেন। আমার বাবা বলতেন ছেলে আমার বাজে নেশা না করে নাটক ও সুস্থধারার সাংস্কৃতিক চর্চা করছে এতে সমস্যা কোথায়? সে অনেক ইতিহাস।
সংগঠনের সদস্য বাড়াতে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতাম, শিক্ষার্থীদের আহ্বান করতাম, অনেক চেষ্টার পরে বেশ কিছু শিক্ষার্থী পেলাম। তারা হলো : ফয়েজ, সোহাগ, রুবেল, সুমন, হান্নান, মোস্তফা, মঞ্জু, আখের, লাকি, নাছরিন, উর্মি, রোমানা, সাথী, পূজা, অনামিকা আয়শা, শাহনাজ মুন্নি, মেহেদী জামান, অলক, ইকবাল, সাদেক, মিজান প্রমুখ।
এরপর যুক্ত থাকে নতুনমুখ। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ আমরুজ্জামান সবুজ, সিনিয়র সহ-সভাপতি শওকত হোসেন রুবেল, সহ-সভাপতি আতাউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এরশাদ আলম বেপারী, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক জুয়েল, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম নয়ন, দপ্তর সম্পাদক রকি সাহা, প্রচার সম্পাদক আরমান হোসেন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক জয় জিত সরকার, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ফারজানা মুন্নী, নাট্যবিষয়ক সম্পাদক অহনা, সহ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক অনন্যা, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মনির হোসেন অমি, সদস্য রৌশন আরা বেগম, আয়শা আক্তার, জেরিন সুলতানা, তাসনিম আলম জারা প্রমুখ।
অপরূপা নাট্যগোষ্ঠী যুব ও মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন ওদের নিয়ে আমার লেখা এবং পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘ওরা বেঈমান’ চাঁদপুর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা মঞ্চে মঞ্চায়ন করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এরপর ‘দীঘল বাইদের কাশেম’, ‘সুবচন নির্বাসন’, ‘বিপন্ন মানবতা’ ইত্যাদি।
এরপর থেকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সামাজিক আন্দোলন হিসেবে যৌতুকমুক্ত সমাজ, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘আশার আলো’ নাটক উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের স্কুল, গ্রামের উঠোনে পথ-নাটিকা করা হয়।
‘মানুষ মানুষের জন্য’ স্লোগানে কিডনী রোগে আক্রান্ত মেধাবী বেশ ক’জন শিক্ষার্থীর চিকিৎসা সহায়তা তহবিল গঠন করে শাহরাস্তি অপরূপা নাট্যগোষ্ঠী।
২০০৪ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ইউনিসেফের অর্থায়নে শাহরাস্তি উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের স্কুলে, মাঠে, হাট-বাজারে আমার লেখা ‘প্রত্যাশা’ নাটিকা মঞ্চায়ন করি। সহযোগিতায় ছিলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মিজানুর রহমানসহ কর্মকর্তারা।
গ্রামীণ প্রকল্প আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করা, আর আর্সেনিকযুক্ত পানি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে নাটিকা মঞ্চায়ন করা হয়।
এরপর ব্রাকের জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রম এনএনপি ন্যাশনাল নিউটেশনের মাধ্যমে নোয়াখালী পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে নাটকের কর্মশালায় অংশগ্রহণ করা হয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রামীণ প্রকল্প রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং কার্যক্রমে যোগ দিতে কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)তে আমার নেতৃত্বে নাট্য কর্মশালায় অংশ নেয় শাহরাস্তি অপরূপা নাট্যগোষ্ঠীর ২৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। সেখান থেকে ফিরে এসেই গর্ভকালীন মায়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচাতে এবং সচেতন করতে বেশ কিছু নাটিকা মঞ্চায়ন করা হয় শাহরাস্তি ও কচুয়া উপজেলায়।
২০০৬ সালে শাহরাস্তি অপরূপা নাট্যগোষ্ঠী যুব ও মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করে সংগীত প্রতিযোগিতা ‘তোমাকেই খুঁজছে শাহরাস্তি ওয়ান’। যার লক্ষ্য ছিলো শাহরাস্তি উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের গ্রামেগঞ্জে পড়ে থাকা সংগীতপ্রেমিদের খুঁজে বের করা। সফলতার সাথে সেটিও করতে সক্ষম হয়।
যা কিছুই করি না তার মূলেই হচ্ছে টাকা। আমার বাবার পকেটের টাকা, নিজের করা টিউশনির টাকা সব খরচ হয়ে যেতো সংগঠনের নাটকের রিহার্সেলসহ যাবতীয় কাজে। সহায়তাকারী তেমন কেউ ছিলো না।
সংগঠনের সবাই শিক্ষার্থী। তাদের কাছে ১০ টাকা চাইলেও দিতে পারতো না। এককথায় শূন্য হাতেই চলছি। সংগঠনের রিহার্সেল করার কোনো জায়গা ছিলো না। ২০০৫ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল ওয়াদুদ স্যারের কাছে সপ্তাহে একদিন নাটকের রিহার্সেল করার জন্যে উপজেলা পরিষদ ব্যবহার করার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমোদন দেন।
এরপর সাপ্তাহিক নাটকের রিহার্সেল করার জন্যে যে খরচ হতো তা ম্যানেজ করা খুব কষ্টকর ছিলো। বাধ্য হয়ে কিস্তি নিয়েই নাটকের কাজ করতাম।
সামাজিক আন্দোলন করার কারণে অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। নাটক করে জীবন চালানো অনেক কষ্ট, শুধু মনের খোরাক হিসেবে তা করেছি, সাথে সাংবাদিকতা। পরিবারের সবাই বকাবকি করতেন প্রতিনিয়ত। সংগঠনের গতি আনতে ২০০৮ সালে পাড়ি জমাই প্রবাসে। সেখানে বসে আজও মাসিক অফিস ভাড়া দিয়ে যাচ্ছি।
শাহরাস্তি অপরূপা নাট্যগোষ্ঠীর দায়িত্বশীল যারা আছেন তারা হলেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমরুজ্জামান সবুজ, সিনিয়র সহ-সভাপতি শওকত হোসেন রুবেল, সহ-সভাপতি আতাউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এরশাদ আলম বেপারী, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক জুয়েল, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম নয়ন, দপ্তর সম্পাদক রকি সাহা, সাংস্কৃতিক সম্পাদক জয় জিত সরকার, প্রচার সম্পাদক আরমান হোসেন, মহিলা সম্পাদক অন্তরা সরকার, নাট্য সম্পাদক আখের, মঞ্জুর হোসেন, স্বর্ণালী ও হিয়া দে। সদস্য ফয়েজ আহমেদ, সাইফুল ইসলাম সিফাত, কামরুজ্জামান সেন্টু, সাকিল মজুমদার ও রৌশন আরা বেগম।
উপদেষ্টা হিসেবে যাদের আন্তরিকভাবে কাছে পাই তারা হলেন : হাজী আবদুল লতিফ, আয়েত আলী ভূঁইয়া, প্রিন্সিপাল এমএ আউয়াল মজুমদার, কামরুজ্জামান মিন্টু, সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম, মোশারফ হোসেন (সিএফও), ডাঃ মফিজুর রহমান, সফিক মজুমদার, আবদুস সাত্তার, পিপিএম (বার), অ্যাডঃ শামছুল আলম, অ্যাডঃ ইলিয়াস মিন্টু, কাজী হুমায়ুন কবির, শেখ সেলিম, হাসিনা আক্তার, মাসুদ রানা, মঈনুল ইসলাম কাজল, বিপ্লব সাহা, ইমাম হোসেন পাটওয়ারী প্রমুখ।
আসুন, সবাই সুস্থধারার সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে এগিয়ে যাই। সুন্দর সমাজ ও দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করি। ২০২১ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে অপরূপা নাট্যগোষ্ঠী যুব ও মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন সরকারি নিবন্ধন সনদ গ্রহণ করে।