প্রকাশ : ২২ মে ২০২৩, ০০:০০
সাক্ষাৎকার : ডাঃ জয়ন্ত মালাকার
রোগীর আস্থা অর্জন করা সবচেয়ে বেশি জরুরি
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার আড়াইশ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি)। এর আগে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি) ও রেজিস্ট্রার (মেডিসিন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কার্ডিওলজিস্ট ও মেডিসিন রোগে অভিজ্ঞ ডাঃ জয়ন্ত মালাকার সম্প্রতি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘চিকিৎসাঙ্গন’ বিভাগের মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার নেন আলআমিন হোসাইন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কেমন আছেন?
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : ভালো আছি। আমি মনে করি, সবসময় ভালো থাকার চেষ্টা করা একটি চমৎকার চর্চা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে কোথায়?
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : আমার পৈত্রিক নিবাস সাভারের ধামরাই। বাবা ছিলেন সরকারি কলেজের বাংলার শিক্ষক। ফলে বিভিন্ন জেলায় আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : ১৯৯৮ সালে এসএসসি এবং ২০০০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান লাভ করে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিই। সেখানে ২১তম হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। ৫ বছরের এমবিবিএস কোর্স এবং ১ বছরের ইন্টার্নশিপ শেষ হয় ২০০৮ সালের শুরুর দিকে। ২০০৮ থেকে উচ্চতর শিক্ষার বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ শুরু করি। একই সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবৈতনিক অনারারি মেডিকেল অফিসার হিসেবে হৃদরোগ বিভাগে ট্রেনিং শুরু করি। প্রায় এক বছর কার্ডিওলজি বিভাগে এবং ৬ মাস মেডিসিন বিভাগে ট্রেনিং করার পর সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদত্ত প্রাথমিক শর্ত পূরণ সাপেক্ষে (দেড় বছরের ট্রেনিংয়ের আবশ্যকতা) ডিপ্লোমা-ইন-কার্ডিওলজির (ডি-কার্ড) ভর্তি পরীক্ষা দিই এবং বেসরকারি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই। অতঃপর বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরি শুরু করি। উপজেলায় তিন বছর বাধ্যতামূলকভাবে চাকুরি করে এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগে ট্রেনিংয়ের জন্যে ঢাকায় ফিরে যাই। ততদিনে জাতীয় অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ স্যারসহ ডাঃ ফজলে রাব্বী (যাঁর নামকরণকৃত হলে থেকে এমবিবিএস পাস করেছি) প্রমুখের ইতিহাস শুনে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজের এমআরসিপি ডিগ্রি অর্জনের উচ্চাশা পোষণ করতে শুরু করি। এমআরসিপি (ইউকে) ক্লিনিকাল পরীক্ষার ইতিহাসের অন্যতম সর্বোচ্চ স্কোর (১৭০/১৭২) করে এমআরসিপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এমআরসিপি ডিগ্রির রেগুলেশন অনুযায়ী ক্লিনিকাল পার্টে অংশগ্রহণের পূর্বে কমপক্ষে ২ বছর মেডিসিন বিষয়ে ট্রেনিং করা আবশ্যক। সব মিলে কমপক্ষে ৪ বছর সময় প্রয়োজন। একজন চিকিৎসকের দক্ষতা বৃদ্ধির আসলে কোনো সীমারেখা নেই। এরপর আরো উচ্চতর জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে এফসিপিএস (কার্ডিওলজি) কোর্সে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিই। কোর্সটি ৫ বছর এবং তিনটি পর্বে বিভক্ত। অন্যান্য বেসিক বিষয়ের এফসিপিএসের সাথে পার্থক্য হলো এখানে ডিজার্টেশনের বদলে থিসিস ডিফেন্ড করতে হয়। সব মিলিয়ে ১৮ বছর চিকিৎসাসেবা নিয়ে পড়াশোনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেস্টিজিয়াস ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি ফেলোশিপের ১ম ব্যাচে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ায় চলতি বছরের জুলাই মাসে ১ বছর মেয়াদে ফেলোশিপ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে সেখানে যোগদান করবো। কোরিয়ানদের সহযোগিতায় নির্মিত নতুন সুপার স্পেশালাইজ্ড বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কার্ডিয়াক ক্যাথ ল্যাবে ফেলোশিপ সম্পন্ন করে রিং বসানো, পেস মেকার স্থাপন প্রভৃতি বিষয়ে বাংলাদেশের একজন অন্যতম নির্ভরযোগ্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হতে সক্ষম হবো বলে আশাবাদী।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসক হওয়ার ভাবনাটি সূচনা হলো কীভাবে?
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : উন্নয়নশীল দেশে পিতা-মাতার স্বপ্ন থাকে সন্তান কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। মূলত সে চিন্তা থেকেই আমার চিকিৎসক হয়ে উঠা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চাঁদপুরে যোগদান করেছেন কবে?
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : ২০২২ সালের জুন মাসে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চাঁদপুরের চিকিৎসাব্যবস্থার সার্বিক দিক নিয়ে কিছু বলুন।
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : চাঁদপুরের মানুষের অবস্থা সচ্ছল। চিকিৎসাখাতে তারা যথেষ্ট খরচ করে। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, এখানে রোগী এবং চিকিৎসকদের মধ্যে একটি মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছে। চিকিৎসকদের কাছে যারা রোগী পাঠাচ্ছে, তারা সেখান থেকে কমিশন নিচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে শারীরিক যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এটার ফির একটা অংশ কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে যায়। ফলে রোগীর সার্বিক চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে জেলা সিভিল সার্জন অফিস উদ্যোগী হয়ে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে এই রেফারেল ফি’টা কমাতে পারেন। পাশাপাশি ভুয়া চিকিৎসকদের দৌরাত্ম কমাতে হবে। চাঁদপুরে যেহেতু বেসরকারি অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে, তাই এ ব্যবস্থাটি আরো আগেই চালু হওয়ার প্রয়োজন ছিলো বলে মনে করি। প্রদেক্ষপটি নিলে চিকিৎসাব্যয় পঞ্চাশ শতাংশ কমে যাবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার কাছে কোন্ ধরনের রোগী বেশি আসে?
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : বর্তমানে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে আইসিইউতে গুরুতর হার্টঅ্যাটাকে রোগীদের চিকিৎসার হার প্রায় নব্বই শতাংশ। চাঁদপুরের সচ্ছল মানুষেরা কিন্তু বেশির ভাগই ঢাকায় চলে যান চিকিৎসাসেবা নিতে। এর বাইরে বিশেষ করে বিভিন্ন উপজেলার মানুষেরা আসেন আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে। আমরা যদি চিকিৎসাসেবা প্রদানের মাধ্যমে রোগীদের আস্থা অর্জন করতে পারি, তাহলে মানুষ ঢাকা কিংবা অন্য কোথায় না গিয়ে এখানে তাদের চিকিৎসাসেবা নিতে আসবেন বলে দৃঢ় বিশ্বাস করি। বর্তমানে শহরের মানুষ সেবা নিতে সদর হাসপাতালে আসছেন। আমাদের এখানে সফলতার হার নব্বই শতাংশ। এখানে আইসিইউ ব্যবস্থা ভালো। দিন দিন সেবার মান উন্নত হচ্ছে। চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে জ্ঞানের পাশাপাশি রোগীর মনের অবস্থা বোঝা এবং তাদের আস্থা অর্জন করা সমান জরুরি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : রোগীদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কি?
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : রোগীদের অবশ্যই চিকিৎসকের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। চিকিৎসকই সিদ্ধান্ত নিবেন রোগীর উন্নত চিকিৎসার জন্য কী কী করতে হবে। রোগী কিংবা তাদের স্বজনরা যখন অস্থির হয়ে পড়েন তখন চিকিৎসক আগ্রহ সহকারে সেবা দিতে পারেন না। চিকিৎসকদের ওপর আস্থা রাখলে রোগীদেরই উপকার।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসাজীবনের একটি সুখের এবং একটি দুঃখের স্মৃতির কথা বলুন।
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : কেউ সেবা পেয়ে কীভাবে মূল্যায়ন করবে সেটা তার চিন্তা, দক্ষতা এবং শিক্ষার উপর নির্ভর করে। সুতরাং আপনি সেবা দিয়ে তার সমপরিমাণ প্রাপ্তি প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। সেবা দিয়ে কখনই রিটার্ন আশা করা যাবে না। অত্যন্ত দুঃখের কথা হলো, যেখানে আশা হয়, রোগীদের যে কোনো প্রয়োজনে চিকিৎসকরা দ্রুত সেবা প্রদান করবেন, সেখানে চিকিৎসকদের আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সেখানে তা কতটা যৌক্তিক? কোনো চিকিৎসক যদি ভাড়া বাসায় থাকেন এবং সেটা যদি হাসপাতাল থেকে দূরে হয়, তাহলে রোগীদের সেবায় সঠিক সময়ে কীভাবে আসবেন? এজন্যে চিকিৎসকদের আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : রোগমুক্ত জীবনযাপন করতে সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : রোগমুক্ত জীবনযাপনের জন্যে অবশ্যই ব্যয়াম করতে হবে। ফাস্টফুড বর্জন করতে হবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি আপনি লিখেন, আপনার লেখা দুটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, এ বিষয়ে কিছু বলুন।
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : মানুষের মেধা স্থায়ী কোনো সম্পদ নয়, এটাকে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে শানিত করতে হবে। আমি চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত শিখতে। পাশাপাশি লেখালেখি করি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকাবস্থায় মেডিসিন এবং হৃদরোগে অভিজ্ঞ আমার সিনিয়রদের সাথে বই লেখার কাজে জড়িয়ে পড়ি। বর্তমানে আমার অনুজ চিকিৎসকদের সহযোগিতায় লেখা আরো দুটো বই প্রকাশ হতে যাচ্ছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : অবসরে কী করেন?
ডাঃ জয়ন্ত মালাকার : আমার সখ শরীর চর্চা। তাই অবসরে জিম করি। বই পড়ি। সকালে ঘুম থেকে উঠে অনলাইনে অধিকাংশ পত্রিকা পড়ি।