প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
উদার গহ্বরে পাকস্থলীর নিচে এবং ডিউডেনাম থেকে প্লীহা পর্যন্ত বিস্তৃত পাতার মতো অনিয়ত আকার-বিশিষ্ট গোলাপি রংয়ের গ্রন্থির নাম অগ্ন্যাশয়। রক্তে শর্করার সঠিক মাত্রা বজায় রাখতে এটি ইনসুলিন নামক হরমোন উৎপন্ন করে। এই গ্রন্থিটি যখন অত্যন্ত ধীরগতিসম্পন্ন হয় এবং ইনসুলিন উৎপাদনের মাত্রা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হয়। তখন রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। রক্তে শর্করার মাত্রা একটি নির্দিষ্ট লেভেল অতিক্রম করলে এ অবস্থাকে মধুমেহ বা উরধনবঃবং বলে।
চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের মতে, ডায়াবেটিস ক্যান্সারের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়। কারণ অল্পসংখ্যক লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং ব্লাড ক্যান্সার ছাড়া অন্য যে কোনো ক্যান্সার শরীরের একটি নির্দিষ্ট অঙ্গে আক্রান্ত হয়। কিন্তু বিশ্বের এক বিশাল জনগোষ্ঠী এ ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত। এই রোগ দেহের একের পর একটি অঙ্গকে আক্রান্ত করতে থাকে। এই রোগ কিডনি, হার্ট, লিভার, ব্রেন, চোখের রেটিনা ইত্যাদি অঙ্গ আক্রান্ত হতে শুরু করে এবং ক্ষতস্থানের ঘা সহজে শুকায় না। পিতাণ্ডমাতার যে কোনো একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে তাদের থেকে আগত শিশু কোনো না কোনো সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে। অন্ধ, বধির, বোবা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি এ ধরনের দম্পতির ক্ষেত্রে সন্তান গর্ভধারণের পূর্বে এবং সন্তান গর্ভে থাকাবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।
ডায়াবেটিসের লক্ষণ
অধিক ক্লান্তি, অপরিমিত তৃষ্ণা এবং পায়ের গোড়ালীর মাংসপেশী ক্রমাগত ব্যথা করতে থাকলে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা উচিত।
ডায়াবেটিসের মূল কারণ
* টেনশন ও হাইপ্রেশার : যে সকল লোক এই সব সমস্যায় ভোগেন তাদের শরীরে মারাত্মক রকমের গোলযোগ দেখা দেয়। এতে রক্তে গ্লুকোজ বিপাকক্রিয়া ব্যঘাত ঘটে। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। ডায়াবেটিস বাড়ার সাথে সাথে কিডনি অকেজো হতে থাকে। এই অবস্থায় প্র¯্রাব পরীক্ষা করলে প্র¯্রাবে গ্লুকোজ দেখা দেয়।
* অতিরিক্ত উত্তেজনা : শরীরের উত্তেজনা যখন বেড়ে যায় অথবা শরীরে যখন বেশি উদ্দীপনার প্রয়োজন হয়। তখন শরীরের বিভিন্ন অংশে বেশি পরিমাণ শর্করা ও শক্তি পৌঁছে যায় এবং বেশি পরিমাণ ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই সময় এড্রিনাল গ্রন্থির নির্দেশে অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি ইনসুলিন উৎপাদনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এক সময় এই গ্রন্থিটি অত্যন্ত ধীরগতিসম্পন্ন হয় এবং ইনসুলিন উৎপাদনের মাত্রা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হয়। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। যাদের শরীরে ওজন কম কিন্তু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তারা সামান্য কিছুতেই উত্তেজিত হয়ে উঠেন। তাদের ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে অগ্ন্যাশয়গ্রন্থিকে কার্যকর করার সাথে সাথে উত্তেজনা প্রশমনের জন্যে এড্রিনাল গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। সেই সাথে উত্তেজনার কারণ গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
যে সমস্ত গর্ভবতী মা যে কোনো কারণে বেশি উত্তেজনায় ভোগেন, তাদের গর্ভস্থ সন্তান জন্মের পর পরই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
* অনিয়ন্ত্রিত জীবনব্যবস্থা : যারা অধিক খাদ্য (বিশেষ করে মিষ্টি ও শর্করা-জাতীয়) গ্রহণ করে, নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম (ব্যায়াম) করে না এবং অনিয়মিত নিদ্রা যায় তাদের অগ্ন্যাশয় গ্রন্থিকে অধিক কাজ করতে হয়। এক সময় তা ক্লান্ত হয়ে ধীরগতিসম্পন্ন হয় এবং ইনসুলিন উৎপাদন হ্রাস পায়। ফলে রক্তে গ্লুকোজের লেভেল বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
* দেহের অতিরিক্ত তাপ : কোনো কারণে দেহের তাপ বেড়ে গেলে তা অগ্ন্যাশয় গ্রন্থিকে আক্রান্ত করে। এর ফলশ্রুতিতে ইনসুলিন উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। এই ক্ষেত্রে রোগী প্রচণ্ড তৃষ্ণা অনুভব করে।
কোনো কারণে অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি অধিক সক্রিয় হলে রক্তে গ্লুকোজ ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে মস্তিষ্ক ও মস্তিষ্কের তরলে (স্পাইনাল ফ্লুইড) প্রয়োজন মতো গ্লুকোজ পৌঁছতে পারে না। এ কারণে প্রায়ই মাথার এক পাশের্^ (মাইগ্রেনের সমস্যা) ব্যথা করতে থাকে। এই ব্যথা দূর করার জন্যে নিয়মিত ব্যথানাশক ঔষধ সেবন করতে হয়। যা কিডনীর সমস্যা ও অন্ত্রে আলসার হওয়ার কারণ হয়।
আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানের মতে, অগ্ন্যাশয় গ্রন্থিকে পুনরায় সক্রিয় করা সম্ভব নয়। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্যে রোগীকে আজীবন ঔষধ সেবন করতে হয়। কিন্তু আকুপ্রেশার চিকিৎসার সাহায্যে সরাসরি অগ্ন্যাশয় গ্রন্থিকে সক্রিয় করে ইনসুলিন উৎপাদন মাত্রা স্বাভাবিক করা যায়। কোনোরূপ ঔষধ ব্যবহার ছাড়াই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
চিকিৎসা
ডায়াবেটিসকে ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। এর মূল কারণগুলো সনাক্ত হওয়ার পর এগুলো দূর করতে পারলেই ইনশাআল্লাহ ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
সমাধানের উপায়
* টেনশন দূর করার উপায় : পায়ের মধ্যমা আঙ্গুলের গোড়ায় চাপ দিলে অসহ্য ব্যথা অনুভূত হলে রোগী ভেঙ্গে পড়তে চলছেন। তাৎক্ষণিক রোগীকে চিৎ করে শোয়িয়ে দিন। পরে আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী দু পায়ের মধ্যমা আঙ্গুলের গোড়ায় রাবারের ব্যান্ডেজ পরিয়ে দিন। অল্প সময়ের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা দূর হয়ে যাবে।
* উত্তেজনা দূর করার উপায় : কোনো কারণে দেহের উত্তেজনা বেড়ে গেলে সাথে সাথে দু পা লম্বা করে দু হাত লম্বাভাবে রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন। ১০ থেকে ১৫ মিনিট এভাবে শুয়ে থাকুন।
* হাইপ্রেশারের চিকিৎসা : ৪, ৭, ৮ ও ২৮নং বিন্দুতে দিনে দুবার আকুপ্রেশার চিকিৎসা করেন।
* দেহের অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয়ার উপায় : যাদের শরীরে উত্তাপ খুব বেশি, তাদের হজমশক্তি দুর্বল। তারা বিভিন্ন প্রকার শরীরিক সমস্যায় ভোগেন। চিকিৎসার শুরুতে শরীরের বাড়তি উত্তাপ বের করে দিতে হবে। ১ চামচ হরিতকি চূর্ণ ১ কাপ পানিতে মিশিয়ে (প্রয়োজনে ১ চামচ চিনি দেয়া যেতে পারে) সকাল বেলা খালি পেটে ১০-১২ দিন পান করতে হবে। তারপর সপ্তাহে দু/এক দিন নিয়মিত পান করলে শরীরের বাড়তি উত্তাপ বের হয়ে যাবে। এতে পেট পরিষ্কার থাকবে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যজনিত অনেক সমস্যারও সমাধান হবে। যাদের শরীরে পিত্তাধিক্যের সমস্যা আছে, তারা যদি উপরের নিয়মে পান করেন, তবে পিত্তাধিক্য কমে যাবে। তাছাড়া যদি এই পাউডার খালি পেটে হালকা গরম পানির সাথে মিশিয়ে ৪৫ থেকে ৬০ দিন পান করেন, তাহলে দেহের মেদ অনেক কমে যাবে। এর মধ্যে দু-এক বার পাতলা পায়খানা হতে পারে। এ রকম হলেও ঔষধ খাওয়ার প্রয়োজন নাই। খাওয়ার স্যালাইন ও হালকা খাবার খেলেই চলবে।
* নবাগত শিশুর ডায়াবেটিস : যদি পিতাণ্ডমাতার যে কোনো একজন অথবা উভয়ই মারাত্মক ডায়াবেটিসে ভোগেন তবে তাদের থেকে আগত শিশুর ডায়াবেটিস হওয়ার খুব বেশি সম্ভাবনা থাকে। সে ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি শিশুর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে এর জন্যে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করা উচিত।
ডাায়বেটিসের চিকিৎসা
ক) প্রথমে মূল কারণগুলোর চিকিৎসা করেন।
খ) ৮, ২৫ ও ২৮নং বিন্দুতে দিনে দুবার চিকিৎসা করলে ইনশাআল্লাহ কয়েক দিনের মধ্যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসবে। যদি ডায়াবেটিসের মাত্রা ১০-এর উপরে হয় তখন এই বিন্দুগুলোর সাথে ১৬নং বিন্দুতে চাপ দিতে হবে।
গ) দুটি ঢেঁড়স লম্বা লম্বিভাবে কেটে আধা গ্লাস পানিতে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন এবং পরের দিন সকালে ঢেঁড়স দুটি চিপে ছোবলা ফেলে দিন এবং এই পানি সকালে খালি পেটে এক মাস পান করুন। তারপর মাঝে মাঝে পান করুন। (চলবে)
অধ্যাপক কে. এম. মেছবাহ্ উদ্দিন : বিভাগীয় প্রধান, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ফরিদগঞ্জ বঙ্গবন্ধু সরকারি ডিগ্রি কলেজ। ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]