প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
ইংরেজি প্রবাদটির কথা ভোলা যায় না। যিনি বলেছিলেন, ‘এভরিথিং ইজ ইয়েলো টু এ জন্ডিসড আই’, তিনি যে কী পরিমাণ জ্ঞানী ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যার জন্ডিস হয়েছে সে জানে কী ভোগান্তির সে অবস্থা! হলুদের সাথে জন্ডিসের সম্পর্ক অতি নিবিড়। জন্ডিস মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে লিভারের চিন্তায়। জন্ডিসের যে জীবাণু তা মূলত পানিবাহিত হয়ে বিস্তার লাভ করে। তাই জন্ডিসের জীবাণু বিস্তারে বর্ষার ভূমিকা নিবিড়। বর্ষায় মাঠ-ঘাট, আঙ্গিনা-উঠোন সবটাই জলমগ্ন থাকে এবং এই অবস্থার কারণে জন্ডিসের জীবাণু সহজেই বিস্তার লাভ করে।
জন্ডিস কী?
জন্ডিস মূলত কোনো রোগ নয়, তবে রোগের উপসর্গ বটে। জন্ডিস মানবদেহের অভ্যন্তরের ত্রুটি বা রোগের দৃশ্যমান প্রজ্ঞাপন। সাধারণত এতে দেহের ত্বক, চোখের ঝপষবৎধ, হাতের তালু, মিউকাস ঝিল্লি ইত্যাদি হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং রক্তে বিলিরুবিন নামক একপ্রকার বর্ণ রঞ্জকের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পায়। রক্তে বিলিরুবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ১.১ মিলিগ্রাম/প্রতি ডেসিলিটার রক্তে। যদি কোনো কারণে এর চেয়ে বিলিরুবিনের মাত্রা রক্তে বেড়ে যায় তবে তাকে জন্ডিস বলা যায়। যদি রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা তিন বা তার বেশি হয় তবে তা চোখের ঝপষবৎধ হলুদ বর্ণ করে তোলে।
জন্ডিসের কারণ
* জীবাণুজনিত কারণ : পানিতে যদি হেপাটাইটিস ‘এ’ ও হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস থাকে তবে ওই পানি সেবনে জন্ডিস হয়। একে ভাইরাল হেপাটাইটিস বলে।
* রক্তজনিত কারণ : রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন ভেঙ্গে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বাড়লে তাকে হেমোলাইটিক জন্ডিস বলে। এই জন্ডিসে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা পাঁচ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার রক্ত-এর চেয়ে বেশি বাড়ে না। ম্যালেরিয়া জীবাণু সংক্রমণ এবং থ্যালাসেমিয়াজনিত রোগে রক্তে এ রকম জন্ডিস দেখা যায়।
* লিভারজনিত কারণ : যদি কোনো কারণে লিভারের কোষে পরিবর্তন সাধিত হয় এবং এই কারণে জন্ডিস হয় তবে তাকে হেপাটোসেলুলার জন্ডিস বলে। এই জন্ডিসে বিলিরুবিনের মাত্রা রক্তে মাঝামাঝি তথা দশ হতে পনের মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার রক্ত পর্যন্ত হতে পারে। লিভার প্যারেনকাইমা কোষের পরিবর্তনে এই জন্ডিস হয়।
* পিত্তপ্রবাহে বাধাজনিত কারণ : যদি কোনো পিত্তথলির পাথর, টিউমার, পিত্তনালীতে কৃমি আটকে পিত্তপ্রবাহের পথ রুদ্ধ হওয়া কিংবা অগ্ন্যাশয়ের মাথায় টিউমারের কারণে পিত্তের স্বাভাবিক পথ বন্ধ হয়ে যায় তখন রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে যায়। একে অবস্ট্রাক্টিভ জন্ডিস বা পিত্তপ্রবাহ বিঘœজনিত জন্ডিস বলে।
* অ্যালকোহল সেবন ও মাদকাসক্তি।
* কতিপয় লিভারের ক্ষতিকারক ঔষধ-ড্রাগ সেবন।
জন্ডিসের লক্ষণ
* ত্বক, চোখের শে^ত মণ্ডল, মিউকাস ঝিল্লি, হাতের তালু হলুদ বা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
* বমি বমি ভাব ও বমি হয়।
* খাবারে অরুচি হয়।
* খাবারে গন্ধ গন্ধ অনুভূতি হয়।
* ওজন হ্রাস পায়।
* মাটি বর্ণের ফ্যাকাশে মল হয়।
* পেটে ব্যথা অনুভব হয়।
* কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।
* প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর ও শরীর ব্যথা ব্যথা অনুভব হয়।
* মারাত্মক অবস্থায় কোমা দেখা দিতে পারে।
জন্ডিসের পরীক্ষা
* লিভার ফাংকশন টেস্ট
* লিভার ও পিত্ততন্ত্রের আল্ট্রাসনোগ্রাম
* রক্ত ও মূত্রের রুটিন পরীক্ষা
* রক্তের প্রোথম্বিন টাইম ও এপিটিটি পরীক্ষা
জন্ডিসের চিকিৎসা
* সম্পূর্ণ বিশ্রাম
* আমিষ খাদ্য বর্জন
* নিয়মিত মল ত্যাগের ব্যবস্থা প্রদান
* ক্ষেত্রবিশেষে অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিসে ভিটামিন ‘কে’-সমৃদ্ধ ইঞ্জেকশন সেবন করা যাতে ভিটামিন ‘কে’ ঘাটতিজনিত কারণে লিভারের অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ না ঘটে।
* মূল কারণ অনুসন্ধান ও তার চিকিৎসা। যেমন : ম্যালেরিয়ায় উপযুক্ত ঔষধ সেবন। ক্যান্সার বা টিউমারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত শৈল্যচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
* পিত্তথলির পাথর অপসারণ
* উপযুক্ত পদ্ধতিতে কৃমি অপসারণ।
জটিলতা
* হেপাটিক ফেইলিওর
* হেপাটিক এনকেফালোপ্যাথি
প্রতিরোধ
* স্ট্রিট ফুড না খাওয়া
* নিরাপদ পানি পান করা
* রক্তগ্রহণকালে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস স্ক্রিনিং করা
* হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের টিকা গ্রহণ
* হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে অনিরাপদ যৌনমিলন হতে দূরে থাকা।