প্রকাশ : ৩০ মে ২০২২, ০০:০০
মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর হতে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও গ্রন্থিগুলো বিকশিত হওয়া শুরু করে। বড় ধরনের কোনো রোগ-শাক অথবা দুর্ঘটনা না ঘটলে আঠারো থেকে একুশ বছর বয়সের মধ্যে সবগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও গ্রন্থি পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়। একুশ থেকে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত দেহের অঙ্গগুলো স্থিতিশীল থাকে এবং এ সময়ের মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট হয়। চল্লিশ বছরের পর কিছু কিছু অঙ্গের শিথিলতা শুরু হয়। কিন্তু পঞ্চাশ বছর বয়সের পর শরীরের প্রায় সবগুলো অঙ্গের শিথিলতা শুরু হয়ে যায়।
গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সমস্ত লোক পরিশ্রমী, সদা হাসিমুখ এবং যে কোনো প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করতে সক্ষম তাদের শরীরের অঙ্গগুলো দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকে এবং বার্ধক্যেও তারা সতেজ থাকেন। কিন্তু যে সকল লোক তেমন পরিশ্রমী নন, গম্ভীর প্রকৃতির হয় এবং প্রতিকূল অবস্থায় ভেঙ্গে পড়েন তারা চল্লিশ বছর বয়সের পর দ্রুত বার্ধক্যে পৌঁছে যান এবং তাদের দেহ ও মন নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
বৃদ্ধদের সাথে পরিবারের সদস্যদের সম্পর্ক
বৃদ্ধদের সাথে পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যবহারের উপর তাদের শরীরের সক্রিয়তা নির্ভর করে। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এলেন লিঙ্গার ও বকা লুবি চীন এবং আমেরিকার বৃদ্ধদের উপর গবেষণা করেন। এতে দেখা গেছে, আমেরিকার বৃদ্ধদের তুলনায় চীনের বৃদ্ধদের মেধা, প্রজ্ঞা দূরদর্শিতা ও কর্মক্ষমতা অনেক বেশি। এর কারণ হচ্ছে চীনারা তাদের বয়ষ্কদের সম্মান করে এবং তাদের ব্যাপারে সম্মানজনকভাবে আলোচনা করে। কিন্তু আমেরিকায় বৃদ্ধদের অসম্মান করা হয়। উপরোক্ত গবেষকগণ এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন যে, বয়ষ্ক ব্যক্তিদের মেধা, প্রজ্ঞা দূরদর্শিতা ও কর্মক্ষমতা এক অমূল্য সম্পদ।
বয়স্ক লোকদের মেধা
বতসোয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক প্রিন্টার্স-এর গবেষণার পূর্ব পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিলো বয়ষ্ক ব্যক্তির মস্তিষ্ক প্রতিদিন এক লক্ষ সেল থেকে বঞ্চিত হয়। এ কারণে তাদের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। তিনি এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মস্তিষ্কের সেল কিছুতেই মারা যায় না বরং ঝিমিয়ে পড়ে। মস্তিষ্কে বিদ্যমান কোটি কোটি সেল টেলিফোনের তারের মতো কাজ করে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেয়। মস্তিষ্কের যে অংশ স্মৃতিশক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত সে অংশের কোনো ক্ষতি হয় না। এ কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি কম্পিউটারের উদাহরণ দিয়েছেন। নতুন কম্পিউটার দ্রুতগতিতে কাজ করে কিন্তু পুরাতন কম্পিউটার দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারে না।
বার্লিনের ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের গবেষক পল ব্লাস্টারের এক গবেষণা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়স্ক লোকেরা কম বয়স্ক লোকদের চেয়ে অগ্রগামী থাকে। বার্লিনে বিভিন্ন বিষয়ে যুবকদের সাথে বয়স্কদের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতার আয়োজক গবেষকগণ লক্ষ করেছেন যে পঁচাত্তর বছর বয়স্ক লোকেরা তাদের কর্মতৎপরতায় যুবকদের চেয়ে অগ্রগামী। যুবক ও বয়স্কদের দিয়ে টাইপ করানো হয়েছে। এতে দেখা গেছে বয়স্ক লোকেরা টাইপের বিষয় বস্তুর পরের শব্দ আগের শব্দ দেখেই বুঝে নেন। তবে যুবকদের টাইপিং স্পিড বয়স্কদের চেয়ে বেশি থাকে।
অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, বৃদ্ধ লোকেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কিছুটা দেরি করলেও তাদের সিদ্ধান্তগুলো প্রায় নির্ভুল থাকে। এক বিস্ময়কর গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, যুবকদের মস্তিষ্কের তুলনায় বয়স্কদের মস্তিষ্ক মোটেই কম দক্ষ নয়। কোনো কাজে তাদের দুর্বলতা থাকলেও তারা তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা এবং দূরদৃষ্টি দিয়ে সেটা দূর করে দিতে পারেন।
বৃদ্ধদের দুর্বল হওয়ার কারণ
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মস্তিষ্ক রোগ বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন যে, সকল লোক অতিরিক্ত পানাহার করে, কাজকর্ম করে না এবং অলসভাবে শুয়ে-বসে সময় কাটায় তাদের দেহ দিন দিন দুর্বল হয়ে যায়। কম বয়সী লোকদের জন্যও এসব অভ্যাস ক্ষতিকর। গবেষকগণ আরো বলেছেন, যেসব রোগ দেহের ক্ষতি করে সেসব রোগ মনেরও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
আমাদের দেশে ষাট বছর বয়সে সরকারি চাকুরিজীবী ও বিভিন্ন পেশার লোকজন অবসরে যান। এ সময় তাদের কোনো কাজকর্ম থাকে না। প্রায় অলসভাবে সময় কাটান। ফলে তাদের দেহের অঙ্গগুলো দ্রুত দুর্বল হয়ে যায়, হতাশা বিষন্নতার রোগ তাদের উপর চেপে বসে এবং দ্রুত তাদের কর্মক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়।
বয়স্কদের সমস্যায় আকুপ্রেশার চিকিৎসা
ভারতের আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ দেবেন্দ্র ভোরা এম. ডি. এক গবেষণায় বলেছেন, একজন সুস্থ ব্যক্তির হার্ট প্রতি মিনিটে যে পরিমাণ রক্ত পাম্প করে থাকে পঞ্চাশ বছর বয়সের পরে প্রতি বছরে ১% করে কমতে থাকে। ফলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে লিভারে রক্তপ্রবাহ কমে থাকে। এটি ছোট হতে থাকে এবং এর কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। কিডনীর কর্মদক্ষতাও বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে। এ ভাইটাল অঙ্গগুলোর ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ ও গ্রন্থির ক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকে। শরীরের শক্তি দ্রুত নিঃশেষ হতে থাকে এবং মনবল ভেঙ্গে পড়ে।
কোন্ অঙ্গের দুর্বলতায় কী কী সমস্যা হয় নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল-
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, হার্টের দুর্বলতায় শরীরে রক্তপ্রবাহ প্রতি বছরে ১% করে কমতে থাকে। এর ফলে শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় খাদ্যরস পৌঁছতে পারে না।
* লিভার, পাকস্থলিসহ হজমপ্রণালী দুর্বলতায় হজমশক্তি দুর্বল হয়, দেহে পানির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং দেহের উত্তাপ কমে যায়। ফলে শারীরিক দুর্বলতা বেড়ে যায়, ঠাণ্ডা, কফ ও কাশি বেড়ে যায়।
* কিডনী এবং যৌনগ্রন্থির দুর্বলতার কারণে প্রস্রাব ধরে রাখতে পরে না, শরীরে বিষক্ত পদার্থ বেড়ে যায়, চোখের পাপড়ির নিচে অর্ধ বৃত্তাকার অংশ ফুলে যায়। ওজন বেড়ে যায় এবং ঘুম কমে যায়।
* থাইরয়েড/প্যারা-থাইরয়েড ও যৌনগ্রন্থির দুর্বলতার কারণে ক্যালসিয়াম ও পটাসিয়ামের বিপাক কমে যায়। ফলে হাঁটু, কোমড় ও বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হয় এবং হাড়ের শক্তি কমে যায়।
* অগ্ন্যাশয়, এড্রিনাল ও পিনিয়ল গ্রন্থি দুর্বল হওয়ার কারণে ডায়েবেটিস, হাই-প্রেশার, লো-প্রেশার ইত্যাদি অনেক সমস্যা দেখা দেয়। এভাবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ও গ্রন্থি দুর্বল হওয়ার কারণে দেহে বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে। এই অঙ্গ ও গ্রন্থির বিন্দুগুলোতে এক মিনিট করে প্রতিদিন একবার চাপ দিয়ে প্রতিটি অঙ্গ ও গ্রন্থিকে ব্যাটারী সেলের মতো রিচার্জ করতে পারি। এতে করে সমস্ত অঙ্গ ও গ্রন্থি সার্ভিসিং হবে। সুষম ও সক্রিয় হয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করবে এবং শরীর দীর্ঘদিন সুস্থ থাকবে ইনশাআল্লাহ।
বার্ধক্যে দেহের তারুণ্য বজায় রাখা
৪০ বছর বয়সের পর শরীরের বিদ্যুৎপ্রবাহ ডান হাতের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। এই জন্যে ডান কুনই ও কব্জির মাঝখানে এক ইঞ্চি মাপের বৃত্তের বিন্দুতে চিত্রানুসারে ২ মিনিট বিশ্রামহীনভাবে প্রতিদিন চাপ দিলে দেহ থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এতে দেহ ও মনের তারুণ্য অনেক দিন বজায় থাকবে এবং বার্ধক্য দেরীতে আসবে। প্রত্যেক নারী-পুরুষের এ চিকিৎসা করা প্রয়োজন। (চলবে)
অধ্যাপক কে. এম. মেছবাহ্ উদ্দিন : বিভাগীয় প্রধান, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ফরিদগঞ্জ বঙ্গবন্ধু সরকারি ডিগ্রি কলেজ। ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]