প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
ইদানীং আমাদের যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে। আর এই ধ্বংস হতে রক্ষা করতে হলে আমাদের সাবধান হতে হবে। তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে পারবো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘এমন জীবন তুমি কর হে গঠন; মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’ যুবক ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে খুবই অর্থবহ কবিতার চরণ দুটো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যুবসমাজ এখন বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণে আজ আমরা হতাশায় নিমজ্জিত। যুবসমাজের অবক্ষয় জাতির বুকে গভীর ক্ষত তৈরি করছে। গোটা সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে।
এই সমস্যার প্রতিকার না হলে দেশ ও জাতি ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হবে। যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণে জাতীয় জীবনে নেমে আসে চরম দুঃখণ্ডদুর্দশা, বিপর্যয় ও হতাশা। সামাজিক ও ধর্মীয় এসব মূল্যবোধ যুবসমাজকে সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের দিকে পরিচালিত করে। বর্তমান সমাজে এ সকল মূল্যবোধের অনুশীলন ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। ফলে যুবসমাজ বিপদগামী হচ্ছে।
আমরা বলবো, তথ্য ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার আমরা করতে পারি না। এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু এর সীমাবদ্ধতা থাকা দরকার অর্থাৎ যেটাকে আমরা বলতে পারি নিয়ন্ত্রণ। নিয়ন্ত্রণ না থাকলে আমরা ধ্বংসের দিকে চালিত হবো। যেটা আমরা বর্তমানে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
স্মার্টফোন হাতের মুঠোয় থাকায় দেশীয় খেলাধুলা দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের ঐতিহ্য, খেলাধুলা বা শারীরিক ব্যায়াম। এখন আর দেখা যায় না স্কুল ছুটি হলে লাটিম নিয়ে মেতে ওঠা, মার্বেল নিয়ে খেলাধুলা, ঘুড়ি নিয়ে রৌদ্রভরা দুপুরে মাঠে দৌঁড়ানো। শিশু-কিশোররা আজ মেতে উঠেছে মোবাইল গেমসে। এটা এখন নেশা হয়ে গেছে। বর্তমান ছাত্র-যুব প্রজন্ম মাঠে গিয়ে খেলার চেয়ে মোবাইল ফোনেই বিভিন্ন গেম খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। সারাক্ষণ মোবাইল গেমস ফ্রি ফায়ারের মতো হিংগ্র সব ভিডিও গেমস নিয়ে ব্যস্ত। ফলে তারা ঝুঁকে পড়ছে অশ্লীলতার দিকে। এ কারণে বর্তমানে ওপেন মেলামেশা দেখা যায়। যেটাকে আমরা বলতে পারি অশ্লীলতা। জড়িয়ে পড়ছে অসঙ্গতিপূর্ণ সামাজিক ব্যাধিতে। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানবতার বদান্যতা থেকে।
ভিডিও গেমসের প্রতি শিশু-কিশোরদের আগ্রহ নতুন কিছু নয়। তবে আগের তুলনায় এখন শতগুণ বেশি। শিশুদের এসব ভার্চুয়াল গেম থেকে দূরে রেখে আবার মাঠের খেলায় ফেরাতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষা পাবে। অন্যথায় তারা বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে যাবে। মেজাজ খিটমিটে হয়ে যাচ্ছে।
এজন্যে আমাদের যা করতে হবে তাহলো : ১. ইন্টারনেট ব্যবহারের আগে নিজেকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, তা আগে বিবেচনা করতে হবে। ২. ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিলে তার একটি সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে এবং সময় মেনে চলতে উৎসাহিত করতে হবে। ৩. পিতা-মাতা বাসার ডেস্কটপ কম্পিউটারটি প্রকাশ্য স্থানে রাখুন। শিশু যাতে আপনার সামনে মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করে। ৪. বেশি বেশি বই কিনতে হবে, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বই হোক নিত্যদিনের সঙ্গী। বইয়ের আলো গেমসের অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। ৫. ইন্টারনেট বা গেম আসক্তি কিন্তু মাদকাসক্তির মতোই একটি সমস্যা। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে এই আসক্তি দূর করতে হবে।
আমরা সকলেই জানি যে, সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেটা একবার ফুরিয়ে গেলে আর পাওয়া যায় না। একবার চলে গেলে আর ফেরানো যায় না। সময়ের আবর্তনে সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টা, দিন-সপ্তাহ-মাস-বছর এভাবেই হারিয়ে যায়। সময়ের ইতিবাচক ব্যবহারই জীবনের সফলতা। সময়ের অপচয় ও অপব্যবহার জীবনের ব্যর্থতা। সময়ের যথাযথ ব্যবহার না করা বা অপব্যবহার করার জন্য আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ আমরা হারাই। প্রতিটি মানুষই কোনো একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। শিশুকাল থেকে সে পরিবারেই বেড়ে উঠে। তারপর সে ধীরে ধীরে সমাজের সাথে পরিচিত হয়। শিশুদের মন শৈশবকালে কাদার মতো নরম থাকে। এই সময় তাদের ইচ্ছা মতো গড়ে তোলা যায়। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবারই পারে তাদের সন্তানদের উপযুক্ত মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে। তথ্য ও প্রযুক্তির বিষয়টি মূল্যবোধে নিয়ে আসতে পারলে শিশুদেরও রক্ষা করা সম্ভব হবে।
এক সময় বিকেল হলে কোনো ছাত্র-যুবককে ঘরে বেঁধে রাখা যেতো না। ছুটে যেতো খেলার মাঠে। ফুটবল, ক্রিকেট, হাডুডুসহ বিভিন্ন খেলায় ব্যস্ত থাকত ছেলেরা। কিন্তু এখন সকাল-বিকাল কোন ছাত্র-যুবককে কোনো কারণ ছাড়া রাস্তায় দেখা যায় না। ঘরে বসে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত গেমসসহ নানান আয়োজন। পাড়ার অলিগলিতে চারজন বন্ধু বসে কথা বলার সময় এখন দেখা যায় না, ওইখানে দেখা যায় সকলেই মোবাইল নিয়ে খেলছে। কেউ কারো সাথে কথা বলার সময় নেই। এমন দৃশ্য পরিবারেও দেখা যায়। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না।
অবস্থাদৃষ্টে আমরা একথা বলতেই পারি যে, বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ যুবক সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্ণ ছবি বা ভিডিও দেখে। ফলে লেখাপড়া বাদ দিয়ে তারা যৌনতার বিষয়ে আগ্রহী ও তৎপর হয়ে উঠছে। যার পরিণতিতে চরিত্রের দিক থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যুব সমাজের বিরাট অংশ। আর যুব সমাজ ধ্বংস হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো এটা । মোবাইলে পর্ণ ছবি বা ভিডিও দেখে তারা যৌন উত্তেজনায় উত্তেজিত হয়ে ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়। মেয়েরাও এ বিষয়ে পিছিয়ে থাকছে না। বর্তমান সময়টা তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। তথ্যপ্রযুক্তি সবকিছু এনে দিয়েছে আমাদের হাতের মুঠোয়। করে দিয়েছে সব কাজের সুযোগ-সুবিধা। মানুষের বিকল্প এখন আধুনিক প্রযুক্তি।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ায় সবার হাতে হাতে নানা ধরনের ডিভাইস রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রনিক ভিডিও গেমস অর্থাৎ গেমিং অ্যাডিকশন। বর্তমান সময়ে এমন তরুণ-যুবক খুব দুর্লভ, যার কাছে স্মার্টফোন আছে, কিন্তু গেমস খেলে না। এটি আমাদের যেমন সাময়িক আনন্দ দিচ্ছে, ঠিক তেমনি কেড়ে নিচ্ছে মহামূল্যবান অনেক কিছু। মারা যাচ্ছে শিশু-কিশোরের সুপ্ত প্রতভা। চুষে খাচ্ছে মহামূল্যবান সময়। নষ্ট করছে কোটি মানুষের অমূল্য জীবন। শেষ করছে মাতৃভূমির সুনাম ও যশ-খ্যাতি।
আমরা বুঝি যে, যুব সমাজের একটি বড় অংশই তথ্য-প্রযুক্তি সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজস্ব মেধা ও যোগ্যতার চরম অপচয়কারী হয়ে উঠছে। অথচ আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবেই লাভবান হয়নি, রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এটাও স্বীকার করতে হবে। শুধুমাত্র এখন লাগাম টেনে ধরতে হবে অপব্যবহারের বিষয়টি।
বিশ্বব্যাপী যুব সমাজ ধ্বংসের পিছনে ইন্টারনেট আসক্তিকেই আমরা দায়ী করতে পারি। ইন্টারনেট আসক্তি যুব সমাজ কিংবা সমাজে বেড়ে ওঠা সকলকে সব ধরনের কাজে অনীহার প্রধান কারণ। এর ফলে বাড়ছে একাকিত্ব, যা হতাশাগ্রস্ত করছে যুব সমাজকে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক ব্যবস্থার ওপর। শিক্ষার মনোভাব থেকে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছে তারা। ইন্টারনেট আসক্তি তাদের থেকে শিক্ষার প্রতি মনোভাবটুকু শেষ করে দিচ্ছে। এটা সত্য যে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু ইন্টারনেট আসক্তির কারণে সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা। উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা, ইতিবাচক চিন্তাভাবনা তৈরি হওয়া গুরু¡পূর্ণ। কিন্তু তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ গুণাবলি না থাকা খুব একটা ভালো ফল বয়ে আনবে না। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো, আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ অনলাইনে কাজ করছেন, মিডিয়া স্ট্রিমিং করছেন এবং সোস্যাল মিডিয়ায় সময় কাটাচ্ছেন। তবে ইন্টারনেটের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে এখনই সচেতন হতে হবে।
বর্তমানে পরকীয়া সবচেয়ে বেশি আলোচিত। এ কারণে ধ্বংস হচ্ছে অনেক সাজানো সংসার। পরকীয়ার কারণে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। এই কাজের সাথে আজ বেশি জড়িয়ে পড়ছে যুব সমাজ। আর এই পরকীয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে মোবাইল। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা উপকৃত হতেই পারি; কিন্তু অপব্যবহার আমাদের বন্ধ করা দরকার।
তথ্য-প্রযুক্তির আধুনিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সরকারের কোনো কোনো দপ্তরের কাজকর্মে দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি অনেকটা কমে গেছে। এতদ্সত্ত্বেও তথ্য-প্রযুক্তি সুবিধার অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের একটি অংশের মেধা, প্রতিভা ও সম্ভাবনা ক্রমান্বয়ে চরম অপচয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তি খাতের একটি নতুন অধ্যায় হচ্ছে ফেসবুক। একে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও বলা হয়।
এই ফেসবুক-সমাজের তরুণ সদস্যরা বৃহত্তর বাস্তব সমাজ থেকে ক্রমেই অনেকটা স্বতন্ত্র ও আলাদা হয়ে পড়ছে। ফেসবুকে নিরন্তর সময় কাটিয়ে এরা পড়াশোনা, খেলাধুলা, নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত, সামাজিকতা সব কিছু থেকেই নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। এমনকি দৈনন্দিন অত্যাবশ্যকীয় কাজকর্মের ক্ষেত্রেও এরা পিছিয়ে পড়ছে। সকালের ক্লাসে উপস্থিত হওয়া বা আদৌ ক্লাসে না আসা, সময়মতো বাড়ির কাজ (অ্যাসাইনমেন্ট) জমা দিতে না পারা, ঘুমজড়ানো চোখে ক্লাসে মনোযোগ দিতে না পারা ইত্যাদি ঘটনায় সুনির্দিষ্ট অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসবের পেছনে রয়েছে ফেসবুক। সারা রাত ফেসবুকে কাটালে পরের দিন উল্লিখিত ঘটনাগুলো ঘটতে বাধ্য এবং সেগুলোই এখন ঘটে চলেছে বাংলাদেশের শহুরে সমাজের এমনকি বহু ক্ষেত্রে মফস্বলের তরুণ-যুবকদের ক্ষেত্রেও।
আমরা আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে পারি যে, আমাদের সমাজের তরুণ-যুবকদের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হলো বিদেশি সংস্কৃতির নামে এক ধরনের অপসংস্কৃতির প্রসার। বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্রের অশ্লীল নাচ, গান, সংলাপ যুবসমাজকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে ফেলছে। ডিশ এন্টেনার প্রভাবে বিদেশি অপসংস্কৃতি আমাদের যুবসমাজকে চেপে ধরেছে। তাছাড়া রুচিহীন পোশাক-পরিচ্ছদও অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। আর এ বিষয়টি অনেকে খোঁড়া যুক্তিতে এড়িয়ে যাচ্ছে।
তাছাড়া মোবাইল অপারেটররা সারা রাত ধরে হ্রাসকৃত বা নামমাত্র মূল্যে সেবা গ্রহণের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে তরুণদের উৎসাহিত ও আকৃষ্ট করছেন। আর এই সুবাদে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক নৈশসমাজ, যা শেষ পর্যন্ত এ বৃহত্তর সমাজকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে আমরা কেউই জানি না। কিছুদিন আগে ফোনের সিমকার্ড নিয়ন্ত্রণের একটি সীমিত উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সিম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু নিয়মণ্ডনীতির নানা ফাঁকফোকর গলিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরীরা কিংবা খুনি মাস্তান বা ছিনতাইকারী সবার হাতেই এখন আবার আগের মতোই সিমকার্ডের যথেচ্ছ বিচরণ। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক বহু তরুণের কাছে নিত্য-নিয়ত সিমকার্ড বদলানো এখন সিগারেটের শলাকা পরিবর্তনের মতোই সহজ ব্যাপার। বিষয়টি হাস্যকর মনে হলেও বাস্তব।
তথ্য-প্রযুক্তির গতিশীল ও যুক্তিসংগত বিকাশ ও ব্যবহারকে আমাদের অবশ্যই উৎসাহিত ও সহায়তা করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সে উৎসাহ যেন কোনোভাবেই আমাদের সমাজকে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির মুখে ফেলে না দেয়। তথ্য-প্রযুক্তির প্রান্তিক পর্যায়ের অপব্যবহারের কারণে সে তরুণদেরই একটি বড় অংশ ক্রমান্বয়ে বিপথগামী ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে সেটা কিছুতেই এবং কারোরই কাম্য হতে পারে না। আমরা আমাদের তারুণ্যের মেধা ও শক্তির বিকাশকে উৎসাহিত করি। কিন্তু একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন বোধ করি তথ্য-প্রযুক্তির প্রান্তিক আঁধারে নিমগ্ন তাদের অবক্ষয়েও।
সম্প্রতি ইন্টারনেট গেমসের প্রভাবে দিন রাত পার করছে স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। দেশের করোনা মহামারী সংকটে ১৮ মাস ধরে বন্ধ ছিলো সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই দীর্ঘ সময় বিরতিতে মোবাইল ফোনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা আমরা লক্ষ্য করেছি। রাত জেগে গেমস খেলা যেন নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এতে করে শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা, পীড়া ও সমস্যার সম্মুখীন যুব সমাজ। আসক্তির কারণে মানসিক বিকারগ্রস্ততায় পড়ছে তারা। এ সমস্যা শুধু কারো ব্যক্তিগত নয়, পরোক্ষভাবে এটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। এমন সমস্যার ফলে দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিন্তাশীল বিচক্ষণ মেধাবীরা।
যে বয়সে মেধা বিকাশের দিকে হাঁটতে শিখা প্রয়োজন, সে বয়সে স্মার্ট ফোনের অপব্যবহার কিংবা অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহারের ফলে মেধা বিকাশ থমকে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের সঠিক ও নিরাপদ ব্যবহারে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং সেইসাথে ইতিবাচক দিকগুলো মিডিয়ার মাধ্যমে পৌঁছে দিতে হবে। বাংলাদেশে দশ থেকে পঁচিশ বছর বয়সী যুব সমাজ ইন্টারনেটের নেতিবাচক দিকের শিকার। এতে ঝুঁকির মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে ইন্টারনেটের ইতিবাচক দিক ও সুফলসমূহ পৌঁছে দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
মোবাইলের কারণে আজ অনেক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। বাসা-বাড়ি, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ অফিসে ও মার্কেটে তো বটেই, রাস্তায় চলতে চলতেও মোবাইলে কথা বলছে মানুষ। আইনে নিষিদ্ধ করা হলেও ব্যক্তি মালিক থেকে শুরু করে, বাস-ট্রাকের চালক গাড়ি চালানোর সময়ও মোবাইলে কথা বলছে। এর ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে যখন-তখন এবং যেখানে-সেখানে। বাংলাদেশে অর্ধশতাংশ যুবক প্রেম করার উদ্দেশ্যে মোবাইল ব্যবহার করে। রাতের পর রাত জেগে কথা বলতে বলতে তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। কারণ ফোনে অধিক কথা বলা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যে খুব ক্ষতিকর। বিশেষ করে ব্রেনের ও হার্টের অনেক ক্ষতি করে এটি। ফোনে কথা বলার এক পর্যায়ে তারা অশ্লীল কথা বলা শুরু করে। আবার সেই কথা রেকর্ড করে রাখে তাদের ফোনে। আবার ভালোবাসায় বিভোর হয়ে একে অপরের সাথে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। তাদের সেই কাজগুলো তারা তাদের ফোন দিয়ে ভিডিও করে রাখে। আর এ দিক মেয়েরাও পিছিয়ে থাকছে না। এক সময় কোনো কারণে তাদের সম্পর্ক যখন নষ্ট হয় তখন সেই রেকর্ড করা ভিডিও বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভাইরাল করে দেয়। আর এর কারণে অনেক প্রেমের শেষ পরিণতি হয়ে দাঁড়ায় আত্মহত্যা। বাংলাদেশে এমন ঘটনার অভাব নেই।
একটি দেশের যুব সমাজ কিংবা শিক্ষার্থীদের সুন্দর ও সমৃদ্ধ পথ দেখিয়ে দেয়ার পিছনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা সুশিক্ষিত জাতি গঠনে অনবদ্য। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট ঝুঁকির তীব্রতা সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। নেতিবাচক দিকের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সেইসাথে ইতিবাচক দিক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে সহায়তা প্রদান করতে হবে। সরকারি প্রচেষ্টায় দেশে ইন্টারনেট ঝুঁকি থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে বিভিন্ন কর্মশালার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এতে করে ইন্টারনেটের খারাপ প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে তারা। যুব সমাজকে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশে ফেরাতে হলে চাই পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সচেতনতা ও দায়িত্ব পালন। মোবাইল গেমস্গুলো বন্ধে সরকারকে হতে হবে আরো কঠোর। শুধু দেশের সার্ভার থেকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলা গেমসগুলো বন্ধ করলেই হবে না, বরং যেসকল সার্ভার ব্যবহার করেও এ গেমসগুলো সচল রাখা যায়, সেগুলো বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে শীঘ্রই। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনোদন, সাংস্কৃতিক কলাকৌশলে আনতে হবে অভিনব ব্যবস্থা। অভিনবত্বের ছোঁয়ায় ইন্টারনেট ঝুঁকি ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকবে। পরিবারকে হতে হবে সবচেয়ে বড় সচেতন। অল্প বয়সে হাতে স্মার্ট ফোন ধরিয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বই পড়া কিংবা বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ঘরে তৈরি করতে হবে। ইন্টারনেটের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে বেশি করে জানাতে হবে। ইন্টারনেটের ইতিবাচক দিকের সঠিক ব্যবহারে উৎসাহী করতে হবে। শিক্ষকদের হতে হবে আরো সচেতন। ইন্টারনেট আসক্তরা তাদের পড়াশোনার কাজ গুছিয়ে করে উঠতে পারছেন না। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি কাজ করার কথা না থাকলেও ইন্টারনেট আসক্তির কারণে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষাকে বেশ ভয় পাচ্ছেন এবং বিষয়টি নিয়ে তারা রীতিমতো উদ্বিগ্ন থাকছেন। যে কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাকিত্ব বাড়ছে, যা পড়াশোনাকে আরো কঠিন করে তুলছে। এমন করেই ধ্বংসের দিকে হাঁটছে যুব সমাজ। সমাজ জীবনে যার নেতিবাচক প্রভাব খুব বেশি। মানসিক প্রশান্তি হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। চোখের দৃষ্টি কমে যাচ্ছে। ফলে অল্প বয়সেই চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। মেধা বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
আবার আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো, এই তরুণদের একটি বড় অংশই তথ্য-প্রযুক্তি সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের শুধু অলস, কর্মবিমুখ, সময় অপচয়কারী ও আড়ষ্টতাপূর্ণ স্বপ্নহীন প্রজন্মের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে না, এ প্রক্রিয়ায় চিন্তার বন্ধ্যাত্বে পড়ে কখনো কখনো এদের মধ্যকার একটি বড় অংশ মাদক সেবন ও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে।
একটি অভিযোগ চলে আসছে যে, খেলার মাঠ বা খোলা জায়গার অভাবে শহরের শিশু-কিশোরদের যথাযথ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটছে না। শহরের বেশির ভাগ শিশু-কিশোর এখন ফেসবুক বা মোবাইলের মধ্যে নিজেদের আটকে রেখে ঘর থেকেই বের হয় না বা হতে চায় না। ফলে তাদের জন্যে খেলার মাঠ থাকা বা না থাকা দুটিই এখন অপ্রাসঙ্গিক। এ অবস্থায় এ শিশু-কিশোররা শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই চরম পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া মাদকাসক্তি, খুনখারাবি, পর্ণোগ্রাফি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তারেও মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক ইত্যাদির গুরুতর রকমের ভূমিকা রয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির কল্যাণে দেশের তরুণদের একটি অংশ এখন নানা আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে। দেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের পেছনেও তথ্য-প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।
তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে অপরাধসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডলো ক্রমেই একধরনের আন্তর্জাতিক চরিত্র ও মাত্রা পেয়ে যাচ্ছে। সমাজে মিথ্যাচারিতা, প্রতারণা ও ধূর্ততার প্রসারেও তথ্য-প্রযুক্তি এখন একধরণের আগ্রাসী ভূমিকা রাখছে। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে না ওঠার পেছনে ফেসবুকে মাত্রাতিরিক্ত সময় কাটানো যে একটি বড় কারণ, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। অথচ তথ্য-প্রযুক্তি হয়ে উঠতে পারত তাদের অধিকতর পাঠমুখী হয়ে ওঠার অন্যতম সহায়ক হাতিয়ার। তথ্যপ্রযুক্তির নানা মাধ্যম হতে পারত অধিকতর তথ্য, জ্ঞান ও ধারণা দিয়ে নিজেদের অধিকতর সমৃদ্ধরূপে গড়ে তোলার একটি চমৎকার লাগসই উপায়। কিন্তু সেসব তো হচ্ছেই না, উল্টো তথ্য-প্রযুক্তি সুবিধার সুযোগ ও সহজলভ্যতার অপব্যবহার ঘটিয়ে নিজেদের তারা স্বপ্নবিমুখ অন্ধকারের গহ্বরে সঁপে দিচ্ছে। অথচ নিশি রাতে চাঁদের আলোয় কিংবা ঘরে হারিকেন জ্বালিয়েও গত কিছু দশক আগে পড়ালেখার প্রতি ঝুঁকে ছিলো ছেলে-মেয়েরা। কোনো সময় দক্ষিণ দিকের জানালায় উঁকি দিতো ভরা পূর্নিমার চাঁদ। আর সেই আলোয় মিটমিট করে চোখের সামনে ভেসে উঠতো বইয়ের সকল লেখাগুলো। সেই পড়াতে ছিলো মনের খোরাক। কেউ কেউ মোমবাতির আলোয় রাত কাটিয়ে দিতো অংকের সমাধান বের করতে করতে। সন্ধ্যার পর পড়ার টেবিলের সাথে সুমিষ্ট সম্পর্ক যেন এই কিছুদিন আগের কথা। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেগুলো যেন রূপকথার কাল্পনিক গল্প কেবল। কিন্তু অতীতের ফেলে আসা পড়ালেখার প্রতি মানুষের কীরকম একটা মনোযোগ ছিলো, তা এসময়ে নেই। এখন তো কেবল সারাদিন বদ্ধ ঘরের কোণে বসে চশমার সাহায্যে টেবিলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। মোমের আলোয় পড়া হয়না বললেই চলে। অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক আবিষ্কার লাইট, বাল্বের প্রভাবে মোমবাতি হারিকেন ইত্যাদি বিলীনের পথে। আজকাল পড়ালেখার মাঝে নেই আনন্দ, খুঁজে পাওয়া যায় না বইয়ের প্রতি সুমধুর বন্ধন। এর পেছনে বর্তমান সময়ের কিছু জিনিস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আধুনিক বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু হতে জীবন থেকে জীবনের সকল চাওয়া পাওয়া যেন বদলে গেছে। ইন্টারনেটের পিছনে দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের সাথে মিশে থাকা সকল স্মৃতিময় দিনগুলো। যা হাজার চেষ্টা করেও ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। ইন্টারনেট ঝুঁকিতে দেশের যুব সমাজের একটি বৃহৎ অংশ জড়িত, যার ফলে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে যুবকরা। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে যুব সমাজের অবদান রয়েছে বেশি।
একটি দেশকে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যুব সমাজকে বিকশিত করে গড়ে তুলতে হয় এবং উন্নত বিশ্বে আধুনিকতার স্থান দখলেও যুব সমাজের অংশীদারিত্ব ভূমিকা পালন করে। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে তা বিনষ্ট হচ্ছে। ধসে যাচ্ছে চিন্তাভাবনার বিকাশ। সুতরাং তথ্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার না করলে অকল্পনীয় ক্ষতির দিকে আমরা ধাবিত হবো।