প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
মোবাইল ফোন বাজছে, হাতের কাজ ফেলে হন্তদন্ত হয়ে ফোন ধরতে ছুটে যান রহিমা বেগম। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে থাকা লাল-সবুজ রঙের মাঝ থেকে সবুজ রঙে চাপ দিয়ে মোবাইল চেহারার সামনে নিয়ে আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে উঠেন,
‘হ্যালো।’
অপর পাশে তার ছেলের চেহারা দেখে বলতে থাকে ‘বাজান কেমন আছো? চেহারাটা এমন দেখাইতাছে কেন? খাওয়া দাওয়া করো নাই? পরিশ্রম কি বেশি হইতাছে?’
রহিমা বেগমের ছেলে প্রবাসী, কয়েক মাস আগে সে দেশে এসে ভিডিও কলে কথা বলতে তার মাকে স্মার্টফোন কিনে দিয়ে যায় এবং কীভাবে কল রিসিভ করতে হবে তাও শিখিয়ে দিয়ে যায়। এখন তারা ভিডিও কলেই মা ছেলের চেহারা দেখে দেখে কথা বলে। ছেলে হাজার মাইল দূরে থাকলেও মনে হয় এই তো কাছেই।
রহিমা বেগমের ছেলে প্রতি মাসেই বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়। টাকা তোলার জন্যে তাকে এখন আর কষ্ট করে দূরের ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। কাছের এটিএম বুথ থেকে সহজেই টাকা তুলতে পারেন।
আরিফ এক অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে। লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পিছনে ছুটেছে বহুদিন, কিন্তু সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যখন চাকরি পাওয়া হলো না তখন আউটসোর্সিং শিখে নিজেই এখন ঘরে বসে ডলার কামাচ্ছে এবং একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেখানে অন্যদের চাকরি দিচ্ছে।
খলিল ব্যবসায়ী, আগে শুধু স্টেশনারি আইটেম বিক্রি করতো, এখন এর পাশাপাশি মোবাইল রিচার্জ ও মোবাইল ব্যাংকিং চালু করায় দূর-দূরান্তে টাকা পাঠানোর জন্যে লোকজন তার দোকানে ভিড় করে। তাতে তার আয়ও বাড়ছে।
রাহুল আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দিবে, অংক ও ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে সে সমস্যা মনে করছে না। তাই স্কুল শিক্ষকের সহায়তা নেওয়ার পাশাপাশি অনলাইন স্কুল থেকে সে অংক ও ইংরেজি কোর্স করছে।
শেফালী বাবা মায়ের আদরের মেয়ে, ছোটবেলা থেকেই আদরে আদরে বড় হওয়ায় রান্নাবান্না শেখা হয়নি, তাই স্বামীর সাথে যখন সে স্বামীর কর্মস্থলের কাছাকাছি বাসায় উঠে তখন রানা-বান্নায় শুরু হয় বিপত্তি। কিন্তু ইউটিউবে ভিডিও দেখে দেখে সে এখন পাক্কা রাঁধুনী।
আব্দুল কদ্দুছ একজন কৃষক, আগে ফসল ফলানোর পর ন্যায্যমূল্যে বাজারে বিক্রি করতে পারবে কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও এখন প্রযুক্তির কল্যাণে ফসল ফলানোর সাথে সাথেই অনলাইন ও সুপারস্টোরগুলোয় বিক্রি করতে পারছে।
আবরার একজন এমবিবিএস ডাক্তার, গ্রামের ছেলে বর্তমানে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চাকরি করছে। কিন্তু ভুলে যায়নি তার গ্রামের মানুষদের। তাই সে অনলাইনে ভিডিও কলের মাধ্যমে নিজের গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকে।
উপরের চিত্রগুলোর দিকে তাকালে সহজেই বুঝা যায় তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে এবং বর্তমানে তার সুফল ভোগ করছে শহর থেকে অজঁপাড়া গাঁয়ের জনগণও।
এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে :
আমরা আবারো রহিমা বেগমের সাথে তার ছেলের কথোপকথনে ফিরে যাই। যেখানে রহিমা বেগম তার ছোট ছেলের ব্যাপারে কথা বলছে, যে কিনা সদ্য এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে।
‘মা, রাজন পরীক্ষায় এত খারাপ করলো কীভাবে?’
‘ওরে নিয়া আর পারি না, সারাদিন মোবাইল নিয়াই থাকে আর বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কি নাকি ভিডিও বানায় আর গেইম খেলে।’
রহিমা বেগমের ছেলের মতো অনেক স্কুল শিক্ষার্থীই আজ মোবাইল আসক্ত হয়ে পড়াশোনায় হয়ে উঠেছে অমনোযোগী, খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে গড়ে তুলছে কিশোর গ্যাং।
অভিভাবকগণ ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা চিন্তা না করে ছোট শিশুদের হাতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দিয়ে তাদের ব্যস্ত রাখছে। নিজেরাও হয়ে উঠছে ফোনাসক্ত, এতে ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক অবক্ষয় ও পরিবারে সৃষ্টি হচ্ছে ভাঙ্গন।
অনলাইনে গড়ে উঠেছে অনেক ই-কমার্স সাইট, কিন্তু কোন মনিটরিং না থাকায় প্রায়ই ক্রেতাদের হয়রানি ও প্রতারণার অভিযোগ উঠছে।
প্রতারকচক্র মিথ্যা প্রলোভনে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যও আজ হ্যাকারদের কাছ থেকে নিরাপদ নয়। সাইবার অপরাধ বাড়ছে প্রতিনিয়তই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর সহজ শিকার হচ্ছে নারী।
আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ভালো দিক যেমন রয়েছে, তেমনি এর খারাপ দিকও রয়েছে। তাই অভিভাবক ও শিক্ষক সমাজ থেকে শুরু করে সমাজে প্রতিটি মানুষ যদি তথ্য-প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং কুফলগুলো এড়িয়ে আমরা যদি সুফলগুলোয় টিকে থাকতে পারি তাহলে তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ আরো বহুদূর এগিয়ে যাবে।
লেখক পরিচিতি : কবি ও গল্পকার। রাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ।