মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৪, ০০:০০

বরেণ্য সাঁতারু অরুন নন্দী

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
বরেণ্য সাঁতারু অরুন নন্দী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কয়েক হাজার দর্শকের করতালির মধ্য দিয়ে সকাল আটটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে অরুন নন্দী সাঁতার শুরু করেন। সাঁতারকালে তিনি মোট ১৪ বার বমি করেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি, সাঁতার চালিয়ে যান। ওইসময়ে অনুভূতি সম্পর্কে আশীষ চক্রবর্তীকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘প্রথম দুদিনের সাঁতারে কষ্টটা তেমন টের পাইনি। আসল কষ্ট অনুভব করলাম ১১ অক্টোবর থেকে। ১২ অক্টোবর পর্যন্ত আমার ওপর দিয়ে কেমন ধকল গেছে তা শুধু আমিই জানি। কতবার যে শরীরের যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি, তবু থামিনি। আসলে ওই সাঁতারটাকে আমি বাংলাদেশের মান-মর্যাদার সাথে এক করে দেখেছিলাম। সে জন্যই ব্যক্তিগত কষ্টের চিন্তা আমলে নিয়ে মাঝপথে থামবার কথা ভাবতেই পারিনি।’ অরুন নন্দী অবশ্য সাঁতার থামালেন। কিন্তু যতক্ষণে থামলেন তখন অবিরাম ৯০ ঘন্টা ৫ মিনিট সাঁতার কেটে তিনি নতুন বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছেন। তাঁর এই সাঁতার সারাবিশ্বে হইচই ফেলে দেয়। তাঁকে অভিনন্দন জানালেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী কামরুজ্জামান, মহানায়ক উত্তম কুমার, অন্নদাশঙ্কর রায়, আশাপূর্ণা দেবী, সত্যজিৎ রায়, পিকে ব্যানার্জি, শৈলেন মান্না প্রমুখ। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা তাঁর এ কৃতিত্বের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী অরুন নন্দীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় ওইসময় অরুন নন্দীকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেন। বিখ্যাত লেখক শওকত ওসমান স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘জয় বাংলা! জয় বাংলা! সাঁতারু অরুন কুমার নন্দী এক বিশ্ব রেকর্ড করে বসে আছে। কাছে গিয়ে এই বীরকে অভিনন্দন জানাতে হয়। তার কৃতিত্ব স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অমূল্য অবদান। একটানা লাগাতার সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড ছিল ৮৯ ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট। অরুন নন্দী ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতারে সেই রেকর্ড চুরমার করে দিয়েছে। আর এক ব্রজেন দাশকে পাওয়া গেল। বাংলাদেশের অধিবাসীর এই তাক-লাগানো ম্যাজিক বিশ্ববাসীকে দুর্দিনে আরো আমাদের কাছে টেনে আনবে। জয় বাংলা! জয় বাংলা! বিখ্যাত সাঁতারু।’ কলকাতায় অরুন নন্দীকে ৩০টি সংবর্ধনা দেয়া হয়। ত্রিপুরা সমিতি তাঁকে সন্তরণশ্রী উপাধিতে ভূষিত করে। সাঁতারে তিনি আয় করলেন ২৬ হাজার রুপি। আয়ের পুরো অর্থই তিনি তুলে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে।

দেশস্বাধীনের পর অরুন নন্দী সাঁতার ছাড়েননি। তিনি ১৯৭৪ সালে মিরপুর থেকে চাঁদপুর (৭০ মাইল) পর্যন্ত সাঁতার কাটেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি এশিয়ার দূরপাল্লার সাঁতারের রেকর্ড গড়েন। তাঁর আগে ৬১ মাইল অতিক্রম করে এ রেকর্ড করেছিলেন ভারতের মিহির বোস। এ কৃতিত্বের পর বঙ্গবন্ধু অরুন নন্দীকে ডেকেছিলেন। তাঁর ভাষ্যে, “এ সাফল্যের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তলব করলেন। গেলাম। বঙ্গবন্ধু সস্নেহে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তোরে দিয়া আমি বে অব বেঙ্গল পার করামু। তুই আমার দেশের গর্ব।’ তার দেয়া উপহার (স্যুটপিস) হাতে নিয়ে আমি একটা সুইমিং ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। তিনি জবাব দিলেন, ‘ঠিক আছে, হবে’।” ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে অরুন নন্দীর সুইমিং ইনস্টিটিউট গড়ার স্বপ্ন অধরা থেকে যায়।

আর্থিক টানাপোড়েন অরুন নন্দীর সবসময়ই ছিল। সে কারণে তাঁকে কষ্ট করতে হয়েছে অনেক। চেয়েছিলেন ইংলিশ চ্যানেল জয় করবেন। প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাঁর এ স্বপ্নটিও বাস্তবে রূপ নেয়নি। কিন্তু আমৃত্যু তিনি সাঁতারের সঙ্গেই ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে কানাডায় বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপ এবং ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি বাংলাদেশ দলের কোচ কাম ম্যানেজার মনোনীত হন। ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্যে ১৯৯৬ সালে অরুন নন্দী জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে ভূষিত হন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন।

আমৃত্যু সাঁতারের জন্যে নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন অরুন নন্দী। রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে অল্পবেতনে চাকুরি করতেন। তিনি এসময় ৩ লাখ টাকা সঞ্চয় করেন। তিনি এরমধ্যে ২ লাখ টাকা সাঁতার-উন্নয়নের জন্যে এবং ১ লাখ টাকা চাঁদপুরের অযাচক আশ্রমকে দান করে দেন। বাংলাদেশকে তিনি সবসময় তাঁর সর্বোচ্চটুকু দিতে চেয়েছেন। তিনি তা পেরেছেনও।

অরুন নন্দী জন্মেছিলেন ১৯৪১ সালের ২৬ নভেম্বর। জন্মস্থান চাঁদপুরের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা। তাঁর জবানীতেই পাই : ‘চাঁদপুরের মানুষের এই ভালোবাসা ও ঋণ আমি কখনই শোধ করতে পারবো না। তাদের প্রতি আমার অন্তহীন কৃতজ্ঞতা। চাঁদপুরের মাটিতে জন্ম নিতে পেরে আমার জীবন হয়েছে ধন্য ও সার্থক। সেই শৈশব থেকে আমি চাঁদপুরের মানুষদের বরাবরই আমার পাশে পেয়েছি। তারা আমার সুখে-দুঃখে-আনন্দে হাত বাড়িয়ে দিতে একটুও কার্পণ্য করেননি। সাঁতারে যদি আমার বিন্দুমাত্র অবদান থেকে থাকে, তার পেছনে রয়েছে চাঁদপুরের মানুষের অপরিসীম ভূমিকা।’ কৃতী এ সাঁতারু ২০০৮ সালের ১৬ নভেম্বর কলকাতায় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। চাঁদপুর স্টেডিয়ামে অবস্থিত অরুন নন্দী সুইমিংপুল প্রতিদিনই এ কৃতী সাঁতারুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

সূত্র :

১। আমার সাঁতার জীবন, অরুন নন্দী; অনুলিখন দুলাল মাহমুদ, প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০১১

২। স্বাধীনতার সাঁতারু অরুন নন্দীর সঙ্গে, আশীষ চক্রবর্ত্তী; বিডিনিউজ টুয়ান্টিফোর, ২১ নভেম্বর ২০০৮

৩। মাঠের আলোয় ভাসি, নাজমুল হক তপন, সময় প্রকাশন, প্রকাশ : ২০০৮, পৃ. ৯

৪। একজন অরুন নন্দী ও একটি বিশ্বরেকর্ডের গল্প, জনযুদ্ধ-৭১, প্রকাশ, ৪ মার্চ ২০১৪

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়