প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল দলের হয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশীপ খেলে এসেছেন চাঁদপুর সদর উপজেলার তরপুরচন্ডী এলাকার ফুটবলার আবু রায়হান শাওন। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলটি ২৩ জন ফুটবলার, কোচ ও কর্মকর্তাসহ গত ৩০ আগস্ট ভুটান গিয়েছিলেন। সেই মূল দলেই ছিলেন বয়সভিত্তিক জাতীয় ফুটবল দলে প্রথমবারের মতো ইলিশের নগরী চাঁদপুর জেলার হয়ে সুযোগ পাওয়া অনেকের পরিচিত মুখ শাওন। সাফ চ্যাম্পিয়নশীপ ফুটবলের ফাইনালে ভুটানের চ্যাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে শক্তিশালী ভারতের সাথে মূল একাদশের হয়েই মাঠে নেমেছিলেন। ফাইনাল খেলা শেষে ১১ সেপ্টেম্বর দেশে এসে পৌঁছান এবং ছুটি নিয়ে নিজ জন্মভূমি চাঁদপুরে ওইদিনই চলে আসেন। আগামী ৫ অক্টোবর পুনরায় ফুটবল ক্যাম্পে গিয়ে যোগ দিবেন।
দলের হয়ে স্ট্রপার পজিশনে খেলা এই ফুটবলার মনে করেন, যত বেশি অনুশীলন করা যাবে এবং খেলাধুলার সাথে জড়িত থাকা যাবে, ততোই খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়বে এবং জাতীয় পর্যায়সহ ফুটবলের বড় বড় আসরে খেলার সুযোগ পাওয়া যাবে।
চাঁদপুরে আসার পর রোববার ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এই ফুটবলারের সাথে চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডঃ সেলিম আকবরের চেম্বারে ক্রীড়াকণ্ঠের প্রতিবেদকের খেলাধুলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়। তিনি শুরুতেই বলেন, আমার সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালার রহমতে এবং আমার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, ফুটবলের কোচ, এলাকার মুরব্বিদের দোয়া ও সমর্থনেই আমি লাল-সবুজের জার্সি গায়ে দেশের বাইরে ফুটবল খেলার সুযোগ পেয়েছি। দেশের পক্ষ হয়ে বিদেশের মাটিতে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে ভালো লেগেছে। আমি সাফ চ্যাম্পিয়নশীপে সেমি-ফাইনালে পাকিস্তান ও ফাইনালে ভারতের সাথে ম্যাচের পুরো সময়টুকুই মূল একাদশের হয়ে মাঠে খেলেছি। আমাদের দলটি যদি সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালে ভারতের সাথে জয়ী হতে পারতো এবং চ্যাম্পিয়ন হতে পারতো, তাহলে অনেক আনন্দ লাগতো। জাতীয় পর্যায়ে ভালো ফুটবল উপহার দেয়াই হচ্ছে আমার চেষ্টা। জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলাটাই হচ্ছে আমার মূল লক্ষ্য। আমি নিয়মিত ফুটবলের সাথে জড়িত থাকার পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধুলা করতে চাই।
শাওন বলেন, আমার জেলা ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। এ জেলা থেকে আমারও জন্মের আগে বিশেষ করে ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের ফুটবলের কথা বললেই চাঁদপুর জেলার অনেক ফুটবলারের নাম চলে আসতো। ফুটবল বলতেই ওই সময়ে আমার জেলা চাঁদপুরকে সহজেই দেশবাসী চিনতো। ওই সময়ের আবুল, মুকুলসহ অনেকেরই নাম শুনেছি। পরবর্তীতে মনোয়ার চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন মানিক, জাহাঙ্গীর গাজী, গোলাম মোস্তফা বাবু, জাহাঙ্গীর পাটওয়ারী, ইউসুফ বকাউলসহ অনেকেই ঢাকার মাঠে এবং দেশের লাল-সবুজ দলের হয়ে খেলেছেন। এরপর জাতীয় দলের হয়ে ফুটবলে রেজা ভাই ও রাফি ভাই খেলেছেন। আমিও তাদের মতো জাতীয় ফুটবল দলসহ ঢাকার বিভিন্ন বড় বড় ক্লাবে নিয়মিত ফুটবলার হিসেবে খেলতে চাই।
চাঁদপুরের ফুটবল উন্নয়ন এবং খেলার বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই জেলাতে মাঝে মাঝে ফুটবল লীগ ও জেলা প্রশাসক কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট ছাড়া তেমন কোনো বড় ধরনের টুর্নামেন্ট হয় না। আর ওইখানে বড় বড় এবং বিশেষ করে বয়সী খেলোয়াড় ছাড়া কেউ সুযোগ পায় না। আমার মতে, দলের জন্যে নয়, খেলোয়াড় সৃষ্টি করার জন্যে জেলা পর্যায়ের খেলাগুলোতে বহিরাগত ফুটবলারের সংখ্যা কমিয়ে স্থানীয় ফুটবলারদের প্রাধান্য দেয়া উচিত। আমরা যারা ছোট তারা কিন্তু আর তখন খেলার সুযোগ পাই না। এই ক্ষেত্রে আমাদের চাঁদপুরের যে সমস্ত সাবেক ফুটবলার কোচ হিসেবে আমাদেরকে অনেকটা বিনা পারিশ্রামিকে অনুশীলন করিয়েছেন, তারা ও সাবেক ফুটবলারগণ যদি আমাদের মতো ছোট বয়সী ফুটবলারদেরকে ঢাকা কিংবা আরো ভালো কোনো স্থানে অল্পবয়স থেকেই খেলার সুযোগ করে দেন, তাহলে আমার মতো অনেক কমবয়সী ফুটবলার জাতীয় পর্যায়ের বয়সভিত্তিক দলে খেলার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, আমার গর্ভধারিণী মা আমাকে ফুটবল অনুশীলনের জন্যে চাঁদপুর সোনালী অতীত ক্লাবে এনে ভর্তি করিয়ে দেন। এই ক্লাবের কর্মকর্তা ও শ্রদ্ধাভাজন সাবেক ফুটবলার মনোয়ার চৌধুরী, মানিক ও জাহাঙ্গীর গাজীদের অনুপ্রেরণাতেই আমি ঢাকাতে ক্যাম্পে যাওয়ার সুযোগ পাই। ঢাকা এলিট ক্লাব থেকে ট্রায়ালের ফরম আনার পর সোনালী অতীত ক্লাবের কর্মকর্তারাই আমাকেসহ আরেক ফুটবলার সিমরানকে ঢাকাতে ট্রায়ালের জন্যে পাঠান। আমি দলে সুযোগ পাওয়ার আগে ৯ মাস নিয়মিত দলের সাথে অনুশীলন করেছি। পরবর্তীতে দলে ভালো পারফরমেন্সের কারণেই দলের ২৩ সদস্যের মূল দলে সুযোগ পাই।
ভুটানে বাংলাদেশ দলের ৪টি ম্যাচ হয়েছে। এ নিয়ে জানতে চাইলে আবু রায়হান শাওন বলেন, আমি প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার খেলায় শেষ সময়ের কয়েক মিনিট আগে মাঠে নামার সুযোগ পাই। দ্বিতীয় ম্যাচে নেপালের সাথে ম্যাচের ৮৩ মিনিটে খেলতে নামি এবং সেমি-ফাইনালে পাকিস্তানের সাথে ও ফাইনালে পুনরায় ভারতের সাথে খেলায় মূল একাদশের হয়ে মাঠে নামি। আমাদের জাতীয় দলের কোচ, কর্মকর্তাসহ সকলের সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছি খেলার সময়ে। এছাড়া দলের সকল খেলোয়াড়ের মধ্যে ছিলো খেলাধুলাসহ অনেক আন্তরিকতা।
এবারের সাউথ এশিয়া ফুটবল কনফেডারেশন (সাফ) চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নেয় বাংলাদেশসহ ৭টি দেশ। সর্বশেষ ২০১৫ সালের আগে শিরোপা জিতেছিলো বাংলাদেশ।
আবু রায়হান শাওনের বাড়ি চাঁদপুর সদরের তপরপুরচন্ডী এলাকায়। তার বাবার নাম নুরুল ইসলাম গাজী ও মায়ের নাম রহিমা বেগম। ২ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। সে এসএসসি পাস করেছে চাঁদপুর শহরের গভর্নমেন্ট টেকনিক্যাল হাই স্কুল থেকে। তাকে তরপুরচন্ডী এলাকায় ফুটবলার শাওন নামে সকলেই চিনে। সে স্থানীয় একুশে ক্লাবের হয়ে জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে ফুটবল খেলেছেন। সে এ প্রতিবেদককে জানান, চাঁদপুর সরকারি কলেজে এবার এইচএসসিতে ভর্তি হবেন।
চাঁদপুরের ছেলে হয়ে বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৬ দলে বিদেশের মাটিতে আবু রায়হান শাওন সুযোগ পাওয়াতে তার পরিবারসহ পুরো এলাকার সকলের মাঝে ছিলো অনেক আনন্দ।
শাওনের মা রহিমা বেগমের সাথে এ প্রতিবেদকের আলাপকালে তিনি জানান, আমার ছেলে দেশের হয়ে বিদেশে খেলে এসেছেন এটা আমাদের চাঁদপুরের জন্যে অনেক গর্বের। আমার ছেলের ফুটবলার হওয়ার পেছনে ফুটবল কোচ মানিক ও জাহাঙ্গীর স্যারের অনেক অবদান, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমার ছেলে অনেক অভাব-অনটনে থেকেও নিয়মিত স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি চাঁদপুর সোনালী অতীত ফুটবল একাডেমীতে অনুশীলন করতো। এই একাডেমীতে খেলার কারণেই ঢাকায় ফুটবলারদের বাছাইতে অংশ নিয়েছিলো এবং জাতীয় পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে দেশের বাইরে খেলার সুযোগ পায়। আমার ২ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে ফজলে রাব্বি ও আমার মেয়ের জামাই মোঃ খোরশেদ আলম তাকে খেলাধুলার ব্যাপারে অনেক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তার বড় ভাই তার ফুটবল খেলার জন্যে সবসময়ই সহযোগিতা করেছে। আমি দোয়া করি, আমার ছেলে যেনো ভবিষ্যতে জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
আবু রায়হান শাওনের চাঁদপুরের ফুটবল কোচ আনোয়ার হোসেন মানিক ও জাহাঙ্গীর গাজীর এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, শাওনের মা-ই আমাদের একাডেমীতে তাকে ভর্তি করিয়ে দেন। তাকে ভর্তি করিয়ে দেয়ার পর আমরা দুজন মিলে তাকে খেলার জন্যে বুটসহ সকল কিছু দিয়ে সহযোগিতা করেছি। তাকে ঢাকায় খেলানোর ব্যাপারে আমাদের সকল ধরনের সহযোগিতা ছিলো। ও বিদেশের মাটিতে বিশেষ করে সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের সেমি-ফাইনালে ও ফাইনালে একজন স্ট্রপার হিসেবে ভালো খেলাই উপহার দিয়েছে। তার ভবিষ্যতের জন্যে আমরা জেলাবাসীর কাছে দোয়া চাই।
শাওনের একমাত্র বোন নুরুননাহার আক্তার এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, আমার বাবা, মা ও বড় ভাইসহ আমার স্বামী আমার ভাইয়ের ফুটবল খেলার জন্যে অনেক কষ্ট করেছেন, এখনো সহযোগিতা করে যাচ্ছেন এবং আগামীতেও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। আমার ভাই আগামীতে জাতীয় পর্যায়ে যেনো খেলার সুযোগ পায় জাতীয় দলের হয়ে--আমরা তার হয়ে সকলের কাছে এই দোয়াই চাই।
তরপুরচন্ডী এলাকার সন্তান ও চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী ও একুশে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও ক্রীড়াবিদ অ্যাডঃ আব্দুল হান্নান কাজীর সাথে এ প্রতিবেদকের আলাপকালে তিনি জানান, শাওনের ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি অনেক আগ্রহ। সে আমাদের ক্লাবের হয়ে অনেক স্থানেই ফুটবল খেলেছে। সে যে আমাদের সাথে খেলার পর এবং নিয়মিত ফুটবল একাডেমীতে অনুশীলন করার কারণে ঢাকাতে ৯ মাস অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছে, তাতে আমরা গর্ববোধ করি। ছোটকাল থেকেই ফুটবল খেলার প্রতি তার অনেক আগ্রহ। সে যেনো ভবিষ্যতে লাল-সবুজের দেশ বাংলাদেশের হয়ে আরো ভালো খেলতে পারে এবং ফুটবলপ্রেমী দর্শকদের খেলাধুলাতে আনন্দ দিতে পারে, সে লক্ষ্যে সকলের কাছে শাওনের জন্যে দোয়া কামনা করছি।