প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
ড্যান ব্রাউন, পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজ হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে.কে. রওলিং কে যিনি জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে টেক্কা দিয়েছিলেন, তার লেখা দ্য দা ভিঞ্চি কোড বইটি কেউ পড়েছেন? যারা পড়েছেন তারা বুঝতে পারবেন যে, থ্রিল, মিস্ট্রি, ট্রাজেডি, রুদ্ধশ্বাস এডভ্যাঞ্চার কাকে বলে। কেউ কি ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোয়েলহোর মাস্টারপিস সৃষ্টি আলকেমিস্ট পড়েছেন? যার বিখ্যাত লাইন “যখন তুমি মন থেকে কিছু চাও, পুরো বিশ্ব তা তোমাকে পেতে সাহায্য করবে।'' স্বপ্ন এবং জীবনের কী অসাধারণ দার্শনিক চিত্র! আপনি কি পারসুট অব হ্যাপিনেস মুভিটা দেখেছেন? শেষ পর্যায়ের ক্লাইমেক্সে যখন ক্রিস গার্ডনার চাকরিটা পেয়ে যায়, তার চোখে আনন্দ এবং তৃপ্তির যে অশ্রু তা ভুলবার নয়। আপনার যদি উপরে বর্ণিত সিনেমা কিংবা বইগুলোর কোনো অভিজ্ঞতা না থাকে, তাইলে অবশ্যই ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপের যেই রোমাঞ্চকর ঐতিহাসিক ফাইনাল ম্যাচটি দেখেছেন, এমন ম্যাচ ফুটবল বিশ্ব আর কবে দেখেছিলো? যেই ম্যাচের প্রতিটি সেকেন্ডে সেকেন্ডে ছিলো থ্রিল, মিস্ট্রি, এডভেঞ্চার, চ্যালেঞ্জ, এক মহারথীর সেরাদের সেরা হওয়ার স্বপ্নের অসম্ভব তাড়না, ছিলো এক কবির মহাকবি হয়ে উঠার পথে এক সর্বশেষ এবং মহামূল্যবান পংক্তিটি লিখে ফেলার বাসনা, ছিলো এক ফরাসি তরুণের তারুণ্যের বিদ্রোহী উত্তাপ, ছিলো তার স্বপ্ন ভঙ্গের এক করুণ ট্র্যাজেডি। আবার অন্যদিকে ছিলো বহু প্রচেষ্টায় মহাকাব্য লেখে ফেলার পর আনন্দ অশ্রুতে ভেসে যাওয়া একটা আবেগী এবং স্বপ্নবাজ দল। একদিকে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষুধা নিয়ে ফরাসি বীর নেপোলিয়নের মশাল হাতে কিলিয়ান এমবাপ্পের দম আটকে দেয়া দৌড়, অন্যদিকে এক ফুটবল রাজপুত্র লিওনেল মেসির রাজা হওয়ার অপেক্ষা।
একজন মানুষ, যিনি খেলেছেন তার অধরা স্বপ্ন বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিটার জন্য। আর একটা দল যারা খেলেছে সেই একজন মানুষের জন্য। এবং পুরো বিশ্ব প্রার্থনা করেছে সেই একটা মানুষের স্বপ্ন পূরণের জন্য। এখানেই লাতিন লেখক পাওলো কোয়েলহোর আলকেমিস্টের নায়ক লিওনেল মেসি। এক লাতিন আমেরিকান যেনো তার গল্পটা সাজিয়েছিলেন তার প্রতিবেশী আরেক লাতিনের জন্য। গল্পটা লেখা হয়ে গেলো কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে। এখন আর মেসিকে সেরাদের সেরা বলতে বাধা রইলো না। রইলো না আর্জেন্টিনা এবং সমর্থকদের উদ্দ্যেশ্যে দেওয়া সেই খোঁচা “৩৬ বছর ধরে কাপের দেখা নেই।” যাই হোক, ফুটবল উন্মাদনায় যেহেতু মেতেছিলো পুরো বিশ্ব এবং বাংলাদেশও বাদ যায়নি, সেখানে বিশ্বকাপের দেখা গল্পটা আবারো বলার দরকার নেই। এটা শুধু একজন ফুটবল সমর্থকের আবেগ, যে মেসিকে দেখেই একজন ফুটবল সমর্থক হয়েছে।
এখন আসি যেই গল্পটা বিশ্বকাপ ঘিরেই আলোচনায় ছিলো দুর্দান্ত সব ম্যাচের সাথে হট টপিক হয়ে। এটা একটা রাজনৈতিক গল্প। কয়েকটি প্রশ্নের উত্থাপন এবং প্রশ্নগুলোর জবাবের মধ্য দিয়ে আলোচনা শেষ করবো। প্রথম প্রশ্ন, কাতার এই বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ হিসেবে রাজনৈতিক ভাবে সারা বিশ্বকে কী বার্তা দিলো? দ্বিতীয় প্রশ্ন, পশ্চিমের যারা লিবারেল এবং সাধারণ মানুষ রয়েছেন, যাদের চোখের সামনে দিনের পর দিন পশ্চিমা মিডিয়াগুলো মধ্য প্রাচ্য সম্পর্কে একটা মিথ্যার কুয়াশা তৈরি করে আসছিলো, তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে? একটি মুসলিম দেশ হিসেবে তাদের রেস্ট্রিক্টেড এপ্রোচটা কেমন প্রভাব ফেলেছে এবং শেষ পর্যন্ত এটার মূল্যায়নটা কেমন হচ্ছে? পশ্চিমা ডন যারা নিজেদের দুনিয়ার হর্তাকর্তা মনে করে, তাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাতারের এই বাহাদুরিমূলক আয়োজন কেমন প্রভাব ফেলবে? তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসহ পুরো ব্যাপারটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
প্রথম প্রশ্ন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হিসেবে পুরো বিশ্বকে কাতারের রাজনৈতিক বার্তা কেমন হতে পারে? বার্তাটা দুই ধরনের হতে পারে। এক, আরব বিশ্বের প্রতি। আরব বিশ্বে কাতারের ভাবমূর্তি ও আন্তঃরাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান। তেল নির্ভর আরব বিশ্বে একটি আইডল হতে পারে কাতার। নিজেদের সম্পদ কাজে লাগিয়ে কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে কিভাবে ব্র্যান্ড হতে হয় সেটা আরবের অন্য দেশগুলোর জন্যেও শিক্ষণীয় হতে পারে। যাতে পশ্চিমা নির্ভরতা কমতে পারে। দুই, পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি। দেখো আমরাও পারি। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তোমাদের ভ-ামির চিত্র তুলে ধরার বিজ্ঞাপন হলো এই বিশ্বকাপ। সারা বিশ্বকাপ জুড়েই ফিলিস্তিন তেত্রিশতম দেশ হিসেবে যেন বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিলো। এবারের বিশ্বকাপে দুর্দান্তভাবে খেলে সেমিফাইনালিস্ট মরক্কোর প্লেয়াররা পর্যন্ত ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে উদযাপন করেছে। সারা দুনিয়া দেখুক, পশ্চিমা নীল নিকশা কী করে আরবের বুকে একটা বিষফোঁড়া পুঁতে দিয়েছে। সাথে ইসরায়েলের পাসপোর্টে নিষেধাজ্ঞা।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা পশ্চিমের মিডিয়া নিয়ে, যাদের মিডিয়া সন্ত্রাসও বলা যায়। তিলকে তাল বানিয়ে বছরের পর বছর সাধারণ মানুষের কাছে আরব তথা মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে যে গল্প প্রচার করে আসছে তারও একটা মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ উন্মোচনে বাড়তি মসলা হিসেবে কাজ করবে। শান্তি, মানবতা আর গণতন্ত্রের নামে অশান্তি আর পৈশাচিক অনুশীলন শুধু পাশ্চাত্যের গুটিবাজিতেই যে হয় এটা পরিষ্কার। দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধের লজ্জা আর কলঙ্ক ঢাকতে বলির পাঠা বানিয়েছিলো মধ্যপ্রাচ্যকে।
পশ্চিমা ডনরা কাতারের আস্পর্ধাকে কীভাবে নিবে? ইতোমধ্যে কাতার বিশ্বকাপ ইতিহাসের জঘন্য বিশ্বকাপ, মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করা বিশ্বকাপ ইত্যাদি ইত্যাদি স্লোগান তোলা হয়ে গেছে। যদিও তেমন কাজে আসে নি। তবে সামনে তাদের ঘৃণ্য স্ট্রেটেজির রোষানলে কাতার পড়বে কিনা সে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
মুসলিম সংস্কৃতির বার্তাটা কাতার বিশ্বের মাঝে পৌঁছে দিতে চেয়েছে। অনেক কিছু রেস্ট্রিকটেড হলেও প্রশংসা কুড়িয়েছে এই মহা আয়োজন। ফিফার সভাপতি নিজেই বলেছেন, “এই পর্যন্ত সেরা বিশ্বকাপ।” সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সাংবাদিকদের ইন্টারভিউগুলোতেও দেখা গেছে, নারীরা মন্তব্য করছেন, তারা এখানে অনেক নিরাপদ অনুভব করছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মরগান ফ্রিমেন এবং ঘানিম আল মুফতাহর যুগলবন্দী প্রদর্শনী একটা সুস্থ সংস্কৃতির বার্তা দিয়েই দিয়েছিলো। সমাপনী অনুষ্ঠানে কবিতা পড়েছিলেন ফিলিস্তিনের কবি তামিম আল বারগুছি ও কবি মুহাম্মদ ওউলদ বেমবা। মজলুম কবি তামিম আল বারগুছি তার কবিতার মাধ্যমে শান্তি ও সাম্যের বার্তা দিয়েছেন। অন্যদিকে কবি মুহাম্মদ ওউলদ বেমবা ইমাম শাফেয়ির বিখ্যাত চারটি লাইন পড়েছিলেন। যা পশ্চিমা বিশ্বের কটাক্ষের প্রতি পাল্টা জবাব। লাইনগুলো আমাদের সবারই জানা,
“যারে তার সবই ভাল
যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা
যদি তুচ্ছ কর, তবে সেটাই পাবে
যে যেমন, ভালÑতারে তেমনি দেখা”
সব শেষে কথা হলো, প্রাচ্যের বিশ্বকাপ এইদিকের সংস্কৃতির সাথে খুব আধুনিক ইউরোপ এবং আমেরিকার পরিচয় ঘটিয়েছে। যেমন, ব্যক্তি জীবনে পরিবার যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে সেটা মরক্কোর হাকিমিরা দেখিয়ে দিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের সমর্থকরা করে ফেলেছে অনন্য কীর্তি। তাদের সমর্থনের খবর পৌঁছে গিয়েছে বুয়েন্স আয়ার্স থেকে মেসির পরিবার পর্যন্ত। কাতারে অবস্থিত বাংলাদেশী দর্শক এবং বিশ্বকাপ উপলক্ষে যাওয়া গণমাধ্যমকর্মীরা দেশের ব্র্যান্ডিংটা ভালোই করেছেন। এখন হয়তো আশা করা যায় আর্জেন্টিনা এবং বাংলাদেশের সাথে ফুটবলের যে রুহানি সম্পর্ক তা কূটনৈতিক সম্পর্কেও পরিণতি পাবে।
ফুটবল সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে পৃথিবীকে নিয়ে আসুক শান্তি ও সাম্যের কাতারে। কাতার বিশ্বকাপ যেনো শান্তি, সাম্য এবং সুস্থ সংস্কৃতির পাঠ্যবইগুলোর বাস্তব উদাহরণ। পৃথিবী ভালো থাকুক। ভালো থাকুক প্রত্যেকটা মানুষ। ‘যুদ্ধই জীবন ও যুদ্ধই সার্বজনীন’ এক ইউরোপীয়ানের এই কথাটা যে আসলে ভুল তা বারবার প্রমাণিত হোক। চৌদ্দশ বছর আগে মরুর বুকে এক মহামানব এসেছিলেন। যিনি সারা বিশ্বের অন্ধকার ঘোচাতে যে শিক্ষাটা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটাই যেনো কাতার বিশ্বকাপ সারা পৃথিবীকে মনে করিয়ে দিলো।
লেখক : হাসান মাহাদি, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
ইমেইল : [email protected]