শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   দিনমজুরকে জবাই করে হত্যা, ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন
  •   অবশেষে চাঁসক সহকারী অধ্যাপক কামরুল হাছানকে বদলি
  •   নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সড়কের ওপর ভবন নির্মাণের অভিযোগ
  •   বাবা মায়ের উপর ছেলেদের নৃশংসতা ।। বৃদ্ধ বাবার থানায় অভিযোগ
  •   ফিরে এলেন আগের খতিব, নামাজের আগে নাটকীয়তা বায়তুল মোকাররমে

প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

জান্নাত বোরকা বাজার

আয়েশা সিদ্দিকা
জান্নাত বোরকা বাজার

(গত সংখ্যার পর)

সেদিনের পরে মাঝখানে দিন পাঁচেক কেটে গেলো। পাঁচদিন আবিদা খুবই ব্যস্ত ছিল। ভোরে বাংলা প্রাইভেট সদরে। প্রাইভেট শেষ করে কলেজে ক্লাস। ক্লাস শেষ করে অর্থনীতি প্রাইভেট। তিন দিন অর্থনীতি, তিনদিন ইংরেজি। সব শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল, গিয়ে গোসল খাওয়া তারপর বিশ্রাম। এর মধ্যে জিল্লুর রহমান আবিদাকে অনেকবার খুঁজতে এসেছে। আবিদা কখনো বাসায় নেই, কখনো ঘুমায়। বুধবার ছুটির দিন ছিল কোনো কারণে। ছুটি থাকলে আবিদা প্রাইভেট পড়তেও যায় না। কারণ প্রাইভেট পড়াও অনেক দূরে, কলেজ থেকেও দূরে। ছুটির দিনগুলো অনেকটা সময়ই আবিদার পুকুর পারে কাটে। নির্জন একটা জায়গা, আর নিরাপদও। ওখানে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় (বাসার ভেতর থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় না) তাই আবিদা বাসায় থাকাকালে সকাল বিকাল অথবা সময় পেলেই ওখানে চলে যায়। পুকুরের পরেই বিশাল বড় বিল। সামনে তাকালে সবুজের সমারোহ। এমনও হয়েছে আবিদা ছাতা নিয়ে সেখানে বসে কাটিয়েছে অনেক সময়। বুধবার সকালে ঘরে আবিদাকে খুঁজে না পেয়ে পুকুর পারে গেলো জিল্লুর রহমান।

-ভাই তোরে ক’দিন ধরে খুঁজলাম, পাইলাম না। কই থাকোস?

-কে¤েœ পাইবা, সকালে বাইর হই, বিকালে ঘরে আসি। কিছুদিন পরে এইচএসসি পরীক্ষা। অনেক প্রেসার যাইতেছে এখন। কী জন্য খুঁজতেছিলা বলো?

-ভাই একটা দরকারি কথা আছে। কালকে দুপুরে আমাগো ঘরে খাবি। জামালের মাইয়ার নাম রাখার অনুষ্ঠান। হুজুর আইবো। কয়েকটা নাম ঠিক করে রাখতে কইছে। হুজুর ভালোটা বাইছা দিব। তুই কয়টা নাম ঠিক করে দেস না ভাই।

-আমি নাম দিলে সেইটা রাখবা তোমরা?

-হ, তুই যেটা কস সেটাই রাখমু।

-আচ্ছা যাও, রাতে কয়টা নাম লিখে দিব আমি।

এই মুহূর্তে আবিদার জিল্লুর রহমানের সাথে কথা বলতে ভালো লাগছিলো না। আবিদা অন্য চিন্তায় মত্ত। এরপর জিল্লুর রহমান সেখান থেকে চলে গেল। তারপর আবিদা ভাবছে কী নাম রাখা যায়। আবিদার পছন্দের একটা নাম আছে। সেটা আবিদারই আরেকটা নাম। অনেক ভালোবাসায় জড়ানো নাম। সেই নামটা কী দিবে আবিদা অন্য কাউকে! এই নিয়ে দোটানায় ভুগছে। দিলে কী কী হতে পারে, আর না দিলেই বা কী কী হতে পারে সেসব ই ভাবছে। আজকে আবিদার ইরফানকে খুব মনে পড়ছে। ছুটির দিনগুলোতে বেশি মনে পড়ে। কাজ-টাজ থাকে না তো। এই পুকুর পারে বসে কতো বেলা ইরফান-এর সাথে ফোনে কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছে আবিদা। তার হিসেব নেই। কিন্তু এতো দূরের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সত্যিই কষ্টকর।

-এতো দূর থেকে কেনো আসো?

-তোমাকে একবার দেখতে আসি আবিদা।

-এসো না। আমার ভালো লাগে না। অপরাধ বোধ হয়। তুমি আমার জন্য এতো কষ্ট করে আসো। কত রাত ঘুমাতে পারো না। বিধ্বস্ত দেখা যাচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। অফিস, পড়াশোনা তারপর আমি। আমার নিজেকে এখন তোমার একটা বাড়তি বোঝা মনে হচ্ছে।

-কেনো এভাবে বলো! তোমাকে দেখলে আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সত্যি সত্যি না আসলে বুঝবা তখন।

-জানি কষ্ট হবে। কিন্তু তুমি ভালো আছো শুনলে আমার আর কিচ্ছু চাই না।

-আমি এখন বেশি ঠিক আছি বাবা, এতো কেনো ভাবছো! আমার তো একটুও কষ্ট হচ্ছে না এভাবে আসতে।

-আমার কষ্ট হচ্ছে তোমার প্যারা দেখে।

-আমাকে সামনে দেখে খুশি লাগছে না?

-হ্যাঁ লাগছে তো। অনেক লাগছে। কিন্তু তুমি...

-থামো আবিদা। সময়টাকে উপভোগ করো। আমি বিকেলেই চলে যাব আবার। কাল সকালে ক্লাস আছে, বিকেলে অফিস। সময় কোন দিক দিয়ে পেরিয়ে যায় টেরও পাই না।

ইরফান এক দৃষ্টিতে আবিদার দিকে তাকিয়ে আছে।

-তোমার নাকটা খুব সুন্দর আবিদা। আমি প্রথমে ওই নাকটার প্রেমে পড়েছি।

-নাকের প্রেমে পড়ে মানুষ! এই প্রথম শুনলাম।

-তো আরও কতোজনকে প্রেমে পড়তে শুনেছেন আপনি?

-কাউকেই তো শুনিনি। সিনেমায় শুনেছি আরকি, চোখ দেখে প্রেমে পড়ে, মুখ দেখে তারপর চুল দেখে। আর তুমি নাক দেখে।

-সবার দেখার দৃষ্টি এক রকম হবে না এটাই তো স্বাভাবিক আবিদা।

-তোমার নাকটা দেখেছো? আমার নাকটার দ্বিগুণ হবে।

-কীভাবে বুঝলে?

-দেখো ছবি, আমি দুটা কম্পেয়ার করে দেখেছি।

-এগুলা করো?

-হ্যাঁ করি। চোখগুলো ও দেখেছি, তোমার চোখগুলো আমার চোখগুলোর থেকে ছোট।

-আর কী কী দেখেছো?

-হাইট, আমি তোমার কাঁধ পর্যন্ত। তাও এক ইঞ্চি উঁচু জুতা পরে। তুমি কত লম্বা!

-আমার তো একদম পারফেক্ট মনে হয় আবিদা।

-ঠিকাছে, তাহলে পারফেক্ট।

এক বছরের প্রেমে ইরফান এভাবে প্রায়ই গ্রামে চলে আসতো বিভিন্ন ছুতোয়। শেষ বার যখন তাদের দেখা হয়েছিল,

-গত রাতে যখন ঝড় হচ্ছিলো তুমি তখন কী করছিলে ইরফান?

-বিজলির আলোতে একটা মুখ সামনে ভেসে উঠছিলো, লঞ্চে ছিলাম তো, প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম, পরে মজাই লাগতেছিলো।

-কার মুখ ভেসে উঠেছে।

-জান্নাতের।

-এটা আবার কে?

-কেউ না। তুমি কী করছিলে বৃষ্টির সময়?

-তুমি সকালে আসবে ভেবে আমার তো ঘুমই হচ্ছিলো না। বসে বসে চিরকুট লিখেছি।

-কই দেখি কী লিখেছ?

-তুমি চলে যাবে তখন দিব। আমার সামনে বসে পড়লে আমার লজ্জা লাগবে।

-ওরেএএ লজ্জাবতী মেয়ে, দেখি মুখটা!

-তুমি আমাকে লজ্জাবতী বলবে না?

-কী বলবো তাহলে?

-জান্নাতকে সেটা বলো। তারপর সব বলবে।

-আমার তো ঢাকায় একটা প্রেমিকা হয়েছে। তার নাম জান্নাত।

এ কথা শুনে আবিদা একেবারে থেমে গিয়েছে! মানে আবিদার মুখ দিয়ে আর একটাও কথা বের হচ্ছে না।

-আবিদা, তোমাকে একটা নাম দেই?

-জান্নাতকে নাম দাও গিয়ে, আমাকে দিতে হবে না।

-আমি তোমাকেই দিতে চাই। বলো দিব নাকি?

-হ্যাঁ দাও। (একটু রাগী কণ্ঠে)

-যদি পছন্দ না হয় তোমার?

-না হলেও নিব।

-নিবে? পছন্দ না হলে কেন নিবে?

- জানি না।

-আচ্ছা। অপশন দিচ্ছি, তুমি বেছে নাও একটা।

-ওকে।

-জান্নাত/জান্নাত/জান্নাত।

অপশন তিনটা বলেই ইরফান আবিদার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

-এইবার বুঝেছ জান্নাত কে?

হঠাৎ করেই আবিদার মেঘাচ্ছন্ন কালশিটে মুখমণ্ডলটা হাসিমুখে পরিবর্তিত হয়ে গেল। আবিদা হেসে উত্তর দিলো,

-অপশন দিতে গেলে কেন? বললেই হতো আমি জান্নাত নাম টা দিতে চাই তোমাকে।

-নাম পছন্দ হয়েছে?

-অনেক পছন্দ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এর আগে আব্বু আম্মুর পরে আমাকে কেউ নতুন নাম দেয়নি। আমার খুব খুশি লাগছে এজন্য।

-এবার চিরকুট দাও, আমার এখনি পড়তে মন চাচ্ছে।

-দাঁড়াও দিচ্ছি। কিন্তু জোরে জোরে পড়বে না। আমার লজ্জা লাগবে শুনতে।

-আচ্ছা পড়বোই না।

আবিদা নীল খামে করে নিয়ে আসা সাদা কাগজের চিরকুট টি ইরফানের হাতে দিল। চিরকুট হাতে পেয়েই ইরফান জোরে জোরে পড়তে আরম্ভ করলো।

-চিরকুট পড়লে জরিমানা দিতে হবে।

-কী জরিমানা চাও বলো।

-প্রতি লাইনে একটা করে চিমটি কাটতে চাই, সে অনুমতি লাগবে।

-এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। (ইরফান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে)

ইরফান চিরকুট পড়ছে, আর আবিদা প্রতি লাইনের জন্য ইরফানের হাতের উপরে একটা করে চিমটি কেটেছে। ওই দিনটার কথা আবিদার সমসয় মনে পড়ে। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো, কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয়েছে যখন দুজনের পরিবারের মানুষ এই সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছে। সবাই সব জানাজানির পরে ইরফান একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে আবিদা কে ফোন দিয়ে সম্পর্কটা রাখতে চায় না বলে জানিয়ে দিয়েছে।

-আবিদা আমার মনে হচ্ছে সম্পর্কটা এখানেই শেষ করে দেয়া উচিত।

-মজা করছো ইরফান?

-না আবিদা, আমি সিরিয়াস। বাসায় সব জেনে গেছে।

-তো! আমার বাসায়ও জেনেছে। আমি তো এটা এক্সকিউজ দেইনি।

-তুমি বুঝতেছো না আবিদা। আমার প্যারা হয়ে যাচ্ছে। দেখছো তো সময় পাই না।

-আমিও সময় পাই না। আর তুমি সময় পাও না নিয়ে আমি তো অভিযোগ করিনি। এরকমটা কথা ছিল না ইরফান।

-কথা অনুযায়ী কিছুই হয় না আবিদা। সাধু সাজতে এসো না। তুমি যেটা করেছ সেটা ঠিক করোনি। আর কিছু বলার নাই। ভালো থেকো।

-আমি কী করে...

কথাটা শেষ করার আগেই ইরফান ফোন কেটে দিয়েছে। আবিদাকে আর একটা কথা বলারও সুযোগ দেয়নি। সব কিছু থেকে ব্লক করে দিয়েছে। আবিদা কম করেও শত বার ইরফানকে ফোন দিয়েছে। তিনদিন এরকম টা করেছে। তারপর আর যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। ইরফানের সাথে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার প্রায় এক মাস পরে আবিদা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। পড়াশোনায় সিরিয়াস হবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে নিজের সাথে। আবিদা একটা নতুন জায়গায় আইসিটি (ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি) প্রাইভেট পড়তে শুরু করেছে। ব্যাচেলর শিক্ষক। স্কুলের কিছু বন্ধু-বান্ধবী দের সাথের একটা ব্যাচের এই প্রাইভেট টা আরোও আগে শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু ইরফান চায়নি আবিদা ব্যাচেলর শিক্ষকের কাছে পড়ুক। তাই আবিদা কোনো বিষয় ই পুরুষ শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়েনি। অর্থনীতি খুব কঠিন লাগতো আবিদার। তবুও বিসিএস ব্যাচেলর টিচার বাদ দিয়ে মহিলা গেস্ট টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়তো, ইরফান মন খারাপ করবে সেজন্য। আবিদা বুঝতো এই ম্যামের পড়া সে কিছুই বুঝে না। মিডটার্ম পরীক্ষাগুলোতে পর পর রেজাল্ট ও খারাপ হচ্ছে। কিন্তু ইরফান কে কষ্ট দেয়া যাবে না। মানুষ টা আবিদার কথা এত ভাবে, সেজন্যই তো সবসময় ভালো মন্দ বলে দিত। আইসিটি প্রাইভেট প্রতি সপ্তাহে তিনদিন, শনিবার, সোমবার আর বুধবার।

(চলবে, পরের পর্ব আগামী

সংখ্যায় প্রকাশিত হবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়