প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
অনিশ্চিত অপেক্ষা

প্রথমবার দূরে কোথাও বাসযাত্রা। এর আগেও বাসে অন্য কোথাও গিয়েছিলাম, তবে সেটা কাছাকাছি। রাত দশটায় বাস। বিলম্বে এগারোটা বাজলো। যদিও আমি দশটায়ই বাসে উঠে বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিলাম, তবে তখনও সবাই পৌঁছায়নি। চলন্ত বাসের খোলা জানালার পাশে বসে আমার পুরো শরীর অত্যাধিক বাতাসে জমে যাচ্ছিলো। শুনতে ভীতিকর মনে হলেও ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার জীবনে কোনো দুঃখ কষ্ট নেই, আক্ষেপ নেই, কোনো না পাওয়া নেই, কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষাও নেই।
বাসের গতিশীলতা জীবনের গতিশীলতার সাথে মিশে গেছে হয়তো। আর সে গতিশীলতায় সব খারাপ কিছু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সেগুলো হয়ত আর কখনও আমাকে ছুঁতে পারবে না। একটু নিজেকে সুখী মানুষ ভাবতে না ভাবতেই আমার মনে হলো আমার ধারণা পুরোটাই ভুল। কিছু না থাকলেও একটা তুমি আছো, ছাইচাপা আগুনের মতো ভেতর থেকে ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে উঠো আর তিলে তিলে পোড়াও আমাকে। তাই জন্য এমন সুন্দর একটা মুহূর্তকে নষ্ট করতেও আমার মনে হানা দিচ্ছো। তাই আমার তোমাকেই মনে পড়ে, এখানে ওখানে, যেখানে সেখানে, যখন তখন। ওই উপভোগ্য পরিবেশ ও তোমায় ছাড়া কেমন যেন অসম্পূর্ণ লাগছিলো।
তোমার সাথের সেই প্রথম এবং একমাত্র বাসযাত্রার কথা মনে পড়ছিল খুব। সেইবার প্রথম আমি বাসে বমি করিনি, হয়ত তুমি পাশে ছিলে বলেই। তোমাকে নিজের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে, জানালার পাশের সিটে বসে তোমার কাঁধে মাথা রেখে পাবলিক বাসের চিল্লাচিল্লির মধ্যেও নিশ্চিন্তে সে কী ঘুম! এখন আর অত সহজে ঘুম পায় না বাসে। তুমি আমার পুরোটাজুড়ে জড়িয়ে আছো প্রতিটি শিরায় শিরায়। আর থেকেও যাবে, হয়ত কখনও এড়াতে পারবো না আমি। এবার এই দূরপাল্লার বাস যাত্রায় আসা যাক। প্রথম যখন স্থির বাসে উঠেছিলাম তখন এমন গুমোট একটা পরিবেশ ছিলো যে আমার মনে হচ্ছিলো এই বদ্ধ বাস টায় দশ মিনিট অবস্থান করলেই আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু বাসের জানালা খুলে দিয়ে তারপর যখন বাস চলতে শুরু করলো তখন আমার সব খারাপ অনুভূতি কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। মনে হচ্ছিলো এভাবে চলমান হলেই তো জীবন সুন্দর।
আক্ষেপ, না পাওয়া হারিয়ে যায় জীবনের নানাবিধ গতির সাথে সাথে। আমার জীবনও হয়ত এমন একটা গুমোট আবহাওয়ায় আটকে আছে। যেখানে শুধু ক্লাস, বাসা, আর অবসরে তুমি অগোচরে আমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কেড়ে নিয়ে যাও, আমি টেরও পাই না। কিন্তু এর বাইরেও জীবন আছে, জীবনের গতিশীলতার, বৈচিত্র্যতার অনেক পন্থা আছে। আমি তা খুঁজতেই যাইনি। নিজেকে তোমার ইল্যুশনের সাথে একটা বদ্ধ ঘরে আটকে রেখেছি। দরজা, জানালাজুড়ে তোমাকেই রেখে দিয়েছি তো। তাই বাইরের সুন্দর পৃথিবী ঢেকে রয়েছে, আমার সাধ্য হচ্ছে না তোমাকে সরিয়ে সে সুন্দর পৃথিবীটাকে উপভোগ করার। আমি চাইলেও তোমায় সরিয়ে সে সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে পারি না। তোমার শক্ত অবস্থান অধিক শক্তিশালী। তাকে সে গুমোট আবহাওয়ার বদ্ধ ঘর থেকে বের করে নিজেকে মুক্ত করে আমার পৃথিবীটাকে রঙিন এবং আলোকিত করতে হলে আমাকে হতে হবে আরোও বেশি শক্তিশালী।
তুমি আসলে কে! তুমি ধূলিমাখা সবুজ পৃথিবীতে বিরাজমান কোনো এক রঙিন সত্তা। আমার পৃথিবীতে যে প্রয়াত। আর সেই প্রয়াত তোমাকে আঁকড়ে ধরেই প্রতিনিয়ত আমার পথচলা। আজও তোমার যে বিষয়গুলো খারাপ লাগে সেগুলো করতে আমার ভেতরে জঘন্যভাবে লাগে। আমি সে কষ্ট পাওয়ার ব্যাপারটাকে উপভোগ করি। সে উদ্দেশ্যে তোমার খারাপ লাগা কাজগুলো বেশি করি। নিজেকে বোঝানোর জন্য, যে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই আমার পৃথিবীতে। তুমি প্রয়াত। প্রশ্ন করবে না, কেন তুমি প্রয়াত? আমিই বলছি। তুমি এমন একজন ছিলে, যে ভালোভাবে ঘুমাতে না বললে আমার ঘুম পেত না। যাকে না দেখলে সকাল হতো না। যার সাথে কথা না হলে চব্বিশ ঘণ্টার একটা গোটা দিনকে অসম্পূর্ণ মনে হতো। যার সাথে ঝগড়া হলেও আমার শান্তি লাগতো। ঝগড়ায় ও একটা আশ্বাস ছিলো, দিনশেষে তুমি আছো, অগোছালো আমাকে ভালোবেসে গুছিয়ে নেয়ার মতো একজন মানুষ আছে, আমার পৃথিবী রঙিন। আমি যে তোমাকে ভালোবাসতাম, যে তোমার প্রতীক্ষায় প্রতিটি প্রহর অপেক্ষা করতাম, সে তুমি আমার প্রতীক্ষা, অপেক্ষা, আস্থা সবকিছু কে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে, আমার পৃথিবীকে একটা গুমোট বদ্ধ ঘরে আটকে রেখে, আমাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে হারিয়ে গেলে কোনো এক রঙিন জগতে। আমার পরিচিত তুমি এক মুহূর্তে একেবারে অপরিচিত হয়ে গেলে। অপরিচিত, পরিবর্তিত তোমাকে মেনে নেয়ার থেকে প্রয়াত তোমাকে মেনে নেওয়া ঢের সহজ, এবং ভালো ও। তোমাকে অবিশ্বাস করা ব্যাপারটাকে সবসময় ই আমার পাপ মনে হতো। এখনো তাই মনে হয়। তোমাকে অবিশ্বাস করে, তারপর অবিশ্বাস থেকে জন্ম হওয়া ঘৃণা। তোমাকে ঘৃণা করে বাকিটা জীবন কীভাবে কাটাই বলতো! এটা বড্ড কঠিন হবে আমার জন্য। আমি যে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম সে তুমি তো আমায় ছেড়ে যেতে না। সব পরিস্থিতিতে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে। আমি কী করে তোমার প্রতিশ্রুতিকে অবিশ্বাস করে বাকি জীবনটা কাটাবো! তাই আমি বিশ্বাস করি আমায় যে তুমি ভালোবেসেছিলে, পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে সে তুমি আর নেই। অচেনা পৃথিবীতে হারিয়ে গেছো। তাই আমার পৃথিবীতে তুমি প্রয়াত। অথচ দেখো, প্রয়াত তুমিও সুন্দরভাবে আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
তোমার নিয়ন্ত্রণাধীন আমার জীবন কোনো এক অজানা বেড়াজালে আটকে আছে। নিজেকে অজানা বোঝালেও আমার ভেতর জানে এই বেড়াজাল মোটেও অজানা না। তোমার অভিনয়ে তিল তিল করে গড়ে ওঠা এক বেড়াজাল। তোমার দেয়া অনিশ্চিত অপেক্ষার বেড়াজাল। নিশ্চিত অপেক্ষা মানুষের মনে মধুর অনুভূতি সৃষ্টি করে। তোমার প্রতিশ্রুতি মিথ্যে হলেও, তাতে বিশ্বাস করে আমার নিশ্চিত অপেক্ষা মিথ্যে ছিলো না।
অনিশ্চিত অপেক্ষা মৃত্যু থেকেও ভয়ংকর। তুমি সে ভয়ানক অপেক্ষা আমাকে দিয়ে গেছো। এখন আমি জানি না আমি ঠিক কীসের জন্য অপেক্ষা করছি, কবে পর্যন্ত অপেক্ষা করবো সেটাও জানি না। কিন্তু এটা জানি, আমি অপেক্ষা করছি। তুমি যদি মালয়েশিয়ার হারিয়ে যাওয়া উড়োজাহাজ এমএইচণ্ড থ্রি সেভেন্টি এর মতো অজানায় হারিয়ে যেতে, আমি আমৃত্যু তুমি ফিরবে এই নিশ্চিত অপেক্ষা নিয়েই সুন্দরভাবে জীবন কাটিয়ে দিতাম। তুমি ফিরবে ভেবে তোমায় নিয়ে একটা পৃথিবী সাজাতাম। তোমার জন্য অপেক্ষা করাটায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। এই অপেক্ষাটাকেই কখন জানি নিজের নিয়তি ভেবে ভালোবেসে ফেলেছি। অভ্যস্ততা কাটাতে মানুষের নতুন অভ্যাস বানাতে হয়। আমি সেটা বানাতে পারিনি। তুমি এখনও আমার অভ্যাস, এখনো আমার লুকোনো হাসি, লুকোনো কান্না। গভীর রাতের যোগাযোগের তৃষ্ণা। আর তৃষ্ণার্ত মনের এক ভয়ানক হাহাকার। প্রায় জোড়া বছর আগের প্রয়াত তুমি এখনো আমার অনিশ্চিত অপেক্ষা। হয়ত এই অপেক্ষা ঘুমের ঘোরে প্রয়াত তোমাকে একবার স্বপ্নে দেখার, সেই আগের মতো করে। হয়ত এই অপেক্ষা নতুন কোনো অভ্যাস বানিয়ে নিজেকে সেই তুমি নামক গুমোট আবহাওয়া থেকে মুক্ত করার। হয়ত এই অপেক্ষা মৃত্যুর। হয়ত এই অপেক্ষা পরের জন্মে (যদি থাকে) তোমার সাথে আরোও কয়েক কদম হাঁটার। আমার অনিশ্চিত অপেক্ষায় অবস্থানরত মানবাকৃতির সেই অমানবিক প্রাণীটির কথা ভাবতে ভাবতে কখন জানি একটা গোটা রাত নির্ঘুম কেটে গেলো। ভোর ছটায় বাস কক্সবাজার পৌঁছালো। আমি টেরই পেলাম না। বাসে বাজতে থাকা সফ্ট মিউজিক বন্ধ হওয়ায় আমি বুঝলাম, বাস কক্সবাজার পৌঁছে গেছে। আমি আর জার্নি উপভোগ করার সুযোগই পেলাম না।