রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৫ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

দুই বছর এক মাস আট দিন

আয়েশা সিদ্দিকা
দুই বছর এক মাস আট দিন

কক্সবাজার ট্যুরের শেষের দিনের কথা। দুপুর দুইটায় লাঞ্চ শেষ করে চারটা অটো ভাড়া করা হয়েছিলো। বলছি ডিপার্টমেন্ট থেকে যাওয়া র‌্যাগ ট্যুরের কথা। গন্তব্য ইনানী বিচ এবং পাটুয়াটেক। সেখান থেকে রিসোর্টে ফিরে ফ্রেশ হয়ে, ডিনার করে রাতের বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া। সবকিছু প্রিপ্লানেড। অটোর উলটো দিকে বসলে মাথা ঘুরে, যার জন্য পুরো ঘুরার সময়টাই স্পইল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেটা হতে দেয়া যাবে না। ইতোমধ্যে তিনটি অটোর পেছনের সিট বুকড। একটা বাকি ছিল। সেটা তে উঠে একা একা বসে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। পরে অবশ্য এসেছে কয়েকজন। রওয়ানা হলাম ইনানী বিচের দিকে। রাস্তায় এক পাশে ছোট ছোট পাহাড় আর অন্যপাশে সমুদ্র। আহা কী প্রকৃতি! ওখানেই থেকে যেতে পারলে হয়ত আমার আত্মার প্রশান্তি হতো। একদিকে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ, অন্যদিকে পাহাড়, আমি মোটামুটি কনফিউজড ছিলাম কোনটা কে ইন্ডিভিজুয়ালি এঞ্জয় করা যায়। উপরন্তু আগে ছোট বড় নদী দেখা হলেও পাহাড় এই প্রথম দেখা। আবার পানির স্রোত আগে দেখেছি কিন্তু ভয়ংকর সুন্দর ঢেউয়ের শব্দ এই প্রথম শোনা হয়েছে। একটা ব্যাপার ফিরতে ফিরতে উপলব্ধি হলো। সেখানে দুরকমের পরিস্থিতি উপভোগ করলাম, মানে প্রাকৃতিক পরিস্থিতি। প্রথমে একটু চিন্তার বিষয় মনে হলেও পরে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়েছে। অনেকক্ষণ পথে মোটামুটি গরম লাগছিলো। আবার হুট করে দেখলাম ঠাণ্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিলো ডিপ ফ্রিজ খুলে সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এই দুই রকম পরিস্থিতি। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলেও বেশ অ্যাঞ্জয়েবল ছিল। এর কারণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অবশেষে সেই কারণ জানা গেলো। যেসব জায়গায় পাহাড়, সেসব জায়গায় পাহাড়ের জন্য বাতাস আটকে থাকে, তখন গরম লাগে। আবার যে-সব জায়গায় পাহাড় নেই, সেসব জায়গায় অনেক বাতাস, সেই বাতাসের জন্য শীত লাগে। যাই হোক, ইনানী বিচে পৌঁছলাম ঠিক তিনটা পঞ্চাশ মিনিটের দিকে। সবাইকে সময় দেয়া হলো আধ ঘণ্টা, বিচ ঘুরে দেখে তারপর পাটুয়াটেক এর দিকে রওয়ানা দিতে হবে। সেখানে সূর্যাস্ত দেখা হবে। অন্যান্য বিচগুলো থেকে ইনানী বিচ টা বেশি উপভোগ্য ছিল। কারণ সেখানে কোলাহল বিহীন শুনশান নিরবতা বিরাজমান ছিল। কখনো কখনো নীরব প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া খুবই প্রয়োজন। নিজেকে বোঝার জন্য, নিজেকে নিয়ে ভাবার জন্য। ঢেউয়ের শব্দে আমার এটাই উপলব্ধি হয়েছে, মানুষের সঙ্গ ছাড়া আরোও অনেক সঙ্গ আছে, নেশা আছে এই পৃথিবীতে, সবকিছু বাদ দিয়ে আমি হয়ত কোনো ক্ষণস্থায়ী নেশায় নেশাগ্রস্ত ছিলাম। যাই হোক, এই কম সময়ে কী আর মন ভরে প্রকৃতি উপভোগ করা যায়! প্রকৃতি নিজের নীরব নেশাগ্রস্ত ঢেউয়ের শব্দে সেখানে আটকে রাখতে চাইলেও সময় তো সীমিত। ঠিক আমাদের জীবনের মত। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ ঠিকভাবে বুঝে ওঠার আগেই জীবন মৃত্যু আলিঙ্গনের জন্য নীরবে প্রস্তুত হয়ে যায়। আমরা টের ও পাই না। এরপর পরের গন্তব্যে পৌঁছলাম, পাটুয়াটেক কক্সবাজার। আগের বিচ গুলো থেকে ওই জায়গাটা একটু ভিন্ন। পাথুরে বিচ বলা যায়। পাঁচটি বিচ ঘুরে শুধু এই একটা বিচে ই পাথর পাওয়া গেল। জায়গাটা ভালো লাগলেও আমি পারসোনালি তেমন উপভোগ করতে পারিনি। কারণ আমার শুনশান নিরবতা প্রয়োজন। সেখানে অনেক কোলাহল ছিল। পুরো সময়টাই আমি শামুক কুড়াতে ব্যস্ত ছিলাম। সে বিচ এর বিপরীত দিকে একটা ছোট পাহাড় ছিল। পাহাড় না, টিলা বলা চলে। ওখানে সূর্যাস্ত দেখার পরে এবার ফেরার পালা। আমি প্রথমে যে অটো তে ছিলাম সেটায় কয়েকজন ছেলে বসে ছিল। তাই অন্য একটা অটোতে পেছনের সিটে গিয়ে বসলাম। একাই ছিলাম। আমার রিকশা, ভ্যান, অটো, বাস এইসবের ড্রাইভার দের সাথে কথা বলার অভ্যাস আগে থেকেই। কিন্তু সবসময় না। আমার সাথের অন্য কেউ সামনে থাকলে বলা হয় না। একা থাকলে হয়। নিজের মতো প্রশ্ন করি। সেদিন ও তাই হলো। রিসার্চ এ রেপো বিল্ডিং (জধঢ়ঢ়ড়ৎঃ ইঁরষফরহম) নামে একটা টার্ম আছে। সেটার কনসেপ্ট হলো- পার্টিসিপেন্ট এর সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে তোলা যেন সে রিসার্চার কে ট্রাস্ট করতে পারে, তার নিজস্ব তথ্য প্রদান করার ক্ষেত্রে। অচেনা মানুষের সাথে কথা বলার জন্য আমার উদ্দেশ্য দুটা, প্রথমত রেপো বিল্ডিং স্কিল ডেভেলপ করা। সে উদ্দেশ্যে যে কারোর সাথে তাদের মতো করে, তাদের ভাষা (যতোটা সম্ভব) ব্যবহার করে মিশতে চেষ্টা করি। পরের উদ্দেশ্য হলো অন্যদের স্টোরি জানার ব্যাপারটায় ইদানীং অনেকটা নেশা হয়ে গেছে। সেদিনের ড্রাইভার লোকটার বয়স থার্টি প্লাস হবে। আমি তাকে নিজে থেকেই প্রশ্ন করলাম,

কী খবর ভাই, বাড়ি কই?

কক্সবাজার আপা।

সেটা তো বুঝলাম, উপজেলা, থানা, গ্রাম? এমন প্রশ্নের ভঙ্গিমা, যেন আমি সব চিনি সে জায়গায়। আসলে ওখান থেকে রিসোর্ট অবধি ফিরে আসতেই পারতাম না একা একা। সে আবারও উত্তর দিলো-

কক্সবাজারই আপা।

কক্সবাজার সদর?

হ আপা।

বাড়িতে কে কে আছেন?

আম্মা, আব্বা, ভাই, বোন।

বউ কই? লোকটার বয়স বিবেচনায় আমি ধরেই নিয়েছিলাম সে বিবাহিত। এই প্রশ্নটাই এক মুহূর্তে তার চেহারায় কোথা থেকে যেন এক আকাশ মলিনতা এনে ভরিয়ে দিলো। মুহূর্তেই তার চেহারার রং বদলে গেল। আমি বুঝলাম, আমার এই প্রশ্নের জন্য লোকটা মোটেই প্রস্তুত ছিল না। না চাইলেও সে উত্তর দিলো- (হয়ত আমার প্রশ্ন করার অ্যাপ্রোচটা ভালো ছিল, যার দরুণ লোকটা আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারেনি)

সে চইলা গ্যাছে আপা।

চইলা গ্যাছে মানে? কই চইলা গ্যাছে? বাপের বাড়ি?

না আপা। (মাথা নিচু করে)

তাইলে?

মলিন চেহারায় ঠোঁটের কোণে অপ্রাপ্তির মৃদু হাসি নিয়ে লোকটা উত্তর দিলো, সে অন্য একজনের কাছে চইলা গ্যাছে আপা।

কিন্তু কেন গেল ভাই? বউকে পিটাইতেন নাকি? (কিছুটা হাসির ছলে আমি জিজ্ঞেস করলাম)। একটা মেয়ে কেন তার সংসার ছেড়ে চলে যাবে, আপনি তাকে ঠিকভাবে রাখলে।

না আপা। অরে আমি কে¤েœ পিটামু, ওয় তো আমার সব আছিলো। আমার পুরা দুনিয়া আছিলো অয়। ওরে পিটানোর কথা তো আমি চিন্তা করতেও পারি না।

তাইলে কেন গেল?

জানিনা আপা।

লোকটার এই রকম উত্তর আমার খুব খারাপ লাগলো। মনে কষ্ট নিয়ে উত্তর দিচ্ছে অতক্ষণে সেটা বুঝে ফেলেছি আমি। কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, প্রশ্ন টা করে ভুল করেছি নাকি সেটা ভাবতে শুরু করলাম। ভাবতে ভাবতেই শুনছি-

আমাগো সাত বছর ছয় মাসের সম্পর্ক আছিল। অর অন্য জায়গায় বিয়া হইছে দুই বছর এক মাস আট দিন।

আমি কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। কী জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারছিলাম না। পরে সে যা বললো! আসলে আমার চিন্তার গণ্ডির বাইরে, এখনো এই রকম ভালোবাসা পৃথিবীতে এক্সিস্ট করে। সে চেহারার মলিনতা লুকানোর চেষ্টায় মৃদু হেসে বললো

আমাগো তো বিয়া হয়নাই আপা। তবুও অয়ই আমার বউ। আমি আর কাউরে বিয়া করার সাহস পাই নাই এহনো।

এই কথা শেষ করতে না করতেই অন্যরা চলে এসেছিল। আমার কিছু অব্যক্ত প্রশ্ন মনের মধ্যে রয়ে গেল। আরেকটু সময় পেলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম

আচ্ছা, আপনি কী প্রতিদিন হিসেব রাখেন, তার কতোদিন হলো বিয়ে হয়েছে? বিয়ের পরে তার সাথে আর কখনো কথা হয়েছিলো? তাকে দেখেছিলেন এই দুই বছরে একবার ও? তার প্রতি ক্ষোভ হয়নি আপনার?

আর কখনো ওই লোকটার সাথে আমার দেখা হবে না। প্রশ্নগুলো ও করা হবে না। তবে তার ভালোবাসার প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা জন্ম হলো। যে ভালোবাসার গভীরতা মলিন চেহারায় ভেসে উঠেছে। আমি অবাক হয়েছি এটা ভেবে যে প্রতারণা, বিচ্ছেদ, আধুনিকতার এ যুগে এখনো কত সত্যিকারের ভালোবাসা লুকিয়ে আছে আনাচে-কানাচে। যারা বোঝায় বিচ্ছেদ ই ভালোবাসার মৃত্যু ঘটাতে পারে না। লোকটার মনে হয়ত চলছে, ‘সে অন্য কারোর তো কী হয়েছে, সে তো আমার জীবনের ও একটা বড় অংশ। কোনো এক সময়ের হাসির কারণ। কোনো এক সময়ের আমার পুরো পৃথিবীজুড়ে থাকা একজন। বিচ্ছেদ নামক একটা ব্যাপারই তো সবকিছু শেষ করে দিতে পারে না।’ তাই সে হিসেব রেখেছে ‘দুই বছর এক মাস আট দিন’-এর। হয়ত এই হিসেব সে প্রতিদিনই করে। আর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে স্মরণ করে তার হারিয়ে যাওয়া রঙিন পৃথিবীকে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়