শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

আমার প্রাণের চাঁদপুর

সুধীর বরণ মাঝি
আমার প্রাণের চাঁদপুর

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সাহিত্যে আমাদের প্রাণের চাঁদপুর অনন্য। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সমৃদ্ধভূমি চাঁদপুর। হাজার বছরে অসংখ্য মানুষের কর্মে-শ্রমে-ঘামে গড়ে উঠেছে এ সুবর্ণ-অঞ্চল। ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে ছয় শতক থেকে সমতটকে স্বতন্ত্র জনপদ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এ মাটির সন্তানদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মধ্যযুগে মহাকবি আলাওলের আগে ‘কচুয়া’র সন্তান দোনাগাজী লিখেছেন ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামাল’ কাব্য। ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, বরেণ্য সংগীতজ্ঞ শান্তিদেব ঘোষ, দেশের প্রথম নারী চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা চৌধুরী, ‘দৃষ্টিপাত’-এর লেখক যাযাবর, ‘বেগম’ সম্পাদক নূরজাহান বেগম, জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মুনতাসীর মামুন, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, মনিরুল ইসলাম, ফরিদা জামান, ঢালী আল মামুনসহ বহু মানুষের কর্ম ও কীর্তিতে রত্নগর্ভা হয়েছে চাঁদপুর। চাঁদপুরের পালবাজারের মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছেন বাংলাভাষার বরেণ্য কবি শঙ্খ ঘোষ। রূপালী চম্পক (সংগীতশিল্পী), জসীম মেহেদী (কবি, নাট্যকার ও মঞ্চণ্ডঅভিনেতা), ইকবাল পারভেজ (কবি), মাইনুল ইসলাম মানিক (কবি ও অনুবাদক), কাদের পলাশ (কবিতা ও ছোটগল্পকার), আবু বকর সিদ্দিক (আবৃত্তিকার ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক), আশিক বিন রহিম (গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখেন)। এ জেলায় বিভিন্ন সময়ে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জসীমউদ্দীনের মতো কালজয়ী সাহিত্যিকরা। এ জেলার শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক রয়েছে। এখানকার লেখকদের লেখায় অনুষঙ্গ হিসাবে নদী, জল, ইলিশ, শস্য, অন্ত্যজ জীবন বিশেষ স্থান দখল করে আছে। চাঁদপুরের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ পুঁথিপাঠ। যুগ যুগ ধরে গ্রামে-গ্রঞ্জে পুঁথিপাঠের আসর বসত। অসংখ্য লোককথা ও কাহিনি চাঁদপুরের গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : বেহুলা-লখিন্দর ও চাঁদ সওদাগরের কাহিনি। মধ্যযুগের এসব মিথ এখনো সগৌরবে টিকে আছে। এ জেলার নিজস্ব কিছু লোকসংগীত রয়েছে। লোকগবেষক প্রকৌঃ মোঃ দেলোয়ার হোসেনের মতে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনোপখ্যানই এসব লোকসংগীতের উৎস। লোকসংগীতের অনুষঙ্গের মধ্যে নদীকেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রাধান্য রয়েছে। যেমন : ক) ‘আমার কাংখের কলসি গিয়াছে ভাসি/মাঝিরে তোর নৌকার ঢেউ লাগিয়ারে।’ খ) ‘আমি বইসা রইলাম নদীর কূলে/আমায় কেবা পার করে।’ চাঁদপুরে বন্দনাগীত, জারিগান, আধ্যাতিক গান, মাজারের গান, মারফতি, বেহুলার গীত, হঁঅলা, গজল, বিয়ের গীতের প্রচলন রয়েছে। চাঁদপুরের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ধরনের লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কারের প্রচলন রয়েছে। চাঁদপুরে বিবাহের গানের প্রচলন শতবছরের প্রাচীন। কোনো কোনো গ্রামে এখনো বিয়ের গান হয়। শতবর্ষ আগে চাঁদপুর সদরের সাবেক নরসিংহপুর হাটে প্রতি বৈশাখে মেলা বসত। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খেলনার পাশাপাশি মেলায় গানবাজনা হতো। পূর্ববাংলার প্রথম যাত্রাদল ‘প্রাচ্যাভিনয় সম্প্রদায়’। ১৮৮০ সালে উমানাথ ঘোষাল চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে এ যাত্রাদলটির প্রতিষ্ঠা করেন। তাই এটি ‘ঘোষাল অপেরা’ নামে বহুল পরিচিত। চাঁদপুরে প্রথম মঞ্চ নাটক প্রদর্শিত হয় ১৯১০ সালে। প্রথম প্রদর্শিত নাটকটি ছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘শাহজাহান’।১৯২০-২১ সালে পুরাণবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয় জেলার প্রথম স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ‘বীণাপাণি নাট্যমন্দির’। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চাঁদপুর টাউন হল। এর নির্মাণ ছিল শিল্পাঙ্গনের মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। ক্রমেই টাউন হল চাঁদপুরের সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্রে রূপ নেয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চাঁদপুরের প্রথম সংগীত-সংগঠন ‘চন্দ্রলোক সংগীত সম্প্রদায়’। এ জেলার চিত্রকলার ইতিহাসও বহুদিনের। বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা চৌধুরী (১৯১৩-১৯৯৯) চাঁদপুরের পুরানবাজারের মেয়ে। ১৯২৮ সালে তিনি শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হয়েছিলেন। এ থেকে ধারণা করা যায়, চাঁদপুরের নারীদের শিল্পচর্চার ইতিহাসও দীর্ঘ। অন্যদিকে আলপনাশিল্পী সুকুমারী দেবীর জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তৎকালীন চাঁদপুরে আলপনা আঁকার প্রচলন ও কদর ছিল। হাইমচর উপজেলা একসময় শিল্প-সাহিত্যে কাজ করার মতো অনেক সংগঠন থাকলেও নদী ভাঙ্গনের সাথে সাথে শিল্প সাহিত্যে ভাটা পড়ে। তবে সংক্ষিপ্তভাবে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা এখনো চলমান আছে। এখানে আছেন কবিও সাহিত্যিক মনছুর আজিজ, শাহ বুলবুল, নাহিদা নাহিদ, চিত্রশিল্পী মিলন রায় উল্লেখযোগ্য।

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চাঁদপুরের রাজনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া ক্ষেত্রে নিজ নিজ অবদানের জন্য স্মরনীয়-বরণীয় হয়ে আছেন যাঁরা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আব্দুল্লাহ সরকার, মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, ডা. দীপু মনি, অরুন নন্দী, তকদির হোসেন, আবু ওসমান চৌধুরী (৮নং সেক্টর কমান্ডার), এমএ ওয়াদুদ, ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আব্দুল করিম পাটওয়ারী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বদিউল আলম, বীর উত্তম, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন (বীর উত্তম), সিরাজুল মওলা (বীর উত্তম), সালাহউদ্দিন আহমেদ, বীর উত্তম শহীদ লেঃ মো. আনোয়ার হোসেন (বীর উত্তম), দেলোয়ার হোসেন (বীর প্রতীক), মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ, বীর প্রতীক আবদুল হাকিম বীর প্রতীক, নূরুল হক (বীর প্রতীক), আবু তাহের (বীর প্রতীক), মোহাম্মদ আবদুল মমিন, (বীর প্রতীক), শামসুল হক (বীর প্রতীক), আবুল হোসেন (বীর প্রতীক), ফারুক আহমদ পাটোয়ারী, (বীর প্রতীক), মোহাম্মদ আবদুল হাকিম, (বীর প্রতীক), আবুল কাশেম ভূঁইয়া (বীর বিক্রম), মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ, (বীর বিক্রম) আবদুল হালিম (বীর বিক্রম), মোহাম্মদ বজলুল গণি পাটোয়ারী, (বীর বিক্রম), আবদুল জব্বার পাটোয়ারী, (বীর বিক্রম), আমিন উল্লাহ শেখ (বীর বিক্রম) অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, একজন বাংলাদেশী লেখক এবং দেশের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক নজরুল গবেষক।সওগাত পত্রিকার সম্পাদক জনাব মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন।নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বেগম পত্রিকার সম্পাদক জনাব নূরজাহান বেগম।জনাব বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, লেখক, চিত্র সমালোচক ও শিক্ষাবিদ। মরহুম ওয়ালিউল্লাহ পাটোয়ারী, শিক্ষাবিদ, জনাব মুনতাসীর মামুন লেখক ও শিক্ষাবিদ। জনাব শান্তনু কায়সার সাহিত্যিক, জনাব মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, সাংবাদিক, জনাব নাজিম উদ্দিন মোস্তান সাংবাদিক, জনাব হাশেম খান বরেণ্য চিত্রশিল্প, জনাব ঢালী আল মামুন চিত্রশিল্পী, বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্রশিল্পী জনাব নিভাননী চৌধুরী, জনাব শাইখ সিরাজ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, জনাব আহমদ জামান চৌধুরী চলচ্চিত্র সাংবাদিক, চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গীতিকার, জনাব এমবি মানিক চিত্র পরিচালক, (বিএফডিসি), জাতীয় প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি দৈনিক যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব সাইফুল আলম, জনপ্রিয় উপস্থাপক ও অভিনেতা জনাব শফিউল আলম বাবু, বাংলাদেশের সেরা নৃত্যশিল্পী জনাব শিবলী নোমান, জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী জনাব আরিফ খান, জনাব দিলদার, অভিনেতা, জনাব দিলারা জামান অভিনেত্রী, সাদেক বাচ্চু (মাহবুব আহমেদ সাদেক বাচ্চু ) বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম খল অভিনেতা, গীতিকার ও সাংবাদিক, জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী জনাব দিনাত জাহান মুন্নী, জনাব এসডি রুবেল সংগীতশিল্পী, চারণকবি দোনা গাজী, জনাব আতিকুল ইসলাম সঙ্গীতশিল্পী ও গীতিকার জনাব কবির বকুল।

প্রশাসনের এমন কোন দপ্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে চাঁদপুরের কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নেই। এখানে দানবীর, মানবিক চিকিৎসক আছেন যারা নিজের কর্ম মানুষকে জয় করেছেন। এখানে প্রানে চাঁদপুর বিষয়ে লিখে শেষ করা যাবে না।

প্রাণের চাঁদপুর ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, সংষ্কৃতি, ক্রীড়াতে আগামী দিনে আরো ভরপুর এবং সমৃদ্ধশীল হয়ে উঠবে পুরো জাতির সামনে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়