প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
রুমের কলিং বেজে ওঠে। কে, কে, বললে বাইরে থেকে কথার জবাব আসে না। হাসির শব্দ নেই, কান্নার শব্দ নেই, পায়ের শব্দ নেই, কথার শব্দ নেই। দরজা খুললে কাউকে দেখা যায় না। অথচ মাঝেমধ্যেই কলিং বেল বেজে ওঠে। এমন পীড়া সচরাচর সয়ে যেতে হয়। সময়-অসময়ে, কারণ-অকারণে এই প্যারা সইতে হয়। শুধু শুধু কলিং বেল বেজে ওঠে। আশ্চর্যের বিষয়। কখনো কাউকে দেখতে পাইনি। কে এমন কাজ করে, সেই দ্বিধা বুকের ভেতর লালন করি নৈমিত্রিক। বাসাওয়ালাকে অভিযোগ দিলে উল্টো ব্যাচেলর বলে রুম ছাড়ার নোটিস জারি করে দেবেন। সেই ভয়ে বলা হয়ে ওঠেনি। ঢাকা শহরের সবচেয়ে অসহায় হলো ব্যাচেলর। এদের বাসায় থাকাটা যেন অপরাধ। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সমস্যা, রুমে গান বাজালে সমস্যা। চারদিক সমস্যা আর সমস্যা।
তবে এক দিন কলিং বেল দিয়ে হো হো করে হেসে দিল। বাইরে এসে কাউকে পেলাম না। অনেকটাই বিরক্তবোধ অনুভব। এটা কোনো মেয়ের হাসি।
এক দিন দুপুরে ঘুমমগ্নতায় হারিয়ে। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ জোরে বেজে ওঠে। মেজাজ অনেকটা বিগড়ে যায়। তড়িঘড়ি করে, ফাইভণ্ডজি গতিতে দরজার পাশে যাই। কে, কে বলে চিৎকার দিয়ে দরজা খুলতেই দেখি বাসাওয়ালা। অনেকটা অগ্নিমূর্তি রূপ নিয়ে বললেন, ‘আজব! কখন থেকে ডাক পারছি, কলিং বেল দিচ্ছি। শুনতে পান না?’
কথাগুলো বলেই রুমে প্রবেশ। বিছানো ছিল অগোছাল। বই, খাতা সব ছড়ানো ছিটানো। এমন বেহাল পরিবেশ দেখে আরো রেগে গেলেন বাসাওয়ালা। ‘আপনাদের সেই জন্য বাসা দেওয়া হয় না। আমি এসেছি কীভাবে আছেন। আপনাদের অনুরোধ করছি বাসা ছেড়ে সামনে মাসে চলে যাবেন। কোনো প্রশ্ন করবেন না। আপনাকে বাসাভাড়া দেওয়ার প্রথম শর্ত ছিল ছাদে না যাওয়া, রুম গোছাল রাখা। অথচ আপনি নিয়মিত ছাদে যান। ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া অভিযোগ দিয়েছেন। আপনি বাসাতে থাকলে, তারা বাসা ছেড়ে যাবেন।’
আমি তাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কাজ হলো না। সরাসরি মুখের সামনে বাসা ছাড়ার নোটিস জারি করে দিলেন। কি আর করা। পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিলাম। গাছতলায় থাকব নয়তো বিয়ে করব। তবু ব্যাচেলর থাকব না। আমার বাসা ছাড়ার নোটিস ভাইরাল নিউজের মতো ছড়িয়ে গেছে সব রুমে। এই মহৎ কাজ করেছেন বাসার গেটম্যান। বাসা থেকে নামতেই একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, ‘বাবা তুমি নাকি বাসা ছেড়ে দিয়েছো। একটা বিষয় মনে রাখবা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ইমানের অঙ্গ। অথচ তুমি নাকি রুম বেশ অপরিষ্কার করে রাখো। যেটা অনুরোধ রইল- যেখানে যাও, পরিষ্কার থাকার চেষ্টা করবে। সবার মা-বোন আছে। ছাদে গিয়ে শেয়ালের মতো এদিক-সেদিক দেখার কি আছে।’
লজ্জায় মুখ লাল। হৃদয় ক্ষরণ! মনে হচ্ছে কখন চলে যাব বাসা ছেড়ে। এর মাঝে বাসায় আর কলিং বেল হুটহাট করে বেজে উঠে না। প্রথম কয়েক দিন ভালোই লাগল। শান্তিমতো খেতে পারতাম, ঘুমাতাম। কোনো বিরক্তিবোধ হতো না।
ধীরে ধীরে বাসা ছাড়ার সময় যখন কাছে চলে আসে। তখন যেন হুটহাট কলিং বেল বাজানো মিস করতে থাকি। সেই হাসি কানে এসে বাজে। মনের গহিনে কলিং বেল বেজে ওঠে। কখনো কখনো মনের অজান্তে কলিং বেল শব্দ কানে ভেসে আসে। দরজা খুলে কোনো হাসির শব্দ পাই না।
যা হোক, বাসা ছেড়ে দেওয়ার এক দিন আগে। সন্ধ্যার পর কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতে কাউকে পেলাম না। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা সাদা কাগজ। তাতে লেখা আছে- প্রিয় অচেনা মানুষ, আপনাকে অনেকবার দেখেছি। এই দেখার মাঝে কাউকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। মনে মনে হয়তো আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। সেই ভালোবাসা থেকে বিরক্ত করেছি। সময়-অসময়ে এমন বিরক্তি করাটা যেন আমার অধিকার হয়ে গিয়েছিল। জানি, আমি ক্ষমার অযোগ্য। তবু ক্ষমা করবেন। বাসা ছেড়ে চলে যাবেন। ভাবতেই বুকের ভেতর ঢেউগুলো উছলে পড়ছে। ভালো থাকুন।
ইতি, অদেখা অদিতি।