বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

সাজেক : মেঘ-পাহাড়ের রাজ্যে ভ্রমণ
তৃপ্তি সাহা

আপনারা এর আগে সাজেক ঘুরে আসার কিছু মনোহরি ছবি দেখেছেন ফেবু কের মাধ্যমে। আসলে আমরা সাজেক মানেই শুধু মেঘ বুঝি। সত্যি সাজেক মনেই অনেক অনেক মেঘ, রাশি রাশি মেঘ। মেঘের রাজ্য, মেঘের মায়া, মেঘের ভালোবাসা । যেখানে মেঘের মধ্যেই বসবাস করবেন, মেঘের উপর ভাসবেন, আবার মাথার ওপর মেঘ, পাশে মেঘ। হাত দিয়ে ছুঁয়ে থাকবেন মেঘ, পাঁজা কোলে করে থাকবেন মেঘ.... অর্থাৎ মেঘময় আপনি।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ফুট উচ্চতায় সাজেক আপনাকে নিয়ে যাবে স্বপ্ন পুরী তে। যেখানে যখন তখন আকাশের বিভিন্ন রঙ শুধু বদলায়-তা নয়, দেখবেন রংধনু। সকাল বিকেল হঠাৎ হঠাৎ দেখবেন রংধনু। স্নিগ্ধতা, মুগ্ধতা বাংলাদেশ আমার।

সাজেকে মূলত লুসাই, পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা উপজাতি বসবাস করে। রাঙামাটির অনেকটা অংশই দেখা যায় সাজেক ভ্যালি থেকে। এই জন্য সাজেক ভ্যালিকে রাঙামাটির ছাদ বলা হয়।

কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ভূত সাজেক নদী থেকে সাজেক ভ্যালির নাম এসেছে। সাজেক পাহাড়ে হেলান দিয়ে থাকবেন। দেখছেন মাটি থেকে মেঘ উঠছে, পাহাড় থেকে মেঘ উঠছে আর উপরের মেঘগুলো নিচের মেঘগুলোকে ছুঁয়ে দিতে এগিয়ে আসছে আবেশে। সে এক অনিন্দ্য সুন্দর অনুভব। এ তো লিখে বুঝানো যায় না। এই অনুরণন ছুঁয়ে থাকবে আপনার মন, প্রাণ। কিন্তু এর বাইরেও আছে অনেক এক্সাইটিং ভয়ংকর সব বিষয় আছে, সাজেক আর খাগড়াছড়িতে। যেমন : আপনি যখন বাসে যাচ্ছেন খাগড়াছড়ি তে। তখন আপনি অনেক সাহসি না হলে, কয়েক দফা বমি করে ফেলবেন। সর্পিল গতিতে বাস ছুটে চলেছে পাহাড়ের দিকে। সাপ যেমন শিকারি ধরতে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে ছুটে চলে তেমনিভাবে। এই ছুটে চলা আরো দুর্দান্ত। পাহাড়ি পথে গতি স্লো করা মুশকিল। পড়ে গেলেন তো মরে গেলেন। শাঁই শাঁই করে উপরে উঠেছে , কখনও নিচে নামছে।এগিয়ে যাচ্ছে তার লক্ষ্যে। আপনি বাইরের দিকে তাকিয়েছেন, তো মরেছেন! মনে হবে সাঁই করে একেবারে গর্তে পড়ে যাবেন। আর আপনার যদি সুন্দর একটা চোখ থাকে, মনের জোর থাকে তবে দেখবেন, চারিদিকে কী ভয়ংকর সুন্দর সবুজ আর সবুজ। সত্যি বলছি ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। এত খাড়া উঁচু সরু আঁকা বাঁকা রাস্তা যে মনে হবে একটু হলেই পড়ে যাবো। কিন্তু সৌন্দর্যের অনুভব কোন অংশেই কম নয়।

এছাড়া গা ছমছম করা আলু টিলা গুহা, রিসাং ঝর্না দেখতে যাওয়া-- সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। ছোট বেলায় ভুতের বাড়ির ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে। কিন্তু আমার এই আলু টিলা গুহা দেখার ফিলিংসটা ছিলো একেবারেই ভিন্ন। ছোটবেলায় আলীবাবা চল্লিশ চোরের সেই স্বর্নালংকার সহ সেই গুহার কথা মনে পড়ে যায়। পাথুরে তলদেশ এই গুহার গভীরতা ২৫ ফিট বা ৩.৮ মি. আর দৈর্ঘ ১০০ মি.। ঘুটঘুটে অন্ধকার আর পিচ্ছিল। ঝর্না প্রবাহমান।সত্যি আমি আমার এই বয়সে এতখানি রিক্স নেওয়াটা ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা। নিজের কেউ থাকলে কিছুতেই সম্ভব হতো না এই অভিজ্ঞতা নেওয়া। তারা রাজি হতো না কোনভাবেই। অবশ্য ফ্লাই ফ্লার লেডিসের পক্ষ থেকে বয়স সীমাবদ্ধ ছিলো, বয়স অতিক্রম করা স্বত্বেও আমাকে তারা এলাউ করেছে ধন্যবাদ তাদের।

প্রতিটি দর্শনীয় জায়গা সুস্থ ভাবে দেখেছি। এ এক অনিন্দ্য সুন্দর অনুভব। আমার মনোবল বেড়ে গেছে অনেকখানি। বাঁচার আনন্দ বেড়ে গেলো।

রিসাং ঝর্না আপনাকে অন্য এক বাংলাদেশে নিয়ে যাবে। চাঁদের গাড়িতে ১১ কিলোমিটার রাশিরাশি সবুজ গাছের এভিনিউ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। প্রত্যেকটা মুহুর্ত অনিন্দ্য সুন্দর জীবন অনুভব করবেন। প্রকৃতির মোহনীয় সৌন্দর্যের আপনাকে দিবে পরম প্রশান্তি। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা যাওয়ার পর চাঁদের গাড়ি থেকে নেমে যেতে হবে। পরে বাইকে করে দুরন্ত গতিতে খাড়া সরু উপর থেকে নিচে আবার নিচ থেকে উপর এভাবে চোখ বন্ধ করে চালককে সহযোগিতা দিয়ে যেতে হবে রিসাং ঝর্না দেখতে। বাইক থেকে নেমে এবার সিঁড়ি ভাঙার পালা। হাতে বাঁশ(লাঠি) নেওয়ার ব্যাবস্থা আছে। ২৩৫ টি সিড়ি ভেঙে নিচে পাবেন ৩০ মিটার উচ্চতার রিসাং ঝর্না। সেখানে স্নান করে নিতে পারবেন, ভিজতে পারবেন। পাথরের পিচ্ছিলতা এড়িয়ে চলতে হবে। তবে বাংলাদেশ কে জানতে হলে আপনাকে যাতে হবে বহুদূর। সাজেক।

আশে পাশে তাকাবেন দেখবেন বর্তমান সরকারের পর্যটনকে আকর্ষণীয় করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপ। এছাড়াও নতুনভাবে গড়ে উঠছে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ।

আমরা ঢাকা থেকে রাত ১০.৩০মি রওনা করেছি শ্যামলি বাসে। কুমিল্লায় বিরতির পর আবার ছুটে ছলছে বাস। সকাল ৭ টার মধ্যে খাগড়াছড়ির দীঘিনালাতে পোঁছায়। সুন্দর রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা আর চাঁদের গাড়িতে উঠার বিরতি। ১০ টার দিকে সাজেকের উদ্দেশ্যে চাঁন্দের গাড়িতে উঠে বসলাম। চলতে শুরু করলো চাঁন্দের গাড়ি, এবার ছোট যান। আশেপাশের মানুষ, দোকানপাট, গাছগাছালি, পাহাড় আকাশ মেঘ দেখতে দেখতে পথচলা। বুনোফুলে ছেয়ে গেছে দু'ধার। কত বাহারি গুল্ম, লতাণ্ডপাতা! নাম না জানা বুনোফুল আর হরেক ফুল। অনেক লাল জবা ফুটে আছে দু'ধারে। চোখে পড়ার মতো জবা। কটকটে লাল জবা ফুল পাহাড়ি চেহারায় পূর্ণতা পায়। পাহড়ি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দু'ধারে দাঁড়িয়ে আছে চকলেট পাওয়ার আশায়। আমি আগে থেকেই জানতাম বিধায় কিছু চকলেট নিয়ে গেছিলাম। ওদেরকে ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম। ওরাও স্বাগত জানাচ্ছিলো। বিষয়টা সত্যি উপভোগ করার মতো। দেখবেন, কতো ছোট ছোট ঘর, কত কত অপ্রাপ্তি। এর মধ্যে ওরা ভালো থাকে, আনন্দে থাকে। আমরা দেড়টার দিকে "মৌন আভা " রিসোর্টে পৌঁছালাম। সত্যি সবাই অনেক ক্লান্ত ছিলাম। স্নানদান করে ফ্রেশ হয়ে খেতে গেলাম। খাওয়া শেষে হালকা বিশ্রাম নিয়ে কংলাক পাহাড়ের উদ্যেশ্যে চাঁদের গাড়িতে রওনা হলাম।। যদিও বেশিদূর গাড়িতে যেতে পারিনি। কারণ পর্যটকের আধিক্য। আমরা দীর্ঘ পথ হাঁটতে হাঁটতে কংলাক পাহাড়ে পোঁছালাম। আহা সময়টা বর্ষা ছিলো। ঘুরার জন্যে আমি এসময়টাকে প্রাধান্য দেই। চারপাশে শুধু ঝকঝকে তকতকে সবুজ। পাতাগুলো টসটসে নববধুর রঙ করা ঠোঁটের মত। আমাদের কংলাক পাহাড়ে ঘুরে ফিরে আসতে বেশ খানিকটা রাত হয়ে গেলো। মাঝে মাঝেই ছবি তুলছিলাম। ততক্ষণে আমাদের চাঁন্দের গাড়ি কিছুটা সামনের দিকে এগুতে পেরেছে। আমরা গাড়িতে করে মৌন আভাতে এলাম। কিছুক্ষণ পর খেতে গেলাম। সেখান থেকে বের হয়ে একটা গানের লাইভ প্রোগ্রাম দেখতে গেলাম। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমরা বেশিক্ষণ লাইভ গান দেখলাম না। বের হয়ে কিছু দোকান পাট ঘুরে ঘুরে দেখলাম। চলে এলাম। দেখছিলাম আশপাশের দোকানে ব্যাম্বো চিকেন তৈরির প্রক্রিয়া। বিভিন্নরকম খাওয়ার দোকান। আমরা পাহাড়ি পেঁপে আর কলা খেতে আগ্রহী ছিলাম। দোকান গুলোতে পাহাড়িদের নিজ হাতে তৈরি করা হরেক রকমের জিনিস। জামাকাপড়, ব্যাগ, শীতের পোষাক, ঘর সাজানোর জিনিস। দারুণ সব আয়োজন।

শরতের পূর্ণিমার চাঁদ কে উপভোগ করার তীব্র বাসনা আমার। মেঘের ঘনঘটা আর বৃষ্টিতে তা আর পূর্ণতা পেলো না। পরদিন ভোর বেলায় আমাদের গাইড কেয়া ঘুম থেকে উঠালো। হলিপ্যাডে যাবো। সাজেককে পরিপূর্ণ ভাবে দেখব এবং ছবি শুটিং। তাড়াতাড়ি করে চোখমুখ ধুয়ে শাড়ি পড়ে হ্যালি প্যাডে হেঁটে গেলাম । যেতে যেতে মেঘের বন্যায় ভেসে যাচ্ছি। মিনিটে মিনিটে মেঘের ছবি পালটে যাচ্ছে। এই দেখছি পাশেই মেঘ। ছুটেছি ছবি তুলতে ততক্ষণে সরে গেছে মেঘ।

অনেকক্ষণ কাটালাম সেখানে। প্রচুর পর্যটক। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ। ভাল লাগলো। এপার বাংলায় পর্যটন জমে উঠেছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

ফিরে এলাম। সকালের নাস্তা করে লুসাই গ্রামে যাওয়ার ডাক পড়লো। সবাই এলোমেলো হয়ে গেলো। আমি নাস্তা শেষ করে গাইডদের তাড়াতাড়িতে শাড়ি পড়েই লুসাই গ্রামে গেলাম। আমার তথ্যে গ্যাপ ছিলো। সেখানে গিয়ে ওদের ড্রেস ভাড়া করে পড়তে হবে, বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছি গ্রামবাসী থাকবে, বাজার থাকবে। কিন্তু সম্পুর্ন টা আলাদা। কিছু করার নেই। আমি শাড়ির উপর ওদের ভাড়া করা ড্রেস পরলাম। বেঢপ আকৃতির লাগলো। কিন্তু এতটুকু মিস করতে মন চাইলো না। সেখানে গ্রামবাসীদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখে তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

সেটুকু সেরে চলে এলাম মৌন আভা তে। সকাল ১১ টার দিকে চাঁন্দের গাড়িতে রওনা করলাম খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে। রৌদ্র উজ্জ্বল সকালে আমাদের ফিরতি পথের যাত্রাটা দারুণ ছিলো। আমি চারপাশ আর আকাশ দেখে সত্যিই অভিভূত হচ্ছিলাম। আমি গুণগুণ করে গাইছিলাম আর মাথা নত করছিলাম। 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকায় মাথা'। আর মনে পরছিলো, 'তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো মলিন মর্মে মুছায়ে'। বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই ভালো যে মনে আনন্দের রেশটা থেকেই গেলো।

তৃপ্তি সাহা : লাইব্রেরি উন্নয়ন কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়