প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩, ০০:০০
‘মোনালিসার হাসি বাস্তবে দেখিনি, তোমার হাসি দেখেছি’- নন্দিতাকে এ কথাটি বলতেই হো হো করে হেসে উঠল। সে হেসেই চলছে। আমি অবাক নয়নে দেখছি। আফিমের নেশার মতো তার মায়াময় মুখের দিকে, শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ডাগর ডাগর চোখ আর হাসিতে চৌম্বকীয় টান। তার এই প্রসন্নময় হাসি হৃদয়ে সুখানুভূতি জাগিয়ে তোলে। এ যেন বসন্ত, কোকিলের কলতানে মুখরিত। 'নন্দিতা থামবে এবার' বলতেই তার মুখে কথার খই ফুটল। তার কথাগুলো আমার কাছে একটা শিল্প মনে হয়। আসলে মানুষ প্রেমে পড়লে নাকি বোকা হয়, আমি নিজে কী হয়েছি, জানা নেই।
তার সঙ্গে পরিচয়টা অনেকটাই সিনেমার মতো। কোনো এক বিষণ্ণ বিকেলে লন্ডনের টেমস নদীর পাশে বসে আছি আনমনে। চারদিক মানুষের কলতান, কিন্তু ব্যস্ততায় কেউ কারও নয়। এত মানুষ, এত গাড়ি তবু যেন আমি একাকী। কাউকে চিনি না। চেনার কথাও নয়। স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছি এই শহরে। চারপাশ অপরিচিত মানুষের ভেতরে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। যার জন্যই এই মন খারাপের আয়োজন। কোনো কারণ ছাড়াই হৃদয়ের ভেতর বিরহের সানাই হুহু করে বেজে উঠত। মনে হতো, এই শহরে আমার মতো একাকী কেউ নেই। তখন হঠাৎ এক মেয়ে আমাকে বলল, ‘ইউ আর বাঙালি, রাইট?’ আমি কিছুটা নড়েচড়ে বললাম, ইয়েস। ইউ?
‘আমার বাড়ি সিলেটে। আপনাকে দেশের মনে হলো। তাই এগিয়ে এসে কথা বললাম। আবার একটু প্রয়োজন আছে আপনার কাছে।’
আমি কিছুটা থমকে গেলাম। অপরিচিত মেয়ে। ভিন্ন দেশে। তার প্রয়োজন কী আমার কাছে। ভাবতেই সে বলল, ‘চিন্তায় ফেলে দিলাম। চিন্তার কারণ নেই। আমাকে একটি ছবি তুলে দেবেন।’ তার এই বাক্য সব চিন্তার ইতি ঘটল। এভাবেই পরিচয়। যখন জানলাম, সেও আমার মতো স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার জন্য এসেছে, তখন যেন আমরা খুব কাছে চলে গেলাম বন্ধুত্বের। হৃদয় আকাশে কালো মেঘ কেটে, জোছনার বিচরণ।
তখন মনে হলো, এই শহরে আর আমি একাকী নয়। সেই থেকে বন্ধুত্ব। কত দিন পুরো শহর আমরা ঘুরেছি একসঙ্গে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাজপ্রাসাদের একটি লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেস, সেখান থেকে হাইড পার্ক তারপর লন্ডন আই, ব্রিটিশ জাদুঘর একসঙ্গে দেখেছি। কত দিন নিজের হাতে রান্না করে নিয়ে এসে দেশীয় স্বাদে খাবার খেয়েছি। আমাদের সেসব দিন তো রঙিন আর রঙিন। চলছিল রঙিন দিন। একদিন ক্লাস শেষে নন্দিতা আমাকে কিছু বলার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে সে বলল, ‘তোমাকে একটা কথা বলতে চেয়েও পারিনি, আজ কেন যেন মনে হচ্ছে বলা দরকার।’
আমি জীবনানন্দ দাশের কবিতার থেকে ‘কী কথা তাহার সাথে?’ বললাম। আমার দিকে অপরাধী নয়নে তাকিয়ে বলল, ‘কথাটি সিরিয়াস। তোমার কাছে আমি একটি বিষয় লুকিয়েছি। আমি বিবাহিত। আমার স্বামীর সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব ছিল। এখন তার অবসান হয়েছে। আমি কাল চলে যাচ্ছি, তার কাছে নিউইয়র্ক।’ আমি কোনো কিছু বলার আগেই নন্দিতা চলে গেল। আমি বসেই রইলাম। চারদিকের কোনো হৈ-হুল্লোড় কানে আসছে না। আমি যেন পাহাড় থেকে পড়ে গেলাম। অনেকক্ষণ বসে রইলাম। কেউ আমাকে ডাকছে, কিন্তু জবাব দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তবে একটা বিষয় বারবার হৃদয়ে ধাক্কা দিচ্ছে, নন্দিতা সরি বলেনি আমাকে। সে অন্তত সরি বলে বন্ধুত্ব রাখতে পারত; কিন্তু তা না করে সে স্থান ত্যাগ করল।