প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
ঋতুরাজ বসন্ত রূপসি বাংলায় ফিরে আসলে আবিরের মনটা যেন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। প্রকৃতি যখন কৃষ্ণচূড়া ফুল আর সবুজ পাতার রঙে সাজে, তখন বাবা-মা আজ কোথায়? আবিরের মনে বারবার এই প্রশ্ন জানান দেয়। কেননা ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহে তার মা-বাবাকে চিরতরে হারাতে হয়েছিল। যার কারণে সেদিন থেকে বাবা-মায়ের অবর্তমানে তার জীবনে সবকিছু যেন ওলোটপালোট হয়ে গেছে। উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার যে স্বপ্ন আবির দেখেছিল, তার সেই স্বপ্ন অভাবের তাড়নায় মাটি হয়ে গেছে। অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরপরই চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেছে তার শিক্ষাজীবন।
এছাড়া বাবার রেখে যাওয়া মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে একখণ্ড ভিটে জমি ছিল, তাও আবার ঋণের কারণে প্রভাবশালী হরিশচন্দ্রবাবুর দখলে চলে গেছে। হরিশচন্দ্রবাবু খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ। তিনি গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের মাঝে চড়া সুদে ঋণ দেন। আর সেই ঋণ কেউ পরিশোধ করতে না পারলে বিনিময়ে জমিজমা হাতিয়ে নেন। এই জন্য তিনাকে গ্রামের মানুষ খুব বেশি পছন্দ করতেন না। গ্রামের সব শ্রেণির মানুষ তিনাকে ঘৃণা করতেন। আর সুদখোর চন্দ্রবাবু নামে ডাকতেন।
একদিন এতিম শিশু আবির হরিশচন্দ্রবাবুর হাত-পা চেপে ধরে আনাই-বিনাই করে তার বাবা রেখে যাওয়া একখণ্ড ভিটে জমিটি ফিরে দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রভাবশালী হরিশচন্দ্রবাবু কোন মতেই জমিটুকু ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়নি। বরং তিনি আবিরকে গলা ধাক্কা দিয়ে তিনার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন।
সেদিন ভিটেমাটি হারিয়ে এতিম শিশু আবির পথে পথে ঘুরতে থাকে। কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর বেশ কয়েকদিন পর আবিরের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় গ্রামের নিতাইবাবুর কাছে। নিতাইবাবু নিতান্তই ভাল মানুষ। তিনার মনে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। তিনি এতিমণ্ডমিসকিন শিশুদের খুব ভালোবাসেন। কোন সময় তাদেরকে ধমক দিতেন না। যার কারণে এতিম শিশু আবির নিতাই বাবুর কাছে ভালোবাসা পেয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেয়।
বিগত কয়েক বছর ধরে আবির নিতাইবাবুর বিশাল সয়-সম্পত্তি অর্থাৎ গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর ফসলের মাঠ একাই দেখাশোনা করে আসছে। এরই ফলে আবির দিন দিন নিতাইবাবুর কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। আবিরও নিতাইবাবুর ভালোবাসা পেয়ে বাবার-মায়ের দুঃখণ্ডকষ্ট ভুলে যেতে থাকে। নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু আবিরের কপালে এই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নিতাইবাবুর ছোটভাই পল্লব কুমার শহর থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর আবিরের উপর অত্যাচার, নির্যাতন শুরু হয়ে যায়। পল্লব কুমার আবিরকে মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি সব সময় আবিরকে বিনা কারণে অপমান করতেন। এমন কি উগ্র মেজাজ দেখিয়ে আবিরের পিছনে লেগে থাকতেন। আর তিনি মনে মনে ভাবতেন, কবে যে ছোটলোকের বাচ্চা আবিরকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবো তা ঠিক নেই।
একদিন নিতাইবাবু ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্য শহর গেলেন। আর তিনি আবিরকে বলে গেলেন, ‘আবির, তোর ছোট বাবুর সাথে করে আমার সয়-সম্পত্তি দেখে শুনে রাখিস। আমার শহর থেকে বাড়ি ফিরতে হয়ত বা অনেক কয়বছর লেগে যাবে।’
এদিকে নিতাইবাবু শহরে চলে যাচ্ছে বলে তিনার ছোটভাই পল্লব কুমার খুব খুশি হন। সেদিন পল্লব কুমার মনে মনে ভাবতে থাকেন, এবার সুযোগ পেয়েছি আবিরকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার। দাদা আগে শহরে চলে যাক তারপর আবিরের মজা দেখবো। ছোটলোকের বাচ্চা দিন দিন বড় দাদার মন জয় করে ফেলছে। ওকে তাড়িয়ে দিতে না পারলে ভবিষ্যতে আমাকে ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে পড়তে হবে। এমনকি দাদার সম্পত্তির ভাগ বসাতে পারে ঐ ছোটলোকের বাচ্চাটি। এই জন্য যে ভাবেই হোক, ঐ ছোটলোকের বাচ্চা আবিরকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
নিতাইবাবু শহরে চলে যাওয়ার কিছুদিন পর পল্লব কুমার তার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আবিরকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। এতিম শিশু আবির পল্লব কুমারের মিথ্যা অপবাদ সইতে না পেরে মনের কষ্টে নিতাইবাবুর বাড়ি থেকে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। নিতাইবাবুর বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আবির সঙ্গে করে কিছু খাবার আর প্রয়োজনীয় পোশাক-আশাক একটা টুপলাই বেঁধে নেয়। আর মনে মনে ঠিক করে নেয় গন্তব্য তার অচেনা শহর।
তখন কার সময় গাড়িঘোড়ার চলাচল খুব কম ছিল। যার কারণে পায়ে হেঁটে যেতে হতো শহরে। বেশ কিছুদিন লেগে যেতো শহরে পৌঁছাতে। যাইহোক, আবির সেদিন রাতে আঁধারে পায়ে হেঁটে রওনা দেয় অচেনা শহরের উদ্দেশ্যে। গভীর রাতে বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আবির একাকী অনাবরত হাঁটতে থাকে। এভাবে পায়ে হেঁটে বেশ কিছুদিন পর আবির অচেনা শহরের পৌঁছে যায়।
অচেনা শহরের পৌঁছানোর পর আবির ভাবতে থাকে, না জানি ঈশ্বর আমাকে মাথা গোঁজার ঠাঁই শেষমেশ কোথায় লিখে রেখেছেন? বাবা-মা মরে যাওয়ার পর থেকে তো মাথা গোঁজার স্থায়ী কোন জায়গা পেলাম না। দেখি এই অচেনা শহরে কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই পাই কিনা? অবশেষে কিছুদিন পর শহরের একটা মন্দিরের আবিরের শেষ সম্বল হিসাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়। আবির মন্দিরের গেটের সামনে ফুল, ফল ও পূজার সামগ্রী বিক্রি করেই কোনো মতে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে থাকে। রোজ সকাল পাঁচটায় শহরের মুদি দোকান থেকে পুজো দেওয়া কিছু ফুল, ফুল ও মিষ্টি সামগ্রী কিনে দুটো করে ক্যারি ঠোঙা প্যাকেট করত। একটিতে থাকতো পাঁচ রকমের ফল আর একটিতে থাকতো ধূপকাঠি, নকুলদানা, একটু চিরে, একটা সিঁদুরের কৌটা, একটি মোমবাতি আর কিছু ফুল। ভক্তরা মন্দিরে পুজো দিতে আসলে এই দুটি প্যাকেটের জন্য তাদের কাছ থেকে বিনিময়ে একশত টাকা নিতো।
এভাবেই চলতে থাকে আবিরের একাকী জীবন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে মন্দিরের সামনে চলে আবিরের এই ব্যবসা। ফুল-ফল বিক্রি করে আবির সাফল্যের মুখ দেখতে পাই। পৃথিবীতে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে মরণ ব্যাধি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় শহরের অলিতে গলিতে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে শহরের মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ মানুষ মৃত্যুর ভয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সরকারের নির্দেশ মোতাবেক একে একে বন্ধ হতে থাকে স্কুল, কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এমনকি আবির যে মন্দিরের সামনে পূজোর সামগ্রী বেচাকেনা করত সেই মন্দিরটা বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে আবিরের ব্যবসাটাও বন্ধ হয়ে যায়।
মরণ ব্যাধি করোনা ভাইরাসের কারণে আবির দিন দিন কর্মহীন হয়ে পড়ে। ব্যবসা করে যে পুঁজি হয়েছিল, তাই দিয়ে সে দিন কাটাতে লাগে। এভাবে বেশ কিছুদিন কাটানো পর আবির পুনরায় সিদ্ধান্ত নেয় আবার সে গ্রামের ফিরে যাবে এবং সে তার বাবা রেখে যাওয়া ভিটে জমিটি উদ্ধার করবে।
আবির তার সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরের দিন সকালে পায়ে হেঁটে রওনা দেয় গ্রামের উদ্দেশ্যে। তখন সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। প্রচণ্ড গরমে মেঠো পথে পায়ে হেঁটে চলাচল করা খুব কষ্টকর ছিল। কিছু পথ হাঁটার পর পানি পিপাসায় গলা শুকিয়ে যেতো। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুর বেলা বিশ্রাম নেওয়ার মত কোন স্থানে পাওয়া যেতো না। তারপরেও আবিরের যে কিছুই করার ছিল না। গ্রীষ্মের ঐ জ্বলন্ত খরাতাপের মধ্যে তাকে গ্রামে ফিরতেই হবে। হরিশচন্দ্রবাবুর ঋণ শোধ করে তার শেষ সম্বল আর বাবার স্মৃতি বিজড়িত একখণ্ড ভিটে জমিটি উদ্ধার করতে হবে।
এদিকে শহর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে করে বাড়িতে ফিরে আসেন নিতাইবাবু। বাড়ি ফিরে এসে তিনি দেখেন আবির বাড়িতে নেই। তখন তিনি হতবাক হয়ে যান এবং পল্লব কুমারকে জিজ্ঞাসা করেন, “ছোটভাই পল্লব কুমার, আবির কোথায় গেছে?” কিন্তু সেই মুহূর্তে পল্লব কুমার মিথ্যা ছলনার আশ্রয় নিয়ে নিতাইবাবুকে বলেন, “দাদাভাই, তোমার খোঁজে আবির বহুদিন আগে রাতের আঁধারে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে। আজও সে বাড়ি ফিরে এলো না। আমার মনে হয় সে আমাদেরকে ভুলে গেছে।”
কিন্তু সেদিন নিতাইবাবু তার ছোটভাইয়ের ছলচাতুরি বুঝতে পারলেন না। কেননা, তিনার অনেক বয়স হয়ে গেছে। বয়সের ভারে তিনার শরীর একেবারে নুয়ে পড়েছে। ব্রেন্টে ঠিক মত কাজ করে না বলে ভাল-মন্দ বিচার করার মত ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
তবে নিতাইবাবুর ভাল-মন্দ বিচার করার মত ক্ষমতা না থাকলেও তিনি কোন ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। ছোটভাইয়ের মুখে আবিরের পালিয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা শোনার পরও তিনি পরের দিন থেকে আবির ফিরে আসর অপেক্ষায় থাকলেন। আর তিনি প্রহরীদের আদেশ দিলেন, “আবির গ্রামে ফিরে আসলে সাথে সাথে তিনার কাছে খবরটা পৌঁছে দিতে।”
এদিকে আবির বাড়ি ফিরে না আসাতে, আবিরের চিন্তায় নিতাইবাবু কোন মতেই রাতে ঘুমাতেন না। তিনি মন খারাপ করে সারাদিন চেয়ারে বসে থাকতেন। নিয়মিত মত খাবার করতেন না। আর এই নিয়মিত খাবার না খাওয়ার কারণে নিতাইবাবু বিভিন্ন রকমের অসুখে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি তিনি দিন দিন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। দেশে-বিদেশের কোন বিজ্ঞ চিকিৎসক তিনার কোন রোগ ধরতে পারছিল না। নিশ্চিত পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি দিতে হবে ভেবে নিতাইবাবু সবসময় ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করতেন, মৃত্যুর আগে তিনি যেন আবিরের মুখটি একবারের মত দেখে যেতে পারেন।
অবশেষে কিছু পর আবির গ্রামে ফিরে আসল। সে গ্রামে ফিরে আসর পর পাড়াগাঁয়ের মানুষের মুখে শুনতে পেল, তার শেষ সম্বল তথা নিতাইবাবুর খুব মুমূর্ষু অবস্থা। তিনি নাকি একেবারে মনে ভেঙে পড়েছেন। এমনকি মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছেন। সেই মুহূর্তে আবির তার শেষ সম্বল তথা নিতাইবাবুর দুরাবস্থার কথা শুনে বেদনা ভরা মন নিয়ে ছুটে যায় নিতাইবাবুর কাছে।