প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
অন্ধকার রাতের মতো দুটি চোখ। সেখানে সুড়ঙ্গ বেয়ে নেমে গেছে বিষণ্নতার এক অন্ধ গহ্বর। সেই গহ্বরে পৃথিবীর গভীরতম বেদনার লাভা সঞ্চিত হয়ে হয়ে ফুঁসে উঠতে চাইছে। সহিষ্ণুতার বলে বাহিরটা শীতল তুষার প্রলেপের মতো। নাম তার চন্দ্রা। বুদ্ধিদীপ্ত আঁখি, বিনয় আর প্রজ্ঞার সম্মিলনে সে জগতের কোমলতম সৌন্দর্যের অধিকারী। হাতের কবজি পর্যন্ত কমলা রঙের ব্লাউজ আর রোদরঙা শাড়িতে সে দীপ্তিময়ী, দূরদর্শিনী, মায়াবতী। তার কাছে হিসাব বড় সহজ, সুখের এবং নির্ভুল। তবু হেরে যাওয়ার ভান করে অন্যকে জিতিয়ে দিতে। যাকে সে ভালোবাসে, তার জিতে সে সুখানুভব করে। সে ছাড় দেয়, কিন্তু ছেড়ে দেয় না। সে যে ছেড়ে দেয় না, তা অপরপক্ষ বুঝতে পারে না হৃদয়ের স্থিরতার অভাব কিংবা অনেক কিছুকে জায়গা দিতে হয় বলে।
অন্ধকার চোখের সুড়ঙ্গে বেঁধে নিয়ে চন্দ্রা বলে- আর কিছু জানার আছে? থাকলে বলতে পারেন। মুক্তা গড়িয়ে পড়ার মতো করে চন্দ্রার কথাগুলো ঝুরঝুর করে হৃদয়ের সিঁড়িতে গড়াতে থাকে। সেথা ঝলমলিয়ে ওঠা আলোকছটায় আমার মনের এ ধার-ও ধার চৌচির হয়ে যায়। নিজেকে লুকাই সতর্কভাবে। অবসর দেওয়ার মতো অবসর আমার খুব একটা জমে ওঠে না। তাই বৃথা সময়কে গেড়ে বসার বিলাসিতায় আমি নেই। চন্দ্রার কেসটা হাতে নেওয়াই ছিল বড় একটা ঝুঁকি। আর আমি ঝুঁকি নিতে ভয় পাই না। কিন্তু এবার কেন জানি ভয় হচ্ছে খুব। আমি ঘেমে উঠছি বারবার আর নিজেকে সাবধান করছি।
চন্দ্রা বলে, কোনো আক্ষেপের প্রশ্রয়ে আমি কাতর হই না বলেই এত অন্ধকার পেরিয়ে শীতল মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যায়, তার কথাগুলো সে রকম বয়ে গেল মনের আঙিনাজুড়ে। ঝটপট প্রশ্ন সেরে নিই। কিন্তু চন্দ্রা ধীর, প্রশান্ত জবাবে আমাকে জিইয়ে রাখে। ক্যারিয়ারে প্রসার-খ্যাতি-জীবিকা ভাবনা, যা আমাকে সবসময় এগিয়ে নিয়ে যায়- এই কেসে যেন সেই সব তুচ্ছ। অন্য কিছু আমাকে প্রবলভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যে করেই হোক এই মামলায় আমাকে জিততেই হবে। কিন্তু অসুবিধা হলো, চন্দ্রা একবারও বলে না যে, খুনটা আমি বাধ্য হয়ে করেছি। তার সরল অথচ দৃঢ় জবাব- খুন আমিই করেছি এবং একা।
বিস্ময় কাটে না আমার, এ রকম একজন মানুষ কীভাবে কাউকে খুন করে!
মনে মনে ভাবছিলাম সে কথা। কখন যে তার চোখে চোখ পড়েছিল খেয়াল করিনি। সে বলল, ভাবছেন আমি কাউকে খুন করলাম কীভাবে?
সামলে নিয়ে বলি, জগতে কত কিছুই তো ঘটে, যা মানুষ ভাবে না কখনও। আমি, আপনি এর বাইরে নই। আপনি ভাববেন না, আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। বরং আপনি আমাকে সহায়তা করুন। আমাকে মামলায় জিতিয়ে দিন।
আমি?
বললাম, আপনিই জানেন কীভাবে আমাকে সহায়তা করবেন।
কিন্তু আমাকে বাঁচাবেন না দয়া করে, আমি মুক্তি চাই। চন্দ্রা স্পষ্ট জবাব দিল।
আমি বললাম, না বাঁচালে মুক্তি মিলবে কেমন করে?
কিছু মুক্তি কেবল নিজের বন্দিত্বের মাঝেই মিলে। কিছু বাঁচা কেবল মরে গিয়েই সম্ভব হয়। নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার মাঝেও থাকে বিকশিত হওয়ার আকাশ। নীরবতার মাঝেও থাকে বড় প্রতিবাদ, আবার একটি মাত্র নিঃশ্বাসের আড়ালেও থাকতে পারে বড় কোনো গল্প।
আমি বললাম, চন্দ্রা, আপনাকে ভালো বুঝতে পারে এ রকম কেউ আছেন? যিনি আপনার কাছের মানুষ।
চন্দ্রা বলে, যাকে আমরা কাছের মানুষ ভাবি, কখনও কখনও তার কাছেই আমরা সবচেয়ে বেশি দূরের মানুষে পরিণত হই। কাছের মানুষের সংজ্ঞা আমি ভুলে গিয়েছি উকিল সাহেব। আমি কেবল মুক্তি চাই। তাই এই চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হতে এসেছি।
সাহস করেই বললাম, আমি বুঝতে পারছি আপনি কোন মুক্তির কথা বলছেন।
দুই হাতে নিজের কপাল চেপে ধরে চন্দ্রা। বলে, এই একটা জায়গায় আমি দুর্বল হয়ে যাই- মাথার যন্ত্রণা কাতর করে ফেলে।
আমি বুঝতে পারি, চন্দ্রা আজ আর কথা বলতে চাইছে না। আমি এখন চলে গেলেই বরং সে স্বস্তি পায়। বললাম, ঠিক আছে, আজ আমি চলি। চন্দ্রা মাথা তুলে তাকায় না। না তাকানোটাই স্বাভাবিক। তবু আমার ক্ষুধাতুর মন কেন আশা করে নিরাশ হতে গেল যে চন্দ্রা একবার তাকাবে, একটু হাসতে চেষ্টা করবে, একটু অশ্রু গড়িয়ে পড়তে চাইলে আড়াল করে বলবে- চোখে আবার কী পড়ল! কড়া রোদ বিছানো পথে চলতে চলতে মন বলে ওঠে, প্রকৃতির এ নীরব অভিমান। বর্ষাকালেও তপ্ত ঠনঠনে রোদ বিলাচ্ছে। আমরাই প্রকৃতির ওপর অত্যাচার করে তাকে রুষ্ট করে তুলেছি। অথচ এই সময় আমাদের বৃষ্টি পাওয়ার কথা ছিল। আমাকে জানতেই হবে কোন সেই অভিমানে আজ তুমিও এত কঠিন চন্দ্রা। আমার ভেতরেই বা এ কোন এক অভিমান উঁকি দেয়- এই যে তুমি ফিরে তাকালে না বলে!