প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
নাগরদোলার মতো প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো উত্তর মিলছে না।
তার সঙ্গে মুখোমুখি কখনও কথা হয়নি। হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ে কথা হয়েছে। চোখের ইশারায় কথা হয়েছে। 'চোখ যে মনের কথা বলে'- এমন গান ছেলেবেলায় শুনতাম। আলবেলা যেন বাস্তব জীবনের তেমনই আখ্যান
আলবেলা আসছে না। বুকের মাঝে কেমন যেন করছে। হৃদয়টা শুকনো নদী হয়ে আছে। তৃষ্ণার্ত মনে হচ্ছে। আলবেলা যেন এক পেয়ালা জল। তাকে দেখলেই সব তৃষ্ণা দূর হয়ে যাবে। সব মন্দ লাগা ভালো লাগা হয়ে যাবে। সব বেদনাগুলো পালিয়ে যাবে। শুকনো নদী ভরাট হয়ে যাবে। মনের বর্ষাকাল হয়ে যাবে বসন্তকাল। মন সতেজ হয়ে যাবে। নতুন পাতা জেগে উঠবে। কখন ফিরবে সে। সে তো দেরি করে না। আজ এমন করছে কেন। নাগরদোলার মতো প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো উত্তর মিলছে না।
তার সঙ্গে মুখোমুখি কখনও কথা হয়নি। হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ে কথা হয়েছে। চোখের ইশারায় কথা হয়েছে। আলবেলা যেন বাস্তব জীবনের তেমনই আখ্যান। তার সঙ্গে কথা না বলেই অপরিমেয় ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে। নুক বুক স্টোরে দাঁড়িয়ে বই দেখছি। বইয়ের র্যাকে হরেক রকমের বই সাজানো। একটা বই দেখছি। আরেকটা রাখছি। গুলশান-২ এলাকায় সুনসান পরিবেশে একমাত্র নুক বুক স্টোর। বেশিরভাগ বই ইংরেজি। পাঠকগুলো বেশ উচ্চ মানসিকতার। বেশ রিচ বই। বাংলাদেশের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পাঠক এখানে বই পড়তে ও কিনতে আসেন। তেমনই এক পাঠক আলবেলা ও আমি। নামটা তার মুখ থেকে জানতে পারিনি। সে খাতায় এন্ট্রি করত। আড়ালে আমি এন্ট্রি করার সুবাদে দেখেছি, সেখান থেকে জানতে পেরেছি- সে রাশিয়ান মেয়ে। চোখগুলো টানা টানা। একবার তাকিয়ে থাকলে চোখ নামাতে ইচ্ছে করে না। হালকা গড়নের। জিন্স প্যান্ট ও টি-শার্ট পরত। সাইকেল নিয়ে সে আসত। আমি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষ করেই চলে আসতাম নুক বুক স্টোরে। কোনোদিন আমি, কোনোদিন সে আগে আসত। আমি আগে এলেই চারদিক খুঁজতাম। আলবেলা আসছে কি-না। যখন তাকে দেখতে পেতাম না, তখন অস্থির হয়ে যেতাম। র্যাকের পাশে কাচের জানালা দিয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আলবেলা আসছে কি-না- সবকিছু কেমন যেন খালি খালি লাগছে। অস্থির লাগছে। এমন সময় পেছন থেকে ডাক শুনলাম। এক্সকিউজ মি?
জি! আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ। আপনাকে বলছি। আমি কাশফিয়া হক। নুক বুক স্টোরের প্রতিষ্ঠাতা। আপনি কি মি. শোয়েব?
হ্যাঁ। আমি শোয়েব। আমার নাম জানলেন কীভাবে?
সেটা এক বিরাট ঘটনা। আপনার নামে একটি চিঠি আছে। আলবেলা দিয়েছে। অনেকদিন হলো আপনাকে খুঁজছিলাম। পাচ্ছি না।
আমি অসুস্থ ছিলাম। কয়েকদিন জ্বরে আক্রান্ত ছিলাম। এসে দেখি আলবেলা আসেনি। কাশফিয়া ম্যাডামের কাছ থেকে আলবেলার চিঠিটা নিলাম। তড়িঘড়ি করে চিঠি খুললাম। নুক বুক স্টোরের এক কোণে বসে চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করলাম। চিঠিটা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়-
শোয়েব, তুমি কেমন আছ জানতে চাইব না। কিন্তু জানার আগ্রহ অনেক। যে বিষয়টিতে আমার জানার বেশি আগ্রহ তা আমি এড়িয়ে যাই। শত বেদনা হলেও এড়িয়ে যাই। তুমি অবাক হয়ো না। তোমার নাম আমি কীভাবে পেলাম। তোমার নামটা আমি রেজিস্টার থেকে নিয়েছি। আমি যেদিন আগে আসতাম, তোমাকে খুঁজতাম। তুমি শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে প্রবেশ করতে। আমি তোমাকে ফলো করতাম যখন তুমি খাতায় নাম লিখতে। আমি অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। তোমাকে চোখ ভরে দেখতাম। কেন জানি তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আমি রাশিয়া থেকে এখানে স্টাডি করতে এসেছি। খুব কম বাঙালি ছেলের সঙ্গে মিশেছি। কখনও কাউকে বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করিনি। তোমাকে কেন জানি অন্য রকম ভাবতে শুরু করি। স্বপ্ন দেখতে থাকি। হঠাৎ করে কয়েকদিন তোমাকে দেখতে না পেয়ে মন খুব খারাপ হয়ে যায়। মনের আকাশে কালো মেঘ জমাট বাঁধে। তোমার সঙ্গে কথা বলার খুব ইচ্ছে হতো। কিন্তু আমি বোবা। কথা বলতে পারি না। তাই তোমার সঙ্গে কথা বলার সাহস হয়নি। তুমি আমার বোবার কথা শুনে যদি না আসো। আমার দিকে যদি না তাকাও, তখন আমি বেশি দুঃখ পাব। সেই বেদনা থেকে আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করো। ভালো থেকো। ইতি আলবেলা।
চিঠিটা পড়ার পর চোখ ভিজে গেল। মনের ভেতর টর্নেডো-সিডর বয়ে যেতে লাগল। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। কেন যে আলবেলার সঙ্গে কথা বললাম না। কেন যে বললাম না, আলবেলা কথা শুধু মুখ দিয়েই বিনিময় হয় না। মন ও চোখ দিয়েও হয়।