মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

কৌটা
সাইফুল ইসলাম জুয়েল

ছোটবেলা থেকেই মনের ভেতরে এক অদ্ভুত ইচ্ছা কাজ করত। আমি যদি আলাদিনের মতো ‘জাদুর কৌটা’ হাতে পেতাম! আলাদিনের জাদুর চেরাগ পাওয়ার প্রতি লোভ কখনও ছিল না। সে লোভ আমার জন্মের আগেই শত শত জন করে রেখেছেন। ফাও ফাও সেইসব ‘চেরাগ’ চাওনেওয়ালার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়িয়ে কী লাভ! তারচে' বরং কৌটা পেলে বেশি লাভ হতো। দাদিকে দেখতামণ্ড জর্দার কৌটা থেকে কাঁচা সুপারি বের করে পানের সঙ্গে খেতেন। জর্দার কৌটায় ‘শিঙ্গাড়ার ভেতরে কীভাবে ঢুকিল আলু’র নিয়ম মেনে যদিও বা সুপারি ঢুকে থাকে, একদিন কী জানি মনে করতেই সেই কৌটা খুলতে গিয়ে পেয়ে গেলাম একশত টাকার একখানা কচকচে নোট! ভেবে পেলাম না- একজন পান খাওনেওয়ালা লোকের কৌটায় এমন চকচকে নোট কী করে এলো? টাকার গায়ে মিনিমাম পানের পিক তো থাকার কথা! তাছাড়া, জর্দার কৌটায় টাকাই বা কীভাবে এলো?

সেই থেকেই দাদির জর্দার কৌটাগুলো হয়ে গেল আমার অঘোষিত টাকশাল। সবসময় নয়, তবে মাঝেসাঝেই কৌটাগুলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত বিভিন্ন মূল্যমানের টাকা।

তখন থেকেই জর্দার কৌটা তো বটেই, যে কোনো ধরনের কৌটা দেখলেই তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতাম। মাঝেমধ্যে আক্ষেপও করতাম- ইস, যদি আলাদিনের জাদুর চেরাগের মতো দাদির কৌটার থেকেও একটা উন্নতমানের কৌটা মিলত! জাদুর দৈত্যকে তিনটি ইচ্ছের কথা বলে কী হবে! জাদুর কৌটা যদি আমাকে টাকার পর টাকা দিয়েই যায়, তাহলে আর টাকা ভিন্ন অন্য কিছু চাওয়ারই বা কী দরকার? কথায় বলে না- টাকায় বাঘের দুধও মেলে!

এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। আমার কৌটাপ্রীতি মনের অবদিমত স্তরে চাপা পড়ে থাকলেও, একদিন ঠিকই সুরুৎ করে বেরিয়ে এলো। আর বেরিয়ে এসেই সে চিক্কুর দিয়ে উঠল, 'কৌটা চাই, কৌটা!'

একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলামণ্ড একদল তরুণ কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন করছে। বিষয়টাকে পাত্তা দিলাম না খুব একটা। বলতে দ্বিধা নেই, আমি তখনও কৌটার মাঝেই নিবিষ্ট ছিলাম। বন্ধু-বান্ধব আমাকে তাদের সঙ্গে এই আন্দোলনে শামিল হতে বললেও খুব একটা কানে তুলিনি।

ধীরে ধীরে কোটার প্রভাব আমার ওপরে এসে পড়তে শুরু করল। বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে দেখি- বাড়িওয়ালা জানায়, ব্যাচেলর কোটায় ঘর খালি নেই! বড় পরিবার হলেও সমস্যা হতো না, ঠিকই ব্যবস্থা হয়ে যেত!

টিউশনি নিতে গিয়ে কোথাও শুনি- ফিমেইল টিউটর হলে (কোটা থাকলে) চলত। আরেক জায়গায় গিয়ে শুনতে হয়- আমি অমুক কিংবা তমুক সাবজেক্টের (কোটার) শিক্ষার্থী হলে টিউশনিটা পেয়ে যেতাম। কিন্তু তাদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে আমার অভিজ্ঞতা ও পড়ানোর ভালো দক্ষতা থাকলেও তার কোনো মূল্য নেই...

রাস্তায় পথ চলতে গিয়ে দেখি- এ শহরের ফুটপাতও সাইকেল-মোটরসাইকেল আর হকার কোটায় দখল হয়ে গেছে। সেখানে পথচারীদের সুষ্ঠু চলাচলের কোনো সুযোগ (কোটা) নেই।

রাস্তায় পাঁচজনের সিটসমৃদ্ধ প্রাইভেটকারটি একজনকে নিয়ে, বাকি সিটগুলো ফাঁকা রেখে চালিয়ে গেলেও, লোকাল বাসে আমার বসার সিট (কোটা) থাকে না। এমনকি পা ফেলার জায়গাটুকু পেতেই সংগ্রাম করতে হয় দিনভর।

স্কুল জীবনে কখনও কোটা নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। বৃত্তিটা কোন কোটায় পেয়েছি, পরীক্ষায় যে এত এত-তম স্থান দখল করছি, তাই বা কোন কোটায়, এলাকার কিশোরীরা চিঠি লিখে কাউকে দিয়ে আমার কাছে পৌঁছে দিত, সেটাই বা কোন কোটায় পেতামণ্ড এমন প্রশ্ন কখনও জাগেনি মনে।

তবে, কোটার গুরুত্ব প্রথম বুঝলাম সেদিন যখন ফেসবুকে এক তরুণী তন্বী আমাকে প্রশ্ন করে বসল, আমার কোনো কোটা আছে কি-না!

দ্বিধায় পড়ে গেলাম। সত্যিই কি আমি কোটাধারী, নাকি সাধারণ! বালিকা কেন আমার কোটা থাকা না থাকা নিয়ে এত চিন্তা-ভাবনা করছে?

দ্বিতীয়বার কোটার গুরুত্ব বুঝলাম সেদিন, যেদিন আমার ছোট মামার খোদ বিয়েটাই ভেঙে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। ঘটক নাকি মেয়ে পক্ষের প্রশ্নের জবাবে তাদেরকে বলেছিল, হ্যাঁ, ছেলের কোটা আছে। কিন্তু বিয়ের দিন, ঠিক কবুল বলার আগ মুহূর্তে আবারও যখন একই প্রশ্ন করা হলো, তখন আমাদের সহজ-সরল ছোট মামাটি জানালেন, না, তার কোনো কোটা নেই। এমনকি চৌদ্দগুষ্টির মধ্যেও কোনো পুরুষ লোকের কোটা আছে বলে জানা নেই তার!

মুহূর্তেই বিয়ের আসরে শোরগোল লেগে গেল। ঘটক মহাশয় তখন জমিয়ে উদর পূর্তিতে ব্যস্ত ছিলেন, সেই অবস্থাতেই তাকে চ্যাংদোলা করে সবার সামনে নিয়ে আসা হলো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো- এখুনি বুঝি তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে লটকানো হবে! এক সময় প্যাঁচ লাগার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন হলো। জানা গেল- ঘটক মহাশয় ছোট মামাকে কোটার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু মামা শুনেছিলেন- তার কোট আছে কি-না সে কথা জানতে চাইছেন! অন্যদিকে, বিয়ের দিন কে কোট পরে? মামা তার দামি শেরোয়ানিখানা পরে বিয়ে করতে এসেছেন, তাকে কি-না জিজ্ঞেস করা হলো কোটের কথা! তাই তিনি রেগেমেগেই বলে বসলেন, না, তার চৌদ্দগুষ্টিতেও কারও কোট নেই!

শেষমেশ প্যাঁচ ছুটল। বিয়েও হলো। সমাধানের একমাত্র কারণ- মামা কোটাধারী! তা না হলে আর বিয়ে...!

কোটার গুরুত্ব তৃতীয়বার বুঝলাম, চাকরির জন্য এখানে-সেখানে ইন্টারভিউ দিতে দিতে। একখানা কোটা না থাকার কারণে, আজ আমি একজন সাধারণ গ্রেডের 'মেধাবী' হওয়া সত্ত্বেও বেকার যুবক। নিত্য পায়ের নিচের জুতোর পুরুত্ব সমানুপাতিক হারে খুইয়ে চাকরি খুঁজে বেড়াই।

ছোটবেলায় আলাদিনের জাদুর দৈত্যের তিনটি ইচ্ছে পূরণকে গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু বড় হয়ে তৃতীয় ধাপে কোটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।

একখানা কোটার জন্য এখানে-সেখানে কম দৌড়ঝাঁপ করলাম না। শেষমেশ মনে এই কামনাও জাগল- ইস, যদি একজন কোটাধারী রমণীকে বিয়ে করার সৌভাগ্য হতো! অন্তত, ছেলেমেয়েদের ক্যারিয়ার নিয়ে তো নিশ্চিন্তে থাকতে পারব!

৪.

বেকারত্বের অভিজ্ঞতা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। পকেটের হাল দিন দিন বেহাল হচ্ছে। দিন দিন আমার কৌটাপ্রীতিও কমছে বৈকি। তবে, কখন যে কৌটার ঔ-কার ও-কারে রূপ নিয়ে কোটায় পরিণত হলো টেরই পেলাম না। সেই ছোটবেলার মতোই এখন মনের ভেতরে এক অদ্ভুত শখ কাজ করে- আমি যদি আলাদিনের মতো ‘জাদুর কোটা’ হাতে পেতাম! কিন্তু মানুষ যা চায়, সবই কি মিলে?

বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসেই তাই মাঝেমাঝে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে- আহারে কোটা, আহা কোটা!

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়