প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
আচমকা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে বৃতি। অবিশ্বাস্য। বনফুলের নিমগাছের মত অন্নপূর্ণা হতে পারতো সে। দীর্ঘ সাতাশ বছরে শেকড় অনেকদূর পৌঁছে গেছে। মোটা ও শক্ত হয়েছে। এতোদিনের ধৈর্যের বাধ তলিয়ে গেছে। কোনো উপায়ও নেই যেন। ছোট্ট বুকে লালিত যাতনা বোমা হলো বিস্ফোরণ হলো না। কোনো উপায় না পেয়ে নিজেকে লুকানোর চেষ্টাই যেন সর্বউৎকৃষ্ট পন্থা হয়ে উঠে বৃতির কাছে। ক্ষোভের উদগিরণ যখন হলো ঘর থেকে একটু সামনে আসতেই পথ আগলে দাঁড়ালো মা। কপালে কপাল ঠেকিয়ে শাশুড়ি মা বলেন, আমিতো তোরও কুড়ি বছর আগে এ বাড়ি এসেছি। প্রায় ৫০ বছরের দীর্ঘশ্বাস। আমি এতিম তাই কাউকে বলতে পারিনি। সংসারজীবনের পঞ্চাশ বছরেও নিজেকে মনে হয় পরাগাছা। হয়তো নারী জীবনটাই এমন। মূল্যহীন যেন খড়কুটা অথবা ঘরের কাঁড়ে উঠিয়ে রাখা শীতের কাঁথা।
এখন রাতে কুয়াশা জমে। সকালে হালকা হালকা শীত। দু-একদিন পরেই ঘরের কাঁড়ে রাখা কাঁথার কদর হবে। নিচে নামিয়ে রোদে শুকিয়ে যত্ন করে তোলা হবে শোবার খাটে। বলতে গেলে ওই কাঁথার মতো মৌসুমী যত্মটুকু কপালে জুটেনি কখনো রমজান বানুর। জীবনে শুধু গাধা খাটুনি খেটেছে।
বউ-শাশুড়ি যুগল চোখের জল ফেলে তবুও জেদ মাটি হয় না বৃতির। যেন বুকের ভেতর অগ্নুৎপাত। পুড়িয়ে ছাই করছে হরদম। শরীর খুব ব্যথা, জিহ্বায় ঘা লেগেছে। সংসারের ঘানি টানতে হলে যে শরীরটা ভালো থাকা চাই মা। জামাকাপড়ের ব্যাগটা হাত থেকে জোর রেখে দেন শাশুড়ি মা। রমজান বানুর বাধা ডিঙানের সহাস হলো না। প্রতিবাদ করতে পারলো না বৃতি। সবুজ কাঁচা দূর্বাঘাসে ল্যাপ্টে বসে পড়ে। ডাক্তার দেখানোর নাম করে কোনো মতে রমজান বানুকে বুঝিয়ে চৌদ্দ বছরের মেয়েটাকে সঙ্গে করে ছুটতে থাকে অজানা উদ্দেশ্যে।
সামনে পা ফেলতে ফেলতে ভাবে কোথায় যাবো? গেল বছর শীতের আগে কিছু দিন মায়ের কাছে থাকা হয়েছিলো। মার কাছে যাওয়ার সুযোগটাও যে এবার হারিয়ে গেছে। উবে গেছে প্রকৃতির নিয়মে। ভাইদ্বয় তাদের সংসার নিয়েই হিমশিম খায়। স্বার্থের কারণে ভাই সম্পর্কটাও যেন ফানসে ফানসে। মেয়ে হিসেবে স্বামীর বাড়ি ছাড়া আর কোথায় আশ্রয় নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়? নাই। সে জায়গাটুকু নাই।
মা না থাকলে পৃথিবীতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। একদিন মায়ের মাথার গুচ্ছ চুল তেলে ভিজে চুপ চুপ। সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে। গোসল সারতে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে গড়িয়েছে। বিকেল বেলার সূর্যাস্তের শেষ আলোটা মাকে ছুঁতে পারেনি আজ। অল্প ক'দিন বাদে ধান কাটা হবে। সারাদিন সে প্রস্তুতি নিয়ে ছিলেন ব্যস্ত। মাঝে মাঝেই মাকে বলতে শুনি, এই সময়ে দিনটা অনেক ছোট। দিনের কাজ শেষ করা যায় না। সূর্যের সাথে পেরে ওঠা যায় না। মায়ের জীবনটাও যেন শীতের ছোট্ট দিনের মতো। অল্পতে ফুরিয়ে গেছে। মায়ের কথা মনে পরতে বুকফাটা চিৎকার আসছিলো। কিন্তু চিৎকার দিতে পারেনি বৃতি। আশপাশের লোকজন কি ভাববে? এই ভেবে সেই চিৎকরের শব্দকে পাথর বানিয়ে আগলে রাখে বুকে। মেয়েটার হাত ধরে হাঁটে বৃতি।
প্রকৃতির শরীরজুড়ে শীতের বসবাস। এমনি একদিন কিশোরী বৃতির বিয়ে হয়। তখন অস্টম শ্রেণীতে পড়ে। কিশোর স্বামী বেকার। বাবার বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের জবাব দেয়ার উপায় ছিল না। পড়শিদের কতশত প্রশ্ন। স্বামী কি করে কি দিয়েছে শ্বশুরবাড়ি থেকে কি পেলি নানান প্রশ্নে জর্জরিত। এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়ে উঠতো না। কৌশলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে অন্য কথায় মজে যেতো। কি পেয়েছে সে কথা বললে ছোট হবে স্বামীর বাড়ি আর স্বামী। সাংসারিক টানাপোড়নের পাশাপাশি পড়ালেখা চালাতে থাকে বৃতি। অনার্স শেষ করে। প্রাইমারি স্কুলে চাকুরি হয়। চলতে থাকে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। একফোঁটা দম ফেলার ফুসরত নেই যেন। এই ঘরে কখনো একজন কাজের লোক রাখা হয়নি। কারণ ঘরের মহাজনেরাই অন্যের কাজে লোক। সেদিন ঘরে যা ঘটলো। তা কোনো ভাবেই কাম্য ছিলো না। তারপরেও ঘটলো। ছেলেকে মারের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে মার খেতে হয়। ছেলের ভুলটুকু কী? জানতে চাওয়াও যেন বড় অপরাধ। বিগত বছরগুলোয় কথার তীর বিঁধেছে বুকে হরহামেশাই। আর আজকের আঘাত করা বৃতি নিজেকে সামলাতে পারেনি। না হয় নিজের ঘর থেকে এমন সময়ে কেউ বের হয় না।
যে মানুষগুলোকে ইচ্ছের বিরুদ্ধেও শ্রদ্ধা আর সম্মানের আসনের রাখা হতো সেই মানুষগুলোই এখন কেমন যেন অচেনা অজানা দূরের। কিছু মানুষকে টাকা অহংকারী করে তোলে। এই টাকার উৎস অর্থাৎ গোড়ায় হাত দিলে বোঝা যাবে কেমন করে অর্জন হলো এই অহংকারের উপকরণ।
সাতাশ বছরের মায়া যে ঘরে লেপ্টে আছে কোণায় কোণায়। সে ঘরের মায়া কিভাবে ভুলে বৃতি। মায়া যে বড় মায়াময়। মায়াকে ভোলা বড় কঠিন। টিন-কাঠের সে ঘর এখন বহুতল দালান হয়েছে। টিনের ঘরের সেই লক্ষ্মী বৃতি এখন যেন ঝরা পাতা। দালানের ইট-পাথর টাইলস তার চেয়েও এখন অনেক দামি। এখানেও মিশে আছে বৃত্তির রক্ত শ্রমণ্ডঘামণ্ডধর্য। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মেয়েকে সাথে নিয়ে আসলেও ছেলেটা আসেনি। মেয়েটা মা ছাড়া কিছুই বুঝে না।
শহরে এসে দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া নেয় বৃতি। ঘর ঘুছাতে হিমশিম খেতে হয়। টাকা এখন বড় সমস্যা না। চাকুরির যে বেতন তা দিয়ে দুই ছেলে মেয়ে আর নিজের সংসার ভালোই চলবে। তবুও দুই রুমের এ বাসায় মন টেকে না। মনটা পড়ে থাকে শাশুড়ি মায়ের কাছে। খুব দুখি মানুষ তিনি। যে ঘর ছেড়ে চলে এসেছে বৃতি। সে ঘরেই মাটি হয়ে আছেন রমজান বানু। মা নেই। শাশুরিই এখন মা। তিনি বৃতির ব্যথা বুঝেন। দুঃখ বুঝেন। এছাড়া আর কেউ নেই দুঃখ বুঝার। তাই বড় মায়া হয় শশুড়ির জন্যে। মায়ার সংসারের জন্যে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ে। বৃতির চোখ নির্ঘুম। রাত গভীর হতে হতে ভাবনা গভীর হয়। অতীত সামনে এসে জ্বলজ্বল করে। স্বামী তখন বেকার। নিজের পকেট খরচই চালাতে পারে না। শশুরের ঘাড়ের উপর বড় সংসার। রিক্সা চালিয়ে চলে কোনো মতে। পরে অবশ্য একটা বেবি টেক্সি ম্যানেজ করতে পারলেন। সে আয়ে সংসারে কিছুটা অনটন কেটেছে। বৃতির স্বামী ট্যাক্সি চালিয়ে সংসারে কিছুটা যোগান দেয়ার চেষ্টা করে। কুড়ি বছর আগে প্রবাসে গিয়ে মার খেয়ে দেশে ফিরে আসা। ছোট্ট ব্যবসা দিয়ে কোনো মতে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা। পাশাপাশি নিজে টিউশনি করে সংসারে হাল ধরা। চাকুরীর টাকা স্বামীর ব্যবসায় খাটানো। সময়ের সাথে আর্থিক সামর্থ মোটাতাজা হতে থাকে। এখন কোটিপতি স্বামী। বড়লোকি মন। হাতে আইফোন। নিয়মিত ব্যবহারের জন্যে আরেকটি মোবাইল। ব্র্যান্ডের দামি মোটরসাইকেল। কদিন হলো প্রাইভেট কার কিনতে ইচ্ছে পোষণ করছে। টাকা আছে এখন কিন্তু কিনিকিনি করে কেনা হয় না। এখন সব আছে। শিশু সেই মানুষটার ভেতর একটা পশু জন্মে বড় হয়েছে। পশু যেখানেই থাকুক তার চরিত্র বহন করবেই। বুকে বা বনে।
বৃতির ফোনটা বাজছে। দেবরের নম্বর। কখনো ননদের। একবার ছোট খালা। কখনো ছোট মামা ফোন করছে। বৃতির কল ধরতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু একের পর এক কল আসায় নিজে স্থির থাকতে পারলো না। ছোট মামার কলটা বেক করলো বৃতি। ওপ্রান্ত থেকে বলেন, বৃতি এমন করছিস কেন? তের সংসারের সব আমি জানি। তিলে তিলে গড়া সংসার থেকে তুই বের হবি কেন? বের হলে অন্য কেউ হবে। তোর বাড়ি থেকে বের হওয়া ঠিক হয়নি।
- কী করবো মামা আর সহ্য হয় না। এতো দুর্গম পথ কতোদিন পাড়ি দেয়া যায়। বুঝি যারা পাহাড় বায় তাদের টিলা বাইতো অতো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মামা একটা সংসারে গুরুত্বহীন হয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।
- শোন, তোর শাশুড়ি খুব অসুস্থ। এখন ওসব কথা বলার প্রয়োজন নাই। পরে বিষয়টি দেখা যাবে।
- কী হয়েছে? আমি তো ভালোই দেখে এসেছি।
- তুই চলে যাবার পর তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। ভোর হলে ঘরে ফিরে আসিস।
বৃতিদের সংসারে ছোট মামা যেন বটবৃক্ষ। তিনি ছায়া দিয়ে পুরো সংসার গুছিয়ে রেখেছেন। সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়েছেন। মামার কথার অবাধ্য হয়নি কখনো বৃতি। তাই মামার কথায় মৌন সম্মতি দেয়। কিন্তু আসবে কি আসবে না সে কথা জানায় না। ভোর হয়। আরেকটি কুয়াশাস্নাত সকাল। রাগ-অভিমান ভুলে ঘরে ফিরবে কি ফিরবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সকাল থেকে আবারো ফোন বাজছে। তবে রিংটোন সাইলেন্ট থাকায় আওয়াজ হয় না। একডজন কল এসে মোবাইলের স্কীন জুড়ে রেখেছে। আবারো মামার ফোনটা বেক করে বৃতি।
- তোর শাশুড়ির অবস্থা খুব খারাপ। চোখও খুলছে না। দ্রুত চলে আয়। আর রাগ নিয়ে থাকিস না।
বৃতি ফোন রেখে দেয়। ছটপট শুরু করে সে। বাসায় তালা মেরে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি এসে হাজির হয়। বাড়িতে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। তিন ননদ। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই এসেছে। দ্রুত ঘরে ঢুকেই রমজান বানুর কাছে যায় বৃতি। কপালে হাত দেয় বৃতি। মা বলে ডাকতেই চোখ খুলো রমজান বানু। একদিনেই কত কাহিল হয়ে পড়েছেন। সন্ধ্যারাতে ওষুধ খাননি?
না-সূচক মাথা নাড়ে রমজান বানু। দু চোখের কোণ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে। এ জল ফিরে আসার। এ জল আনন্দের। বৃতি রমজান বানুর কপালে কপাল ঠেকায়। মমতার মায়াজালে আটকা পড়ে সব অভিমান।