প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর ॥ সমাপ্ত)
এর ফাঁকে বিছানার নিচ থেকে কিছু একটা কোমরে গুঁজে নেয় নিপু। ততোক্ষণে শোলকা খুব নিরবে দরজা খোলে। তারপর দুজন আস্তে করে বেরিয়ে পড়ে। শোলকার বাবা ঘুমাতে পারছিলেন না। বিছানায় শুধু ছটপট করছেন। তাই ঘরের দরজা খুলে সামনে এটা চেয়ার পেতে বসে আছেন। নিপু ও শোলকা আখড়ার দিকে যাচ্ছে। বিদঘুটে অন্ধকারের মধ্যে একটি মেয়ে একটি ছেলে সেদিকে যাচ্ছে তিনি টের পেয়েছেন। এত রাতে নিপু ও শোলকা ছাড়া আর কেউ হবে না। শোলকা আগে আগে হাঁটে। আর পেছন পেছন নিপু। শোলকার বাবা বিষয়টি বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে বসে আছেন। এতোকিছু হচ্ছে কোনো কিছুই এখনো শোলকার মায়ের কাছে বলেনি পরিমল বৈদ্য। বসে বসে ভাবছেন কী করা যায়? তবে তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে? যদি দুইজন দুজনকে ভালোবাসে তাহলে ওসি বিষয়টি আমাকে জানাবে কেন? এ ভালোবাসাবাসি তো তাদের বিষয়। আচ্ছা। এসব নিয়ে ভাবতে আর ভালো লাগছে না।
নিপু শোলকা দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। চারিদিকে বিদঘুটে অন্ধকার। একজন আরেকজনে শুধু অনুভব করছে। কিন্তু দেখা যায় না। সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে তা শুধু বোঝা যায়। কিছুই দেখা যায় না। শোলকা নিপুকে জড়িয়ে ধরে। ঠিক বুকের মধ্যে আগলে রাখার মতো। নিপু তার হাত উঠায় না।
শোলকা বলে, তুমি প্রথম যেদিন আমাকে স্পর্শ করলে সেদিন থেকে ভালোবাসি। অন্ধের মতো। বধির বা বোকার মতো। তুমি এখনো কি বোঝ না যে তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। যেহেতু আমার শরীর-মন সব দখল করেছ। আমি তোমাকে কোনো ভাবেই ছাড়ছি না। তোমার পেছন পেছন আমি সবসময়ই আছি। তুমি রাতে নুপুরকে নিয়ে ঘরের বাইরে গেছো। সবশেষ নুপুর তোমার কথায় রাজি না হওয়ায় তুমি তাকে জোর করে ধর্ষণ করার চেষ্টা করলে। তখন তোমার কাছে আসি। নুপুর আমাকে দেখে ভরসা পায়। নুপুরভাবে সে বুঝি রক্ষা পেলো। নুপুর তোমার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা করার হুমকি দিয়েছিলো। তুমি অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে। তোমার অসহায় মুখ দেখে আমি ঠিক থাকতে পারিনি। তোমাকে সেভ করতে নুপুরকে হত্যার পরিকল্পনা করি। আর তুমি তখন আমাকে সহযোগিতা করলে। তুমি নুপুরকে জাপটে ধরলে পেছন থেকে। আর আমি গলা টিপে ধরলাম। দম চলে যাবার পর দুজন দুজনের মতো করে ঘরে চলে যাই। তারপর কতো কতো নাটক। সব কিছু আমি মোকাবেলা করেছি। তুমি কী ভেবেছ? বিশ হাজার টাকায় সব শেষ হয়ে যায়? হয় না। আমি ওসির সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলি। সব ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিহত করি। তবে আমার শর্ত হচ্ছে আমি তোমাকে বিয়ে করবোই। যা ওসি সাহেবকেও জানিয়েছি। তাইতো তুমি এবং আমার বাবাকে ডেকে নিয়ে বিষয়টি শেয়ার করেছে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হয় দুই একদিনের মধ্যে আমরা দুজনেও আটক হয়ে যাবো। কারণ পুলিশ পুরো বিষয়টা ধরে ফেলেছে।
নিপু কোনো কথা বলে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। নিপু মনে মনে ভাবে, আমি কোন্ দিকে যাবো? একদিকে নিজের জীবন। অন্যদিকে সমাজ। কী করা উচিত? নিপু শোলকাকে বুক থেকে সরিয়ে মাটির উপরে ল্যাপ্টে বসে পড়ে।
জীবন এতো কঠিন হয়? নাকি নিজেই জীবনকে কঠিন করে তুলেছি? কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না নিপু। সে মনে হয় ঘুম ঘোরে আছে। এবার নিপু প্রতিবাদী হয়। আমি মানি না এসব নিয়মকানুন। জীবনের জন্যে যা করা প্রয়োজন আমি তাই করবো। সমাজ মানুষকে তৈরি করে না। সমাজ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে না। আগে মানুষ। তারপর সমাজ। মানুষ না থাকলে সমাজ দিয়ে কী হবে? মানুষ না থাকলে সমাজ গড়ে উঠতো না। শাস্ত্র জীবন পরিচালনার জন্য। শাস্ত্রের জন্যে জীবন নয়। সুতরাং শোলকাকে বিয়ে করাই উত্তম। তাছাড়া শোলকাকে বিয়ে করলে পুলিশি ঝামেলাও মিটে যাবে। কিন্তু না কিছুক্ষণ পরেই আবার উল্টো চিন্তা মাথায় আসে। যেহেতু শোলকার জন্যে নুপুর খুন হয়। আজ আমি অপরাধী। শুভ জেল খাটছে। সেহেতু মূল সমস্যা শোলকা। তার সাথে আমার এতো আপোষ করতে হবে কেন? আজ আপোষ করলে সমগ্র জীবন তার কাছে ব্যক্তিত্বহীন হয়ে থাকতে হবে। তার সব কথা আমাকে মাথা পেতে নিতে হবে। এভাবে পরাধীন থাকার চেয়া জীবন না থাকাই ভালো। তারপর সামজের নানান কথা আমি আমার পরিবার সবাইকে সহে যেতে হবে যুগের পর যুগ। এমন অপবাদ নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। তারচেয়ে ভালো আমি নিজেকে বাঁচানোর পথ খুঁজি। তখন গভীর রাত। আঁধার শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে । কী করবো? আজকের মতো আর সুযোগ নাও পেতে পারি।
নিপু ও শোলকা ফিরতে দেরি হওয়ায় আখড়ার দিকে রওনা হয় শোলকার বাবা। অন্ধকারে টর্চ লাইটও ব্যবহার করা যাবে না। বাড়ির অন্য লোকজন টের পেলে জাতকূল সব যাবে। মান সম্মান সব ধূলোয় মিলিয়ে যাবো। তাই অন্ধকারের মধ্যে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আখড়ার দিকে আগায় পরিমল বৈদ্য।
নিপু আর বেশি চিন্তা না করে কোমরের খুচি থেকে ছুরি বের করে শোলকার বুকে বিঁধে দেয়। তারপর পেটে কয়েকটা ঘাই দিয়ে শোলকার ছটপট করা দেহ ফেলে রেখে মাতালের মতো করে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পথ ধরে নিপু। অবশ্য এবার নিপু অন্য পথ দিয়ে ঘরে ঢুকে। যেপথ দিয়ে শোলকা ও নিপু এসেছিলো সে পথে আসছে পরিমল বৈদ্য। কিন্তু একেবারে আখড়া এলাকা নিরব হওয়ায় ঠিক গন্তব্যে পৌঁছার সাহস পেলেন না তিনি। বাধ্য হয়ে আধপথ থেকে ঘরে ফিরে যান। ভোরের আগেই নিপু গ্রাম ছেড়ে পালায়। জীবন থেকে পালায়।
পরদিন সকালে এলাকার মানুষ জানতে পারে আখড়ায় এবার খুন হয়েছে পরিমলের মেয়ে শোলকা। পুলিশ আসে। শোলকার লাশ সুরতহাল করে। এমন খবর শুনে সকালেই জ্ঞান হারিয়ে ফেরে পরিমল। পুলিশ লাশ থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে লাশ ময়নাতদন্তের জন্যে সরকারি হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। ওসি তখনো বুঝতে পারেনি মার্ডারের ঘটনা কোথায় ঘটেছে। লাশ থানায় আনার পর ওসি নিজে যখন লাশ দেখলেন তখন তিনি থ খেয়ে গেলেন।
তিনি ভাবলেন, নিশ্চিত নিপু শোলকাকে খুন করেছে। কী বিপদ। একটা খুনের সমাধান না হতেই আরেকটা খুন। কতো ঘটনা। এতো ঘটনা কিভাবে সামলাবে পৃথিবী।
একজন এসআইকে ডেকে এনে ওসি বলেন, দ্রুত লাশ পোস্টর্মটেমের জন্যে হাসপাতালে পাঠাও। আর একটা মার্ডার মামলা রেডি করে রাখ। মেয়েটির নামণ্ডপরিচয় এসআই মেহেদী হাসানের কাছে আছে। তার কাছ থেকে সকল তথ্য নিয়ে এজাহার রেডি করো। যেনো শোলকার বাবা-মা বা ভাই যে কেউ আসলে মামলাটা দ্রুত রুজু করা যায়। অবশ্য চাইলে ঠিকানা আমার কাছ থেকে নিতে পারে। নাম শোলকা রানী বৈদ্য, বাবা-পরিমল বৈদ্য, গ্রাম-শান্তিপুর, বৈদ্য বাড়ি। না স্যার, যে অফিসার ঘটনাস্থলে গেছে তার কাছে সকল তথ্য উপাত্ত আছে।
আরেকটা মামলা। আরো কয়েকজন আসামী। কয়েকজন অজ্ঞাতনামা। তারপর এর সাথে জাড়িয়ে যাবে নিরপরাধ অন্য কেউ। শান্তিপুরে আর শান্তি থাকে না। একটা খুনের অন্তরালে আরেকটা খুন। এ খুনের প্রতিযোগিতা কখনো শেষ হবে না। যা হাবিল কাবিল থেকে শুরু হয়ে আজও চলমান। চলবে পৃথিবী ধ্বংস অবধি।